সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখ যখন এ লেখা লিখছি তখন বগুড়া, শরীয়তপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। হঠাৎ করে বাঁধ ভেঙে বানের তোড় আঘাত করেছে চন্দনবাইসাকে। মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সর্বস্বান্ত হয়েছে। টেলিভিশনে কাঁদল কয়েকজন মানুষ। স্থানীয় এমপিকে দেখলাম কথা বলতে, থালায় করে রিলিফের চাল দিতে। মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে দেখলাম দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করতে- কাউকে না খেয়ে মরতে দেওয়া হবে না। এক ব্যক্তিকে টেলিভিশনে বলতে শুনলাম অনেকটা খালেদা জিয়ার মতো, এ কয়দিনে কারও কাছ থেকে আমরা কোনো সাহায্য পাইনি। তা হতেই পারে। এ মুহূর্তে সরকার সম্প্রচার নীতি নিয়ে বিব্রত, বিচারকদের অভিশংসন বা অপসারণ নিয়ে ব্যস্ত, প্রশ্নবিদ্ধ মন্ত্রিসভা তড়িঘড়ি করে পাস করেছে বটে, কিন্তু সংসদে কি পাস হবে? সংসদ বসেছে গতকাল। বিরোধী (!) দলের নেতা তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন সরকারের এ দুই নীতিকে। বলেছেন, আগে কমিশন করে সবার সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে।
তা উনি বলুন গিয়ে। সেই যে কথা আছে- কে যেন কী বলে আর কে যেন কী খায়। তাতে 'অতি মাননীয়' প্রধানমন্ত্রীর কী আসে যায়? কিন্তু মুশকিল হয়েছে, বিরোধী নেতা এ কথাও বলেছেন যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমূহ অবনতি হয়েছে। তার কারণ অপরাধীদের ধরা হচ্ছে না, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। এ যে একেবারে অরিজিনাল বিরোধী দলের মতো কথা। এমনিতে বাছাই করে করে সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের মালিকদের সঙ্গে ভাব দেখিয়ে সম্প্রচার নীতি একটা ঘোষণা করেছিল সরকার। মনে করেছিল যে, ওরা তো পক্ষেই থাকবে। কিন্তু না। বিএফইউজের নেতা বললেন, এটার ফাইনাল ড্রাফট আমি দেখিনি। আর আমরা যে রকম চেয়েছিলাম এটা সে রকম তো হয়ইনি। সম্পাদক পরিষদ তো সম্প্রচার নীতি সরাসরি প্রত্যাখ্যানই করেছেন। এসব কিছু নিয়ে সরকার তো বেশ খানিকটা অসুবিধার মধ্যেই আছে। এরই মধ্যে আবার বন্যা। কত দিক সামাল দেবেন প্রধানমন্ত্রী। অবশ্য তবুও ভালো, রাজপথের বিরোধী দল সরাসরি এ জন্য সরকারি দলকে আক্রমণ করেনি। আমার মনে আছে এর আগের টার্মে বেগম জিয়ার ক্ষমতায় থাকাকালে ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। আওয়ামী লীগ তখন বলেছিল, প্রধানমন্ত্রী এক 'তুফানী বেগম'। আল্লার গজব পড়েছে তার ওপরে। আর সে জন্য কষ্ট পাচ্ছে জনগণ।
বেচারা বেগম জিয়া। জোর করে কেড়েকুড়ে নিয়ে একজনকে দিয়ে শয়ে শয়ে ভোট প্রদান করে ক্ষমতা আবার করায়ত্ত করে আনন্দ উপভোগ করতে পারছেন না। বেগম জিয়াকে তার বাসস্থান থেকে উৎখাত করে, প্রটোকল কেড়ে নিয়ে, আনসার পাঠিয়ে দিয়েও 'মদমত্ত উল্লাস' করতে পারছে না সরকার। যে রকম লাগাতার গালাগাল প্রধানমন্ত্রী থেকে তার ভাই-ব্রাদার, চামচা মন্ত্রীরা শুরু করেছেন তাতে মনে হচ্ছে বেগম জিয়াকে নিয়ে তাদের মনের মধ্যে এক গভীর ভীতি ঢুকে আছে। কীসের ভয়? কেন ভয়?
