ছোট্ট একটা চিঠি দিয়ে আজ শুরু করি,
"শ্রদ্ধেয় মামা,
সালাম নিও। আশা করি খোদার রহমতে ভালো আছো। মামা, তোমার সাথে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি না। মামা, তুমি ছাড়া তো আমার কেউ নেই। তাই তোমাকেই সব বলতে হয়। মামা, আমি খুব সমস্যায় আছি। আমার জন্যে তুমি দোয়া কর।
স্নেহের এ্যানি
বিঃদ্রঃ আমার মোবাইলে কার্ড না থাকায় তোমাকে ফোন করতে পারছি না।"
আউয়াল সিদ্দিকীর মেয়ে মমিনের ভাগি্ন এ্যানি। দুজনেই মুক্তিযোদ্ধা। ওরা তিন বোন- এ্যানি, ইরানী, মন্টি। '৯০-এ যখন দেশে ফিরি ওরা তখন সিঙ্-সেভেনে পড়ে। বাবার টাকা-পয়সা ছিল না, তাই পড়ার খরচ আমি দিতাম। তখন ছিল দীপ-কুঁড়ি। এখন দীপ-কুঁড়ি-কুশি। আমরা ছিলাম ১৫-১৬ জন ভাইবোন। ১০ জন আছি, বাকিরা পরপারে। তাই বাচ্চারা কেউ কিছু বললে মনে হয় আমার যদি আরও দু-চারটা ছেলেমেয়ে থাকত তাহলে কী হতো। তাই নিজের সন্তান মনে করেই বাচ্চাদের জন্য যা করার করি। চিঠিটা ২০০৩-০৪ সালের। এক সময় পয়সা না থাকায় ফোন করতে পারেনি। দেখুন দয়াময় আল্লাহর কী অপার মহিমা। মেয়েটির সিলেটে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের ২-৩ বছর পর স্বামীর সঙ্গে এসে হাতের আঙ্গুল টিপতে টিপতে বলেছিল, 'মামা, একটা কথা বলব। তুমি কিছু মনে করবে না তো?' 'না কি মনে করব।' 'তুমি কিছু মনে করলে আমাদের খুব কষ্ট হবে। আমাদের কথায় রাগ বা মন খারাপ করতে পারবে না।' এরপর 'মাথায় হাত দিয়ে বল সত্যিই কিছু মনে করবে না তো।' বললাম তো। এবার বল কী বলতে চাস? বড় কাচুমাচু হয়ে বলল, 'মামা, আমার জন্যে তুমি কত কিছু করেছ। তুমি টাকা না দিলে কী যে হতো। এখন তো আমাদের সামর্থ্য আছে। আমরা তোমাকে একটা গাড়ি কিনে দিতে চাই, না করতে পারবে না।' কথা শুনে অন্তরাত্দা নাড়া দিয়ে উঠেছিল। মনে হয় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। স্বপ্নেও ভাবিনি এ্যানি গাড়ি কিনে দেওয়ার কথা বলতে পারে। জীবনে কতজনকে কত কিছু দিয়েছি, কত বড় বড় ব্যবসায়ী, চাকুরে, এমপি, মন্ত্রী কতজন কত কী হয়েছে। আমার এক সহকর্মী ড. নুরুন্নবীর আমার ঘরে বাসর হয়েছে। পায়ের জুতা থেকে গলার হার কী দিইনি। এখন আমেরিকায় ধনী এবং ক্ষমতাবান বাঙালিদের মধ্যে অন্যতম। তারা কেউ একদিনের জন্যও বলল না, স্যার, আপনাকে একটা ছাগল কিনে দিতে চাই বা কয়েকটা হাঁস-মুরগি। আর যাকে মাসে মাসে দু'চার হাজার টাকা দিয়েছি, সময়ে-অসময়ে জিজ্ঞেস করেছি সেই মেয়ে মোটামুটি একটা সচ্ছল ঘরে বিয়ে হয়েই আমায় গাড়ি কিনে দিতে চায়। আনন্দ যেমন পেয়েছিলাম, বুকের ভেতর তেমন তোলপাড়ও করেছিল। দেখুন ভাগ্য? দয়াময় আল্লাহ কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায়। পয়সার অভাবে যে মেয়ে আমার সঙ্গে একদিন মোবাইলে কথা বলতে পারেনি, সেই তাকেই পরম প্রভু দয়াময় আল্লাহ লক্ষ টাকার গাড়ি কেনার সামর্থ্য দিয়েছেন। ভাগি্ন এ্যানি যেমন লিখেছিল, 'তুমি ছাড়া আমার তো আর কেউ নাই।' মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনিই বলুন, বাবা-মা হারা বঙ্গবন্ধুর পাগল আমারইবা কী আছে, কে আছে?
