১. প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মনের কথাটি বলে ফেলেন। রাগঢাক ছাড়া অনেক নির্মোহ সত্য বলতে দ্বিধাও করেন না, আগপিছ ভাবেনও না। হাওরের আফালের দাপাদাপি আর অকাল বন্যার সঙ্গে কৃষক যেমন লড়াই করে দাঁড়ায় তেমনি ভাটির রাজনীতির এই বরপুত্রও বৈরী স্রোতের বিপরীতে পাথর কেটে কেটে আজকের এ জায়গায় উঠে এসেছেন। সম্প্রতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সিলেটে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমলা দিয়ে রাজনীতি হয় না। রাজনীতিটা রাজনীতিবিদ দিয়েই করতে হয়। একজন রাজনীতিবিদ প্রান্তিকের সাধারণ মানুষের সুখ, দুঃখ, অভাব, অভিযোগ, তাদের জীবনযাপন, ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্মা হয়ে হৃদয় নিসৃত ভালোবাসায় এক মায়ার বন্ধনে বেঁধে পথ চলেন। তাদের রাজনৈতিক জীবন গড়ে ওঠে মানুষের কল্যাণে, মানবতার স্লোগানে। আমাদের রাজনীতির স্বর্ণযুগ ছিল ষাটের দশক। এটিকে নবজাগরণের যুগ বলা যায়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে তার ঢেউ ছড়িয়েছিল সারা বাংলায়। পূর্ববাংলার নগর থেকে শহর, শহর থেকে গ্রামে সেদিনের পূর্ববাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সামনে রেখে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথে হাঁটতে হাঁটতে সত্তরের জাতীয় নির্বাচনে গণরায় নেওয়ার মধ্য দিয়ে একটি জাতিকে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে একসুতোয় বেঁধেছিলেন স্বাধীনতার মন্ত্রে। বাঙালির সামনে তখন স্বাধীনতা যুদ্ধ একটি সময়ের ব্যাপার। সেই উত্তাল দিনগুলো গণমানুষকে রাজনৈতিকভাবে যারা সংগঠিত করেছিলেন জাতীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত তাদের অনেকেই ইহকাল ত্যাগ করেছেন। আমাদের রাজনীতির গৌরবের সেই পূর্বসূরিরা সেদিন রাজনীতিকে ত্যাগের মহিমায় গণমানুষের স্বার্থ রক্ষায় লড়াই-সংগ্রামের এক উচ্চ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কৃষকের বন্ধু শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার মানুষের স্বার্থ রক্ষায় ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিলেন। তাদের ছায়ায় সেদিনের গণরাজনীতি ও ছাত্র রাজনীতি ঐতিহ্যের আলোয় আলোকিত হয়েছিল। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে তাদের নেতৃত্বে আদর্শবান কর্মীরা মূল্যবোধ ও আদর্শিক চেতনায় পথ হেঁটেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শেষ পর্যন্ত স্বাধিকার স্বাধীনতার পথে বাঙালি জাতির চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে লাখো শহীদের রক্তস্নাত লাল-সবুজের বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই পেয়েছিল।
২. সেই রাজনীতির উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে নানা সাফল্য-ব্যর্থতার সমালোচনা সয়ে এখনো যারা রাজনীতিতে পদচারণা করছেন, আমাদের রাজনীতিতে পিদিমের শেষ আলোটুকু জ্বালিয়ে রেখেছেন তারা ষাটের ছাত্র আন্দোলনের সৃষ্টি, মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত সন্তান। তাদের একজন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আজকের রাজনীতিতে আমলাদের নিয়ন্ত্রণ ও দাপট নিয়ে যে কথা বলেছেন তা এখন দেশের সব রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ভাষায়ই নয়, সাধারণ মানুষের মনের কথাও। সামরিক শাসকদের হাত ধরে পঁচাত্তরের রক্তাক্ত ও অভিশপ্ত পটপরিবর্তনের পর সামরিক-বেসামরিক আমলাদের রাজনীতিতে মাতুব্বরির সুযোগ ঘটেছিল। রাজনীতি করার অধিকার প্রতিটা নাগরিকের রয়েছে। কিন্তু তারও একটি পথ রয়েছে। সেটি হচ্ছে তৃণমূল থেকে সাংগঠনিক কাঠামোর ভেতর দিয়ে উঠে আসতে হয়। যেমন- মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানী ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে কলাবাগান আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য পদ লাভের মধ্য দিয়ে দলে ঠাঁই পেয়েছিলেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব দেখানোর পরও জায়গা হয়নি। রাজনীতিবিদদের হাতেই ছিল দল ও সরকারের নিয়ন্ত্রণ। বঙ্গবন্ধু ও তার নেপথ্য শলাপরামর্শের জন্য জাঁদরেল আমলা, অর্থনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে টিমওয়ার্ক রাখতেন। কিন্তু দল বা সরকারে তাদের দাপট দেখানোর সুযোগ কখনো করে দেননি। সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের জমানা থেকে সামরিক-বেসামরিক আমলাদের পাশাপাশি নানা পেশার মানুষ এসে রাজনীতি ও সরকারে ঠাঁই পেয়ে যান। ডাক্তারের হাতে তুলে দেওয়া হয় রাজনৈতিক দলের মহাসচিবের দায়িত্ব। সেই ধারা সেনাশাসক এরশাদ জমানা হয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার আমলেও প্রতিষ্ঠিত হয়। এরশাদ জমানায় রাজপথে ভঙ্গুর বিএনপি নিয়ে ছাত্রদল নির্ভর আন্দোলনে পড়ে থাকা বেগম খালেদা জিয়া তার ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে সিক্স ডিজিটের ল্যান্ডফোন থেকে তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন। '৯১ সালের নির্বাচনে আমলা আর পয়সাওয়ালা ভিড় করে মনোনয়ন নিয়ে গেলেন। পরবর্তীতে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও তাদের ঠাঁই হলো। বর্তমানে খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয় সাবেক আমলা ও সরকারি কর্মচারী আর ব্যবসায়ীদের দখলে। তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সম্পর্কের মাঝখানে একটি দেয়াল তারা তুলে দিয়েছেন। এই দেয়াল কর্মীদের গতিরোধ করে দিয়েছে।
৩. '৯৬ সালে খালেদা জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে মরহুম মেয়র মোহাম্মদ হানিফের জনতার মঞ্চ ঘিরে শেখ হাসিনার ডাকে যে গণজোয়ার তৈরি হয় তার সঙ্গে সচিবালয়ের লাল দেয়ালের ভেতর থেকে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তারা ছুটে আসার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রকে রাজনৈতিকভাবে দুটি ধারায় প্রকাশ্যে বিভক্ত করে দেন। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারে অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের সঙ্গে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাদের একটি আলাদা আবদার ও দাপটের জায়গা তৈরি হয়ে যায়। তবুও শেখ হাসিনার '৯৬ শাসনামল সাফল্য ও ব্যর্থতা মিলিয়ে যোগ করলে সাফল্যের পাল্লাই ছিল ভারী। দলের হাতেগোনা কয়েকজন উন্নাসিক গডফাদার ছাড়া ওই শাসনামল ছিল পরিচ্ছন্ন, গতিময় ও ছন্দবদ্ধ। সংসদ, প্রশাসন আর পল্টন তিন জায়গায় আওয়ামী লীগ ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বনির্ভর। রাজনীতিবিদদের হাতেই ছিল নিয়ন্ত্রণ। ছিল দাপট। আজকে খালেদা জিয়াকে যেভাবে আমলা-ব্যবসায়ীরা ঘিরে রেখেছেন তেমনি ২০০১ সালের বিপর্যয়ের পর শেখ হাসিনাকেও একটি চক্র ঘিরে রেখেছিলেন। রাজনীতিতে পদ-পদবি পাওয়া সেই ব্যবসায়ীরা দলের জন্য বা সরকারের জন্য পরবর্তীতে সুনাম নয়, দুর্নামই কুড়িয়েছেন। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার শাসনামলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের জায়গায় অদ্ভুত কায়দায় উপদেষ্টা নামে যেমন একদল আমলা ঠাঁই পান যাদের সুরঞ্জিতের ভাষায় 'ফসিল' বলা যায়। এই কঙ্কালসর্বস্ব অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের প্রভাব মন্ত্রিসভায়ও ছিল উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে সংখ্যা কমলেও এই ফসিল আমলাদের প্রভাব কমেনি। সরকারের অন্দরে-বাহিরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তাদের দোর্দণ্ড প্রতাপ চলছে। এদেরই একজন এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে জিয়াউর রহমানের আমলে কূটনৈতিক চাকরি নিয়ে বিদেশে ছিলেন। এরশাদের আমলে মন্ত্রী হয়েছিলেন। তারপরও পরিত্যক্ত, বাতিল এসব সাবেক বেসামরিক আমলাকে কুড়িয়ে এনে শেখ হাসিনা সংসদে ও সরকারে ঠাঁই দিয়েছিলেন। পাঁচটি বছর মন্ত্রী থাকার পরও দল আর সরকারের জন্য কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেননি। বয়সের ভারে স্মৃতিশক্তির অনেকটাই হারানো এ কে খন্দকারকে এবার মন্ত্রী না করায় তার নিজের কাছে নিজের ইজ্জত লুট হয়ে যায়। একটি অদৃশ্যশক্তি তার অন্তজ্বালার সুযোগটি কাজে লাগিয়ে হঠাৎ করে বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধ ও তার মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিতর্কিত করার নির্লজ্জ মিথ্যাচারের খোয়াবনামা '১৯৭১ : ভেতরে বাইরে' লিখিয়ে ফেলে। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুই ছিলেন একক নেতা। তার নির্দেশই শহীদ তাজউদ্দীনসহ দলের সিনিয়র নেতা এবং যুব ও ছাত্রনেতারা অনুসরণ করেছেন। তার পরিকল্পনা মাফিক ভারতে আশ্রয় ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সরকারের আশ্রয়, ট্রেনিং এবং অস্ত্র সহযোগিতায় যুদ্ধ শুরু হয়। সেই রণাঙ্গনের যুদ্ধের শক্তি ও অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এবার মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না পেয়ে এ কে খন্দকার জীবনের শেষ বেলায় কী নির্লজ্জ মিথ্যাচার করে বসলেন! মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান জেনারেল রব একবার সিলেটের প্রবীণ রাজনীতিবিদ মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজীর কাছে বলেছিলেন- এ কে খন্দকার অন্যদের মতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে বা প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেননি। উদ্ভূত পরিস্থিতি তাকে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পর এ কে খন্দকার বইখানি লিখে সেটিই প্রমাণ করেছেন। তিনি নিজেও লিখেছেন, ১৮ বছর পাকিস্তানে চাকরি জীবনে তিনি খুব আরাম-আয়েশেই ছিলেন। পূর্ববাংলায় কী হচ্ছে কিছুই জানতেন না। '৬৯ সালের ৪ মার্চ পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ঢাকা ঘাঁটিতে উইং কমান্ডার হিসেবে বদলি হয়ে আসেন।
৪. খুনি মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের পর এমনকি দুই দুজন সেনাশাসকের কাছে পুরস্কৃত হয়ে অবসরে যাওয়া বাতিল এ কে খন্দকারকে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা অনুকম্পা না দেখালে কালের কোনো অন্ধকারে হারিয়ে যেতেন যে খোঁজই পাওয়া যেত না। তাকে কুড়িয়ে এনে সংসদ ও মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেওয়ার প্রতিদান হিসেবে শেখ হাসিনার প্রতি জ্বালা মেটাতে গিয়ে জাতির ইতিহাসের প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার প্রতি এককথায় সংবিধানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করার সুযোগ পেয়েছেন। তার বই প্রকাশের পর সংসদে যখন স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতারা যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও আওয়ামী লীগের প্রতি বার বার আনুগত্য দেখিয়ে জেল-জুলুম-নির্যাতন সয়েছেন তারা ইতিহাস বিকৃতির এই দলিলকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী ও সাবেক আমলা আবুল মাল আবদুল মুহিত পরদিনই বলে বসেছেন, তিনি নিষিদ্ধের পক্ষে নন। সারা জীবন দাপটের সঙ্গে সরকারি আমলা হিসেবে জীবন উপভোগ করে সেনাশাসক এরশাদের অর্থমন্ত্রী হয়ে সুশীলের ঘরের মধ্যমণি হয়ে থাকা মানুষটির বুকের ভেতরে ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের প্রতি আবেগ ও দরদ থাকার কথা নয়, যা রয়েছে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার। এমনকি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর খুনিদের নির্মম নির্যাতনের শিকার বঙ্গবন্ধুর আদরের তোফায়েল আহমেদের। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সন্তান আমির হোসেন আমুর। ১৫ আগস্ট অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীসহ নিহত যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণির সহোদর শেখ ফজলুল করিম সেলিমের। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কেন্দ্রীয় কারাগারে রাতের অন্ধকারে নিহত জাতীয় নেতাদের সন্তান মোহাম্মদ নাসিম, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের যে দরদ রয়েছে। সারা জীবন আন্দোলন সংগ্রাম আর জেল, জুলুম, নির্যাতন সয়ে আসা লাখ লাখ নেতা-কর্মীর হৃদয়জুড়ে দল ও নেতৃত্বের প্রতি, বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শের প্রতি যে আবেগ-ভালোবাসা রয়েছে খুনি মোশতাকের শপথ পাঠের সঙ্গে জড়ানো ফসিল আমলাদের সেই দরদ থাকার কথা নয়। বিদেশিদের সঙ্গে গভীর সখ্যে জড়ানো এসব সাবেক আমলারা নিজেরটা যতটা ভাবেন, প্রভুদের সন্তুষ্ট করার কথা যত চিন্তা করেন দল আর মানুষের জন্য তা ভাবতে পারেন না। দল, কর্মী ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ তৈরির দীর্ঘ প্রক্রিয়া রাজনীতির কণ্টকাকীর্ণ পথেই তৈরি হয়। কর্মীদের নিয়ে মানুষদের নিয়ে ডালভাত ভাগাভাগি করে খাওয়ার সংস্কৃতি রাজনীতিবিদদের ঘরে পাওয়া যায়, আমলার ঘরে নয়। মানুষের মুখে মুখে এখন প্রশ্ন- এ কে খন্দকার যে ছুরি চালিয়েছেন তার পথ ধরে আগামীতে কারা হাঁটবেন? অর্থাৎ বাকি ফসিল আমলারা সামনে নতুন বই লিখছেন কিনা। লিখলে কী লিখবেন? সেখানেও নতুন বিতর্ক ও বেদনার ঝড় তৈরি হবে কিনা?