১ সেপ্টেম্বর ছিল বিএনপির ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রায় সবকটি পত্রিকা এ উপলক্ষে বিশেষ প্রতিবেদন ছেপেছে। আমি কয়েকটি পত্রিকার শিরোনাম উল্লেখ করছি : প্রথম আলোর শিরোনাম- '৩৬ বছরে সবচেয়ে নাজুক বিএনপি'। বাংলাদেশ প্রতিদিনের- 'হামলা আর মামলায় নিঃসঙ্গ খালেদা'। কালের কণ্ঠ- 'মামলার হাঁসফাঁস বিএনপি নেতারা'। সমকালের- 'দুঃসময়ে বিএনপি।'
পত্রিকার এ প্রতিবেদনগুলো পড়লে কারও মনে হবে যে, বিএনপি সহসা বড় কোনো আন্দোলন করতে পারবে? বাস্তব হচ্ছে ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে বিএনপি তা পারেনি। ৫ তারিখে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক ন্যক্কারজনক দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। কিন্তু সেই ন্যক্কারজনক ঘটনার নায়ক-নায়িকারাই তো এখন ক্ষমতায়। সেটাও বিএনপির ব্যর্থতার কারণেই। সেই ঘটনার পর সাত মাস পার হয়ে গেছে। বিএনপি একটা মানববন্ধন ডেকেছিল। কিন্তু সরকারি বাধার মুখে তারা তা পালন করতে পারেনি। তাহলে সরকারের এত ভয়ের কারণ কী? এখানেই ইতিহাস কথা বলবে।
আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতাও তখন ভয় পেয়েছিলেন যখন শেখ হাসিনা একাই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সেই নাটক মঞ্চস্থ করতে পেরেছিলেন এবং এখন তিনি ক্ষমতায় আসীন। দলের মধ্যে শেখ হাসিনার অবস্থান আগের চেয়ে অনেক শক্ত। আমু-তোফায়েলরা এখন তার করুণার পাত্র। এ জন্যই ছাত্রলীগের মঞ্চে তোফায়েলের জন্য একটা চেয়ারও থাকে না। তিনি বোধহয় চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি চলে গেছেন। কী আর করবেন! বেচারা!
কিন্তু তারপরেও আমি বলছি ইতিহাস কথা বলবে। ঘটে যা তা-ই সত্যি নয়। ৫ জানুয়ারি সত্য নয়। এখনকার ক্ষমতাটা বৈধ নয়। এ কথা সবচেয়ে বেশি জানেন শেখ হাসিনা। জনগণ আর তাদের সঙ্গে নেই। পায়ের নিচে আছে র্যাব আর পুলিশ। তার মধ্যে র্যাব তো গুটিয়ে নেওয়ার অবস্থা। একই রকম কাজ তো পুলিশও করেছে বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। পুলিশও কি এক সময় গুটিয়ে ফেলবে? সরকারের অপরাধ তারা নিজের কাঁধে নেবে কেন? একটা সময় আসবেই, আজ বা কাল বা পরশু যখন প্রেক্ষিত এবং পটভূমিটা বদলে যাবে।
আওয়ামী লীগ হয়তো ভাবছে, বিএনপি এ পথটা বদলে দেবে। কিন্তু সেটাই একমাত্র সম্ভাবনা নয়। বরং সত্য হলো, পরিস্থিতিটা এরকম থাকবে না। আমি মনে করি, শেখ হাসিনা অতিশয় চালাক। তিনি এটা বোঝেন বাংলাদেশ যে মিসর কিংবা পাকিস্তান হবে না এটা তার মাথায় আছে। এ জন্যই গণতন্ত্রের লেবাসটা তিনি পুরোপুরি খুলে ফেলছেন না। সব শক্তি দিয়ে এটা বোঝানোর চেষ্টা করছেন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কোনো বিকল্প ছিল না। বর্তমান যে সরকার আছে তার নেতৃত্বে সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে কিন্তু এটাই সংবিধানসম্মত, এটাকে মেনেই আগামীতে চলতে হবে। আরও একটি বিষয় এ অসত্যকে অস্পষ্ট বা আড়াল করার জন্য তিনি প্রচারে আনছেন যে, এখন গণতন্ত্রের প্রশ্নটাই বড় নয়, বড় প্রশ্ন অর্থনৈতিক অগ্রগতি, ২০২১ এর মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে, ৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া। সে জন্য তারা স্লোগান তুলছেন- শেখ হাসিনাই পারে, শেখ হাসিনাই পারবে। এ জন্যই তারা বলতে চাচ্ছেন ২১ সাল তথা ৪১ সাল পর্যন্ত তাদের ক্ষমতায় থাকা দরকার।