এবার কাজের কথায় আসি। জাসদ নিয়ে দু'কথা লিখতে চেয়েছি। যা জানি তা না লিখলে পাঠক ভুল বুঝবে। এখন পাঠক ছাড়া আমার আর তেমন কী আছে! কোথা থেকে শুরু করা যায় তাই ভাবছি। গোড়া থেকে শুরু করলে অনেক হবে। কবে শেষ হবে বলা যায় না। যখন যা মনে আসে তা লিখলে হয়তো একটা কিছু হবে। দেখা যাক, লিখতে থাকি, যা হয় হবে। জাসদের জন্মের আগে পল্টনে জাসদ ছাত্রলীগের জন্ম। পল্টনে তাজউদ্দীন আহমদ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির মধ্য দিয়ে দুই ছাত্রলীগের একটির জন্ম, অন্যটির সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন পল্টনে যাননি। বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়েছিলেন, আমিও গিয়েছিলাম সেখানে। এখন যারা বড় বড় নেতা তখন তাদের নাম গন্ধও ছিল না। পরেরবার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে ছাত্রলীগের সম্মেলন। জাসদ হামলা করে গুঁড়িয়ে দিতে পারে- এ ভয়ে কয়েকবার নূরে আলম সিদ্দিকী বাবর রোডের বাসায় আসেন। আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট পাহারা দিতে হবে। রাজি হইনি। জননেতা জনাব আবদুর রাজ্জাক অনুরোধ করেছিলেন। বলেছিলাম, ওসব কি বঙ্গবন্ধু জানেন? তিনি বলেছিলেন- 'তার কথাই তো বলছি।' না, তাতে হবে না। বঙ্গবন্ধুকে বলতে হবে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর কথা ছাড়া কোনো কিছু করতাম না। এখন যেমন লতিফ ভাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মতামত বা সম্মতি ছাড়া কোনো কিছু করেন না বা করতে চান না। একই মা-বাবার সন্তান আমরা, একসঙ্গে বড় হয়েছি। কত ঝড় তুফান পাড়ি দিয়েছি। কথায় কথায় দু'একবার বলেছেন, 'বজ্র, নেত্রী বিশ্বাস করে দায়িত্ব দিয়েছেন, তাই তার ইচ্ছার বাইরে এ বয়সে আর কিছু করতে চাই না। ঝড় তুফান যাই আসে আসুক, যতদিন বেঁচে আছি, তার সঙ্গেই আছি। এটা আমাদের রক্তের তাছির।' বঙ্গবন্ধু আমায় সুগন্ধায় ডেকেছিলেন। বলেছিলেন, 'কাদের, ওদের সম্মেলনে একটু যাওয়া যায় না। এ সময় ওরা সম্মেলন করতে না পারলে বড় বেশি বদনাম হবে।' এমনভাবেই অস্ত্র নেওয়ার সময় বলেছিলেন, 'তোর হাতে এত অস্ত্র, তুই না দিলে অন্যকে বলি কী করে?' গিয়েছিলাম ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের সম্মেলনে। নিরাপদেই সে সম্মেলন হয়েছিল। কিন্তু জাসদের কর্মকাণ্ড থেমে থাকেনি। দিন গড়িয়ে যাচ্ছিল। একের পর এক থানা লুট, পাটের গুদামে আগুন, রেললাইন উপড়ে ফেলা, ঈদের মাঠে নেতা-কর্মী, এমপি হত্যা লেগেই ছিল। অন্যদিকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানের নেতৃত্বে বিদ্রোহী ছাত্রলীগ দুর্নীতিবাজ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে। জিহাদিদের যত্রতত্র সভা-সমাবেশে বিপুল লোকসমাগম, জাসদের সভাতে উপচেপড়া ভিড়। ভিড় হবে না কেন? মুক্তিযুদ্ধে পরাজিতরা আশ্রয় খুঁজছিল। মুসলিম লীগ, জামায়াতসহ পরাজিত সবার জাসদের ছায়াতলে আশ্রয় মিলেছিল। অন্যদিকে শফিউল আলমের ছাত্রলীগের পতাকা তলে শরিক হচ্ছিল দালালদের সন্তান-সন্ততিরা। এটা প্রকৃত দেশপ্রেমিক জাসদ নেতা বা ছাত্ররা বুঝতে পেরেছিল কিনা জানি না। তবে ঘটনাটা ওই রকমই ছিল। ঘুষ, দুর্নীতি, লুটতরাজ যে ছিল না তা নয়। আদর্শের কথা চিন্তা করে কিছু বোকা হাত গুটিয়ে থাকলেও অনেকে হাত চালাতে দ্বিধা করেনি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যে কোনো অংশে লক্ষণ রেখা টেনে দিলে সে রেখা পার হওয়া কারও বাবার সাধ্য