১. মাননীয় অর্থমন্ত্রী, বানভাসি মানুষের অন্তহীন বেদনার মাঝে আপনি আগামীকালের নৌকাবাইচ উৎসবে যাবেন না। সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত মানুষেরা এখন আপনাদের কাছে নৌকাবাইচের উৎসব দেখতে চায় না। চায় পর্যাপ্ত ত্রাণ সাহায্য। চায় নতুন করে কৃষি ঋণ। গৃহহারা মানুষ চায় মাথা গোঁজার ঠাঁই। কাজের সুযোগ। নিরন্ন মানুষেরা চায় খাবার। স্বাস্থ্যসেবা। এ সময়ে মানুষের আর্তনাদ শুনে আপনার মানবিক হৃদয়খানি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দুই হাত পেতে সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত গরিব মানুষের জন্য সাহায্য নিয়ে যান। একটি নৌকাবাইচের উৎসবের খরচ বানভাসি মানুষদের বিলিয়ে দিতে আয়োজকদের বলুন। মাননীয় অর্থমন্ত্রী, ভাষা আন্দোলন থেকে সুমহান মুক্তিযুদ্ধ, একজন জাঁদরেল আমলার জীবন থেকে সৃজনশীল মানুষ হিসেবে লেখকসত্তা দিয়ে দেশকে আপনি যেমন দিয়েছেন, এই জাতিও আপনাদের কম দেয়নি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আপনার কর্মব্যস্ত জীবনে ২০ লাখ মানুষের জেলা সুনামগঞ্জে যাওয়ার সুযোগ আপনি সাত বছরেও পাননি। অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর এমন এক সময় সুনামগঞ্জ শহরে যাচ্ছেন যখন বন্যাকবলিত মানুষের চোখের নিচে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার কালো ছায়াই নয়, ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুবিন্দুও ঝরছে। এই সময়ে আবহমান বাংলার বিশেষ করে সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচের আয়োজকরা যেমন শুভবুদ্ধির পরিচয় দেননি তেমনি প্রধান অতিথি হয়ে আপনার এই সফরও বিতর্ক কুড়াতে পারে। প্রখ্যাত লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় গণতন্ত্রের মহান নেত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যখন আসামের বন্যা দেখতে হেলিকপ্টার সফরে বেরিয়েছিলেন তখন তার কবিতায় বন্যাকবলিত মানুষের প্রতি সহানুভূতির প্রকাশ ঘটিয়ে আকুল আবেদন জানিয়েছিলেন অনেকটা এই রকম করে 'প্রিয় ইন্দিরা এই সময়ে আপনি বন্যা দেখতে যাবেন না, হেলিকপ্টার থেকে জল আর জল দেখে আপনার অজান্তেই বেরিয়ে আসতে পারে বাহ! কী সুন্দর!' মাননীয় অর্থমন্ত্রী, বানভাসি মানুষের হৃদয় যখন ত্রাণ সাহায্যের জন্য কাঁদছে তখন আপনিও নৌকাবাইচের মতো উৎসবে প্রধান অতিথি হয়ে সুনামগঞ্জের সুরমাতীরে উপস্থিত হবেন না। সমবেত হাজার হাজার মানুষের সামনে আপনার অজান্তেই বলে বসতে পারেন, 'বাহ! অথৈ জলরাশির মুখে কী সুন্দর না নৌকাগুলো ছন্দে ছন্দে ঢেউয়ের তাল তুলে এগিয়ে যাচ্ছে।' আপনি হয়তো ভুলে যাবেন এই মনোরম দৃশ্যের বিপরীতে ঘরহারা বন্যার্ত মানুষের চোখের নিচে জমে থাকা অশ্রুবিন্দুর কথা। মানুষের দুর্ভোগের কথা।
২. একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে, একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী হিসেবে আলোর নিচে অন্ধকারের মতো পড়ে থাকা সুনামগঞ্জের মানুষের প্রতি অনেক দায়বোধ রয়ে গেছে আপনার। বাংলাদেশের অর্থনীতির সংস্কারক খ্যাত আপনার পূর্বসূরি মরহুম এম সাইফুর রহমান ও বোমা হামলায় নিহত শাহ এ এম এস কিবরিয়া অনেক ভূমিকা রেখেছেন উন্নয়নে। আপনিও হয়তো রাখছেন। যদিও শেয়ারবাজারের লুটেরাদের লম্বা হাত দেখে আপনি নিরাপদ দূরত্ব রেখেছেন। মাননীয় অর্থমন্ত্রী, খোঁজ নিলে জানতে পারবেন আপনার নির্বাচনী এলাকা সিলেট ছাড়াও মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে ওই দুই অর্থমন্ত্রী ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করে গেছেন। সিলেট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে অবহেলার শিকার ধান, বালি, পাথর, গ্যাস ও মৎস্যভাণ্ডার খ্যাত হাওরের রাজধানী সুনামগঞ্জ। আষাঢ়ে পূর্ণিমার রাতে জল-জোছনার সুনামগঞ্জ প্রকৃতিপ্রেমী যে কোনো রোমান্টিক মানুষকে মুগ্ধ করে দেবে। হাওরের উত্তাল আফালের সঙ্গে আসমান ভেঙে নেমে আসা জোছনার রূপ, জোনাক জ্বলার দৃশ্য আপনাকে অভিভূত করবে। কিন্তু অকাল