কিছু কিছু মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন যারা প্রচণ্ড সংগ্রাম করে জীবনের সফলতা অর্জন করে, স্বীয় কীর্তিকর্ম দ্বারা দেশ তথা বিশ্বকে উপকৃত করেন। তারপর সবার চেতনার ভিত্তিকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়ে এক সময় নীরবে-নিঃশব্দে অন্তঃলোকের পথে পাড়ি জমান। তেমনি একজন মানুষ প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। ক্ষণজন্মা এই মানুষটি বাংলাদেশের গ্রামীণ অবকাঠামো বিনির্মাণে কী ভূমিকা রেখে গেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। শুধু কি অবকাঠামো উন্নয়নে! একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে অনুভব করতে পেরেছিলেন বলেই জাতীয় উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক জ্বালানি সরবরাহে আজীবন কাজ করে গেছেন। একজন মানুষের দেশপ্রেম, সততা ও দূরদৃষ্টি থাকলে কর্মজীবনে দেশের জন্য কী করতে পারে তার প্রমাণ রেখে গেছেন এলজিইডি, নগর পরিকল্পনা, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, প্রাইভেটাইজেশন কমিশন, যমুনা সেতু কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশনে দায়িত্ব পালনকালে।
প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ১৯৪৫ সালের ২০ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬০ সালে কুষ্টিয়ার সিরাজুল ইসলাম মুসলিম হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬২ সালে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি, ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্লানিংয়ের ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। '৭০-এর দশকে পল্লীপূর্ত কর্মসূচিতে কর্মজীবন শুরু করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবিস্মরণীয় ভূমিকার কথা কুষ্টিয়াবাসী তথা এ জাতি চিরদিন মনে রাখবে। বাংলাদেশের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে তিনি ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরে ভারতের বেতাই ইয়ুথ ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের অধীনে যুদ্ধকালীন অবস্থায় কর্মরত ছিলেন। তার প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধানে ১৯৮২ সালে প্রথমে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল ব্যুরো এবং পরে তা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) হিসেবে গড়ে ওঠে। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি গতিশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে এলজিইডিকে গড়ে তোলেন। পাশাপাশি বাংলাদেশকে এক নতুন পরিচয়ে পরিচিত করেন বিশ্ব দরবারে। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর কাছে এলজিইডিকে একটি সফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে পরিবর্তনের ধারা সূচনা হয় তার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। তার মতো এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কারণে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা, জেবিআইসি, কেএফডব্লিউ, ওপেক ফান্ড, ইফাদ, ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, সৌদি উন্নয়ন তহবিল সংস্থার সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে দিয়েছিল। ফলে বিপুল পরিমাণ উন্নয়ন তহবিল সংগ্রহে কোনো বেগ পেতে হয়নি বিধায় দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে করে গেছেন এক যুগান্তকারী পরিবর্তন।
১৯৯৯ সালের মে মাসে পিডিবির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের পূর্ব পর্যন্ত তিন দশক উলি্লখিত পদসমূহে নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কৃষিক্ষেত্রে শুষ্ক মৌসুমে পানি সংরক্ষণ করে ইরি চাষের মাধ্যমে দেশে খাদ্য চাহিদা পূরণে তিনি রাবার ড্যাম স্থাপন এবং এই প্রযুক্তিকে সারা দেশে জনপ্রিয় করে তোলেন। ৯০-এর দশকে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়নসমূহের বেসম্যাপ (ইধংব গধঢ়) প্রস্তুতির জন্য জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (ওেঝ) চালু করে এক যুগান্তকারী তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলেন এলজিইডিতে। তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নে উৎসাহিত করার সঙ্গে সঙ্গে সব সময়ই পরিবেশ সচেতন থেকেছেন। আধুনিক প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনার সংশ্লেষ ঘটানোর চেষ্টা করে গেছেন নিরন্তর। তিনি জানতেন আমাদের অর্থনৈতিক ও সামর্থ্যের বাস্তবতা। সে কারণে পরিবেশ সচেতন ও পরিবেশবান্ধব থাকার পাশাপাশি প্রতিটি প্রযুক্তি, উদ্যোগ ও তার গ্রহণযোগ্য ব্যয় নিয়ে সতর্ক ছিলেন। বিষয়টির অর্থনীতি ও সামাজিক পটভূমিতে টেকসই উপযোগিতা সম্পর্কে তার ছিল সূক্ষ্ম নজর।
নশ্বর এই পৃথিবীতে গতির প্রবহমান ধারায় জীবনটাও নদীর মতো প্রবহমান। কালের স্রোতে সব কিছু হারিয়ে গেলেও হারায় না প্রজ্ঞা, মেধা ও অনুপ্রেরণা। অপসংস্কৃতির ছোঁয়ায় আমাদের জীবন যখন দুর্বিষহ সেই সংকটময় মুহূর্তে এক সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। তার মধ্যে ধর্মীয় সততা, উদারতা ও সাংস্কৃতিক ঔদার্যের এক বিস্ময়কর সমন্বয় ঘটেছিল বলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক বিরল ব্যক্তিত্ব এবং গণমানুষের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধার মানুষ। লালনগীতি ছিল তার প্রিয় সংগীত। তিনি আমৃত্যু কুষ্টিয়াস্থ বার শরিফ দরবার ও জামে মসজিদের স্থায়ী কমিটির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আধ্যাত্দবাদের মর্মবাণী প্রচারে নিবেদিত ছিলেন।
কামরুল ইসলাম সিদ্দিক তার কাজের ব্যাপারে কতটুকু নিষ্ঠাবান ছিলেন তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমি তখন বিরোধী দলের একজন সংসদ সদস্য হিসেবে তার সঙ্গে পরিচয়ের পর যখন আমার এলাকার একটি ইউনিয়নের একটি ব্রিজের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করি তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কাজটি করার জন্য যে উদ্যোগ গ্রহণ করেন তা সত্যিই অবাক করার মতো। এই ব্রিজটির অভাবে ওই ইউনিয়নের উৎপাদিত আনারস বাজারজাত করণে এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেন স্থানীয় উৎপাদনকারীরা। ব্রিজটি তৈরি হওয়ার পর ওই অঞ্চলের আনারস উৎপাদনকারীরা সহজেই বাজারজাতকরণের এক দুর্লভ সুযোগ পায়।
শুধু আমার ইউনিয়নে নয়, সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ রকম বহু ব্রিজ-কালভার্ট এবং রাস্তাঘাট নির্মাণ করে দিয়েছেন নির্দি্বধায়। তার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনার ফলে আজ সারা দেশে এ রকম অসংখ্য হাট-বাজার, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, বিপণন অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। বর্তমান বাংলাদেশে কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের মতো একজন নিবেদিতপ্রাণ, দেশপ্রেমিকের খুবই প্রয়োজন। এখন বিশ্বায়নের যুগ। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিল। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য অবাধ তথ্য প্রবাহের যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কথা এলে প্রথমেই যে ব্যক্তিটির কথা স্মরণে আসে তিনি হলেন প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। তার মতো একজন দেশপ্রেমিক প্রকৌশলীকে হারিয়ে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার নয়। আমি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তার বিদেহী আত্দার মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক : সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।