ছিল না। তবু কত কথা! যারা আমার স্যান্ডেল টানত তাদের গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডিতে বড় বড় বাড়ি। যার একটা বাথরুমের টাকায় অনেকের পুরো বাড়ি হতে পারে। তারপরও আমরা বদনামি, তারা সুনামি। বিরক্তিতে বুক ভরে যেত। কিন্তু তবু বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে কিছু করতে পারতাম না। '৭৪-এর শেষে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম, দলের গুণ্ডাপান্ডাদের লুটতরাজ বন্ধ করুন। না হলে আর বসে থাকতে পারছি না।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ধলাপাড়া চৌধুরী বাড়ি অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে বাবু নামে এক ছোট্ট ছেলে অনুমতি ছাড়া একটা গরম চাদর এনেছিল। কত আর দাম হবে, ৭০-৮০ টাকা। সে জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর চোখের সামনে যখন কোটি কোটি টাকার দেশের সম্পদ লুটপাট হতে দেখতাম, কিছু করার ছিল না। তখন সহ্য করতে পারতাম না। মাঝে মাঝে মনে হতো ৭০-৮০ টাকার চাদরের জন্য আমরা কেন একটা তরতাজা প্রাণ নষ্ট করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করতেন, কিন্তু শান্তি পেতাম না। এর মধ্যেই জাসদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করে। সেখানে কয়েকজন মারা যায়, কয়েকজন বন্দী হয়। উত্তেজনা আরও বাড়তে থাকে। এরকম অবস্থায় '৭৫-এর সংবিধান সংশোধন করে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি হন। ক'দিন পর আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের জন্ম দেন। তারও ক'দিন পর জেলা গভর্নর পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। বাধ্যতামূলক সমবায় এবং প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের জন্য জেলা গভর্নর পদ্ধতি করতে গিয়ে সারা দেশকে ৬০টি জেলায় ভাগ করেন। টাঙ্গাইল যা ছিল তাই থেকে যায়। তাতে সারা দেশে বড় জেলার তালিকায় দুই-তিনটির মধ্যে টাঙ্গাইল হয় একটি। আমাকে করা হয় টাঙ্গাইলের গভর্নর। অনেকবার অনেক কিছু এড়িয়ে গেলেও সেবার এড়াতে পারিনি। গভর্নরদের মাসব্যাপী ট্রেনিং ছিল বঙ্গভবনে। ১৫ আগস্ট সচিবালয়ে এক সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে গভর্নরদের যার যার কর্মস্থলে যাওয়ার কথা, অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডিগ্রি দেবে জাতির পিতাকে। সেজন্যে ভক্তরা যেমন ত্রুটিহীন এক ঐতিহাসিক সংবর্ধনার আয়োজনে ব্যস্ত, ঠিক তেমনি শত্রুরা তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ছিল বদ্ধপরিকর। জাসদের গণবাহিনী ১৪ আগস্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আনোয়ারের নেতৃত্বে বোমা ফাটায়। এসব এখন প্রতিনিয়তই পত্রপত্রিকায় বের হচ্ছে।
১৫ আগস্ট শুক্রবার, মোয়াজ্জিনের কণ্ঠে, 'আচ্ছালাতু খাইরুম মিনান নাওম (ঘুম হইতে নামাজ শ্রেষ্ঠ)' যখন উচ্চারিত হচ্ছিল তখন আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের আশা ভরসা এক এক করে হারিয়ে যাচ্ছিল। হাজার বছরের বাঙালির স্বপ্ন খান খান হয়ে গিয়েছিল পিতৃ হত্যার মধ্য দিয়ে। কেউ ভাবতেই পারেনি, ওইভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত হবেন। চারদিকে ষড়যন্ত্র, এটা সবাই জানত, সবাই বুঝত। এমনকি বঙ্গবন্ধুও যে জানতেন না, বুঝতেন না তা নয়। তবে খুনিদের সব থেকে বড় সুবিধা ছিল কেউ তাদের সেই অপতৎপরতা বিশ্বাস করত না। পাকিস্তান হানাদারের সঙ্গে যুদ্ধে আমরা