বন্যায় যখন ফসল তলিয়ে যায় তখন কৃষকের বুকটা হুহু কান্নায় ভরে যায়। প্রকৃতির সব সৌন্দর্য অভিশাপ হয়ে জোছনার আলোর নিচে কৃষকের চোখের কোনায় অশ্রুবিন্দু চিকচিক করে ওঠে। আর কৃষক তখন বাঁধ রক্ষার্থে তার বুকখানি দিয়ে ফসল রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৩. মাননীয় অর্থমন্ত্রী, যত দূর জেনেছি ঢাকাস্থ সুনামগঞ্জ সমিতি এ নৌকাবাইচের আয়োজন করেছে। এ খবরটি আমি পেয়েছি ফেসবুকের সুবাদে। খোদ প্রবাসীরা পর্যন্ত এই বন্যাকবলিত মানুষের জন্য তাদের সহানুভূতি জানিয়ে আবেদন জানিয়েছেন। অবিলম্বে এটি পিছিয়ে দেওয়া হোক। আগে মানুষ, আগে জীবন, আগে মানবিকতা, তারপর উৎসব। মাননীয় অর্থমন্ত্রী, রাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে আপনি খোঁজ নিন সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত মানুষেরা কতটা সাহায্য সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে পেয়েছে আর কতটাই বা দুর্গতির শিকার হয়েছে। ঢাকাস্থ সুনামগঞ্জ সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমানও হাওরের সন্তান। একজন দক্ষ সরকারি আমলা হিসেবে তিনি বিএনপি আমলে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক ছিলেন। বর্তমানে যুগ্ম-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ নৌকাবাইচ উৎসবে তিনি অর্থ প্রতিমন্ত্রী, সুনামগঞ্জ-৩ আসনের জনপ্রতিনিধি আবদুল মান্নানকে বিশেষ অতিথি করেছেন। সুনামগঞ্জের হাওরজয়ী রাজনীতিবিদ প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নাকি এ উৎসবের পক্ষে ছিলেন না। পরে নানা মহল দিয়ে তাকে রাজি করিয়ে বিশেষ অতিথির তালিকায় শীর্ষে রাখা হয়েছে। সুনামগঞ্জের সব সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদে সরকারের রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসকও এ তালিকায়। এ উৎসব নাকি শোকের মাস আগস্টেই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় সংসদ সদস্যের আপত্তির কারণে তা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য যখন নৌকাবাইচ উৎসব কর্মসূচি নেওয়া হয় তখন বন্যা ছিল না। কিন্তু বন্যা আসার পর এ কর্মসূচি স্থগিত বা বাতিল করার নৈতিক দায়িত্ব শুধু আয়োজকদের ওপরই বর্তায় না, আপনাদের ওপরও বর্তায়। আমাদের অনুরোধ, এই সময় নয়, বন্যার ধকল কাটিয়ে ওঠার পর যে কোনো সময় এ নৌকাবাইচ করুন।
৪. মাননীয় অর্থমন্ত্রী, কবর বাঁধাই করে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। অমরত্বও দেওয়া যায় না। মরণশীল মানুষের অমরত্ব ঘটে মানবকল্যাণে রেখে যাওয়া ভূমিকার ওপর। শেখ হাসিনা আগের মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে লাখো কৃষকের হাতে সার-বীজ তুলে দিয়েছিলেন। নিজে গিয়ে এটি তুলে দেন। সেবার বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে তার হাসিটুকু দেখেছে বাংলাদেশ। সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর ওপর সেতুটির কাজও সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন। আগামী মার্চের মধ্যে সেতুটি চলাচল উপযোগী হবে বলে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন। সারা দেশ ঘুরে বেড়ানো এই মন্ত্রী সুনামগঞ্জের যোগাযোগব্যবস্থা ও উন্নয়ন সরেজমিন তদারকি করতে সেখানে ছুটেও গেছেন। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে সেকেলে সব সেতু ভেঙে নতুন সেতু নির্মাণ হচ্ছে। ঢাকা-সিলেট সড়ককে মহাসড়কে উন্নীত করার দাবি সুনামগঞ্জবাসীর।