শেখ হাসিনা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। শেখ হাসিনা পারেন না। এই পাঁচ বছর সাত মাসে পারেননি। সাহস থাকলে বর্তমান সরকারকে দেশের প্রতিষ্ঠিত সব অর্থনীতিবিদকে নিয়ে একটি সংলাপের আয়োজনের প্রস্তাব করছি সেটা সরাসরি দেশব্যাপী প্রচার করা হবে। মানুষ দেখবে অর্থনীতি কীভাবে খাবি খাচ্ছে। দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে দেশ। গত পাঁচ বছরের মন্ত্রিসভার দুজন তাদেরই পালিত দুদকের কাছে মামলার জালে ধরা পড়েছেন। সঙ্গে একজন এমপিও আছেন। সর্বশেষ প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী আরও দুজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এ সরকার শুধু অনির্বাচিত স্বৈরাচারী নয়, এরা দুর্নীতিবাজ এবং মিথ্যাচারী। মানুষ এর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠবেই।
বিএনপি যে আন্দোলনে ব্যর্থ, বেগম জিয়া একলা নিঃসঙ্গ এগুলোর কারণ আমার উপরোক্ত কথার মধ্যে খুঁজে পেতে হবে। বিএনপি নেতারা অস্ত্র মামলার জালে জড়িয়েছেন বলেই দলটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে এরকম কোনো কথা নয়। এরকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগও পড়েছিল ছয় দফার আন্দোলনকালে। যখন আওয়ামী লীগ অফিসে বাতি জ্বালানোর লোক ছিল না, আমিনা বেগমের মতো মহিলাকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিতে হয়েছিল। বিএনপির অবস্থা সে তুলানায় তো অনেক ভালো। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতো একজন ভদ্রজন দলের মহাসচিবের দায়িত্বে আছেন।
বিএনপির সমস্যা হচ্ছে, বিএনপি রাজনীতিটা যথাযথভাবে করছে না। সরকারের সন্ত্রাস সীমাহীন সেটা সত্যি কিন্তু সেটা মোকাবিলা করেই তো এগুতে হবে। সরকার নিশ্চয়ই আন্দোলনের পথে ফুল বিছিয়ে দেবে না। এ পরিস্থিতির মধ্যেই জনগণকে নিয়ে আন্দোলনটা করতে হবে। কিন্তু বিএনপি জনগণের দাবি নিয়ে তাদের সংগঠিত করার কাজ করছে না। গণতন্ত্র মানে কেবল নির্বাচন নয়, যেনতেন ধরনের একটি নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের বদলে বিএনপি ক্ষমতায় এলে জনগণের জন্য পরিস্থিতি বদলে যাবে না। একটি নিটল গণতন্ত্র নির্মাণের জন্য, সেই গণতন্ত্রকে সর্বসাধারণের কল্যাণে নিরাপদ করার জন্য বিএনপি কী করতে চায় তা বলতে হবে। কেবল আগামীতে বেগম জিয়া বা তার পুত্রের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেই দেশ এগিয়ে যাবে এটা কোনো কাজের কথা নয়। মাঠের বক্তৃতায় বিএনপি নেতারা বলতেই পারেন সংকটে বিএনপি নয়, গোটা দেশ এখন সংকটে। মিতভাষী ফখরুল এটা যথার্থই বলেছেন, দেশ এখন সংকটে। বলতেই পারেন দেশ এখন মহাসংকটে। কিন্তু এও সত্য, বিএনপিও এখন বিশাল সংকটে। এক বড় চ্যালেঞ্জের মুখে, যা রাজনৈতিকভাবে অতিক্রম করতে না পারলে বিএনপির জায়গা অন্য কেউ দখল করে নেবে।
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।
ই-মেইল : [email protected]