জয়ী হব এটা যেমন ছিল অবিশ্বাস্য, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা যায় এটাও ছিল অবিশ্বাস্য। মনে হয় এ কারণেই তাকে হত্যা করা সম্ভব হয়েছে। ক'দিন থেকে কিছু পণ্ডিত খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে হাসানুল হক ইনু এবং রাশেদ খান মেননকে আবিষ্কার করছেন। যা কিছুই হোক রাশেদ খান মেনন আর হাসানুল হক ইনু এক নন। রাশেদ খান মেননের আলাদা একটা পরিচয় আছে। আর খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে তাদের ওই সময় যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। জাসদের জনাব ইনুরা তখন ফেরার। বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে কর্নেল তাহের জাসদের গণবাহিনীকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন। সেনাবাহিনীর ঘাটে ঘাটে তখন গণবাহিনীর লোক ছিল। তাই যারা বলছেন, মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনু ছিলেন কথাটা ঠিক নয়। এখন হাসানুল হক ইনু মন্ত্রী হলেও '৭৫-এ তিনি রাশেদ খান মেননের পর্যায়ে ছিলেন না। গণবাহিনীর উপ-প্রধান ছাড়া রাজনৈতিক বিচারে তিনি কোনো জাতীয় নেতা ছিলেন না।
ইদানীং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিনে বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন আওয়ামী লীগের কাছে জঘন্য মনে হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিশ্চয় খুবই কষ্ট হয়, আমাদেরও হয়। বড় সমস্যায় আছি, পিতার দলে গণবাহিনী, মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার দলে রাজাকার। শিল-পাটায় ঘষাঘষি, মরিচের জান ক্ষয়ের মতো সাধারণ মানুষের অবস্থা। সত্য হোক, মিথ্যা হোক বেগম খালেদা জিয়া তার জন্মদিন বলে কেক কাটে। কিন্তু ১৫ আগস্টের পর কারও কোনো জন্মদিন ছাড়াই কত লাফালাফি করেছে, কত বড় বড় কেক কেটেছে সে তো মাননীয় নেত্রীর না জানার কথা না। কি করব বলুন? রামের ভাই লক্ষ্মণের বাণ সহ্য হলেও, বানরের ভেংচি সহ্য হয় না। বঙ্গবন্ধুর চামড়াছোলা ডুগডুগি বাজানো বেগম মতিয়া চৌধুরীরকে সহ্য করতে পারি না। পল্টনে দিনের পর দিন বঙ্গবন্ধুকে ফেরাউন, জল্লাদ বলে এখনকার চাইতে বড় গলায় তার চিৎকার এখনো যে আমার কানে বাজে।
বীরউত্তম জিয়াউর রহমানের পুত্র তারেক রহমান লন্ডনে বসে যেভাবে কথাবার্তা বলছেন তাতে বাংলাদেশের হৃদয় থেকে মুছে যেতে আর কাউকে লাগবে না। তিনি তার নিজের কর্মকাণ্ডেই বিলীন বা মুছে যাবেন। বঙ্গবন্ধু খুনি, পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে তিনি শাহেদ আলীকে খুন করেছেন। এসব বলা সততার অপলাপ, আরও লেখাপড়ার দরকার। তার পরিবার অভিশপ্ত খুনি পরিবার- এসব উদ্ধত উক্তি কেউ মেনে নেবে না, বিএনপির সুস্থ মানুষও নয়। আওয়ামী লীগ খারাপ হতে পারে, তার কর্মকাণ্ড খারাপ হতে পারে, তার বিরোধিতা বা সমালোচনা করা যেতে পারে, তাই বলে আওয়ামী লীগ কুলাঙ্গারের বা কুলাঙ্গার দল এসব অসভ্য কথার কোনো মানে হয় না। উচ্চাসন থেকে এত নিম্নমানের কথা কেউ শুনতে চায়? তবে তারেক রহমানের কথার জবাব যেভাবে দেওয়া হচ্ছে সেটাও খুব একটা গ্রহণযোগ্য হয়নি। জনাব তোফায়েল আহমেদের কাউকে 'তুই মুই' বলতে হবে কেন? 'আমায় কুলাঙ্গার বলেছিস, তাই তুই কুলাঙ্গার।' এর ওর কাছে মাঝে মাঝেই শুনি, 'Shut up-You Shut up'- বিশেষ করে বাচ্চারা ঝগড়ার সময় যেমন বলে, তেমন এটা ঝগড়ার কথা হতে পারে, কোনো যুক্তির কথা নয়।