৫. মাননীয় অর্থমন্ত্রী, আপনার মনে আছে কি না জানি না, '৯৮ সালের বন্যা মোকাবিলায় অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছিলেন শেখ হাসিনার সরকার। সেবার তিনি মন্ত্রীদের তোরণ নির্মাণ করে অভ্যর্থনা ও সংবর্ধনা নিতে বারণ করে দিয়েছিলেন। বর্তমান সময়ে গোটা দেশ বন্যাকবলিত। এ বন্যায় মানুষের ঘরবাড়ির ক্ষতিই হয়নি, জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম কৃষির ওপর আঘাত এসেছে। নদী ভাঙনের করাল গ্রাসে অনেক জায়গায় মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে। আয়োজকরা বলতে পারেন বন্যার পানি কমেছে কিন্তু মাননীয় অর্থমন্ত্রী, আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন যে বন্যার পানি কমলেও মানুষের দুর্ভোগ এখন চরমে। এই সময়ে বানভাসি মানুষের ঘরবাড়ি, খাবারসহ অসুখ-বিসুখের হাত থেকে রক্ষা করার লড়াই করতে হবে। সুনামগঞ্জের বন্যায় সরাসরি ৩৬ হাজার পরিবার ক্ষতির শিকার হয়েছে বলে স্থানীয় সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ অভিযোগ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, ১৭ হাজার হেক্টর রোপা আমন ও দেড় হাজার হেক্টর বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। গ্রামীণ অবকাঠামো ও সড়ক বিপন্ন। সুনামগঞ্জকে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘোষণা করে ১০০ কোটি টাকার প্যাকেজ বরাদ্দ দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে তিনি আবেদন জানিয়েছেন। একই সঙ্গে কৃষকদের সব ধরনের কৃষিঋণ মওকুফ ও নতুন করে কৃষিঋণ বিতরণের দাবি জানিয়েছেন। মাননীয় অর্থমন্ত্রী, আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বানভাসি মানুষের চোখের জল দেখতে যাবেন নাকি নৌকাবাইচের উৎসবে প্রধান অতিথি হবেন। যদি কাল ৪ সেপ্টেম্বরের নৌকাবাইচ উৎসব স্থগিত করেন তবুও আমার অনুরোধ থাকবে, আপনি সুনামগঞ্জ সফরটি বাতিল করবেন না। সরকারের অর্থভাণ্ডার আপনার হাতে, অনুন্নত সুনামগঞ্জের মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ দেখতে জেলার সব সংসদ সদস্যকে নিয়ে আপনি সুনামগঞ্জ সফর করুন। নৌকাবাইচ স্থগিত করে সুনামগঞ্জ সফর করার মধ্য দিয়ে দেখে আসুন, শুনে আসুন স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি ও সিভিল সোসাইটির মুখে কীভাবে শহরে প্রবেশের আগে ডানদিকে হাওরের মধ্যে নিচু জমি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় ভূমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে। কীভাবে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের সংস্কারের বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রায় চার কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে। কীভাবে ধোপাজানসহ বালু ও পাথর মহালগুলোয় চলছে শ্রমিক নির্যাতন, অধিক হারে টোল আদায়, আইনের ফাঁক গলে দুর্নীতির মহোৎসব। কীভাবে বালু ও পাথর শ্রমিকদের ওপর চালানো হচ্ছে নির্যাতন। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজখানির শ্রীহীন চেহারা দেখে আসুন। জানুন শিক্ষক সংকটের বেহাল চিত্র। দেখুন সরকারকে দিনদুপুরে কীভাবে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। কেমন করে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি মরণব্যাধির মতো সাংস্কৃতিক রাজধানী সুনামগঞ্জকে কলঙ্কিত করছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী, আপনিই সিদ্ধান্ত নিন, বিপন্ন বানভাসি মানুষের আর্তনাদ উপেক্ষা করে নৌকাবাইচের উদ্বোধন করে বিবেক যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হবেন নাকি একটি জেলার উন্নয়নবঞ্চিত মানুষের অন্তহীন বেদনার কথা শুনবেন। শুনতে শুনতে, ভাবতে ভাবতে ঢাকায় ফিরে সুনামগঞ্জের সব জনপ্রতিনিধিকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নানা সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখুন। সুনামগঞ্জের মানুষের হৃদয়ে আপনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সুনামগঞ্জের সংসদ সদস্যরাও মানুষের হৃদয় জয় করতে পারবেন। অন্যথায় বানভাসি মানুষের চোখের জল মুছতে না মুছতেই নৌকাবাইচের উৎসব আপনাদের ইমেজকে সুরমা নদীতে তলিয়ে দেবে। মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই দেবে না। আপনিই বিবেচনা করুন এখন নৌকাবাইচ নাকি বন্যাদুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সংকট কাটিয়ে তারপর সবাইকে নিয়েই উৎসব, নাকি বানভাসিদের দুঃখ-যন্ত্রণা এড়িয়ে উৎসবের নৌকাবাইচ?