মনে হয় আপনারা বেলজিয়াম দূতাবাসে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পান। বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শফিকুল হক, একদিন আগেও তাদের থু থু ফেললে হয়তো চেটে তুলতেন। তার স্ত্রী এবং অন্যরা আগের রাতেও পা টিপে ঘুম পারিয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ ইথারে শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়িতে আপনাদের থাকার জায়গা হয়নি। কয়েক ঘণ্টা আগে আপনারা ছিলেন মুক্তার মালা, পিতার মৃত্যু সংবাদে হয়েছিলেন চরম জ্বালা। হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে গাড়ি করে আপনাদের জার্মানি পাঠিয়েছিলেন। সে সময় ড. কামাল হোসেনকে খুঁজে পাননি। তা তাকে পাওয়া না গেছে না যাক, জার্মানিতে কি খুব ভালো ছিলেন? '৯৬ সালে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী স্পিকার ছিলেন। তার সঙ্গে সংসদের কিছু ছোটখাটো কাজ দেখেছি। যে কারণে সময় অসময় অনেক কথাবার্তা হয়েছে। আপনারা যখন জার্মানিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে ছিলেন, তখন জাসদের নেতাকর্মীরা দূতাবাস ঘেরাও করে আপনাদের তাদের হাতে তুলে দিতে দাবি করেছিল। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে খুনিদের স্বাদ মিটেনি, আপনারা দু'বোন ছিলেন, আপনাদেরও বিদেশ-বিভূঁইয়ে হত্যা করে স্বাদ মিটাতে চেয়েছিল। হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী বেঁচে নেই, আপনি এবং বোন রেহানা আছেন। আপনিই বলুন জার্মানিতে জাসদের লোকজন তখন হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বাড়ি বা অ্যাম্বাসি ঘেরাও করেনি? যার জন্য হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীকে পুলিশ ডাকতে হয়েছিল। ধৈর্য থাকলে অবশ্যই আরও দু'এক কথা লিখবো। সেদিন জনাব কাজী সিরাজ এক অসাধারণ লেখা লিখেছেন। আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের এত প্রশংসা- যে কারণে কিছুটা ঋণী বা অভিভূত হয়েছি। শুধু জনাব এস. এম. ইউসুফের প্রতিবাদের কথা তুলে ধরায় তার একজন হিতৈষী এত মুগ্ধ হতে পারেন, তাহলে যাদের জন্যে জীবনপাত করেছি তারা সামান্য সৌজন্যও দেখান না কেন? বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে আমিই সব করেছি আর কেউ কিছু করেনি- এটা মরেও ভাবতে পারবো না। মৌলভী সৈয়দ, মহিউদ্দিন এদের থেকে অনেক সিনিয়র নেতা জনাব এস.এম. ইউসুফ। অনেক অনেক কাজ করেছেন তিনি। তিনি করেছেন আমি লিখেছি তাতেই জনাব কাজী সিরাজ এত খুশী। আমরা এক সাথে অনেক পথ চলেছি। সেদিন হঠাৎই রাজবাড়ীর জেলা পরিষদ প্রশাসক আকবর মর্জি এসেছিল। বলেছিল, 'দাদা, '৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরের সঙ্গে কল্যাণীতে কতদিন মাটি কেটে খেয়েছি, সেসবের কে খোঁজ রাখে?' বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর কয়েক বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফজলে হোসেন বাদশা আর রানা প্যানেল জিতেছিল। বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর জনাব বাদশা আর বাকি সব ছাত্রলীগের। ছানাও মনে হয় ছিল। বিজয়ীরা অভিষেক অনুষ্ঠানে বুকে বঙ্গবন্ধুর ছবি লাগাতে চেয়েছিল। জাসদ ছাত্রলীগ তাও লাগাতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত আমার মতো মুজিব কোট পরে অভিষেক করেছিল। এগুলো আমার কথা নয়, এসবই ঘটে যাওয়া ঘটনা। দয়াময় পরম প্রভু আল্লাহ কোরআন মাজিদে বলেছেন, 'আমি সব করতে পারি। কিন্তু অতীত বদলাতে পারি না।'
লেখক : রাজনীতিক।