৫. রাজনীতিটা রাজনীতিবিদদের দিয়েই করতে হয়। আমলা দিয়ে রাজনীতি হয় না। আমলা দিয়ে ফাইল ওয়ার্ক হয়। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়। সুরঞ্জিত সেন কথাটা বলেছেন। কিন্তু এ কথাটি চক্ষুলজ্জা বা স্বভাবসুলভ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ঊনসত্তরের অগ্নিপুরুষ বিনয়ী তোফায়েল আহমেদ বলছেন না। কিন্তু তাকেও যদি প্রশ্ন করা হয়- অন্তরাত্মা কী বলে? নিশ্চয়ই বলবেন, সাবেক আমলাদের দাপট ও প্রভাব ক্ষতির পাল্লা ভারী করেছে। পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমুকে একান্তে জিজ্ঞাসা করলে প্রধানমন্ত্রীকে এদের বিদায় করারই পরামর্শ দেবেন। এমনকি শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিমদের মনের ভাষাও ভিন্ন হবে না। আওয়ামী লীগ কর্মী ও দলটি সম্পর্কে ফসিল আমলাদের কেউ কেউ নাক উঁচা ভাব নিয়ে চলেন। অথচ দলটির ওপর ভর করে ক্ষমতাটা ভোগ করেন। একজন আমলা বোঝেন ক্ষমতা, আর একজন রাজনীতিবিদ বোঝেন মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা। কর্মীর প্রতি মমত্ববোধ। কারণ তাদের মানুষের কাছে যেতে হয়। দরজা খুললেই কর্মীর চেহারা দেখতে হয়।
৬. ভারতের সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের এমন শোচনীয় পরাজয় অতীতে দুনিয়া দেখেনি। ভারতবাসীই নয়, বিশ্ববাসী চমকে গেছে। ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো জড়ানো কংগ্রেসের পরাজয় দেখে। সেদিন গান্ধী পরিবারের অন্ধভক্ত অঙ্ফোর্ডের পণ্ডিত ড. মনমোহন সিংকে ভারত শাসনের দায়িত্ব না দিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে যদি বসানো হতো আর তৃণমূল রাজনীতি থেকে উঠে আসা সব দলে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা প্রণব মুখার্জিকে যদি সেদিন প্রধানমন্ত্রী করা হতো তাহলে আর যাই হোক এমন ভরাডুবি তো হতোই না, হয়তো টাইটাই করে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারত। কারণ কংগ্রেস সরকার যেসব বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছিল জনগণের কাছে তার সন্তোষজনক সমাধান মনমোহন দিতে পারেননি। প্রণব মুখার্জি সেটি দিতে পারতেন এবং সোনিয়া গান্ধী ও রাহুলকেও বোঝাতে পারতেন। মনমোহন অনেক ক্ষেত্রে রাহুল গান্ধীর মুখোমুখি হতে পারেননি অভিভাবকত্ব নিয়ে। শেখ হাসিনার আগের সরকারে অনভিজ্ঞ নবীন মন্ত্রীদের ধূসর করে দিয়ে সাবেক আমলারা দোর্দণ্ড প্রতাপশালী হয়ে উঠেছিলেন। অনেক সমস্যার সমাধান তাৎক্ষণিক দিতে পারেননি। একদিকে আমলা, অন্যদিকে হাইব্রিড মিলে ব্রুট মেজরিটি নিয়ে আসা সরকারকে দেশ-বিদেশে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। শেখ হাসিনার পাশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব পর্দার সামনে আসে বিগত নির্বাচনকালীন সংকটময় মুহূর্তে। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলেও শেখ হাসিনা রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হন।
৭. শেখ হাসিনার উপদেষ্টাদের মধ্যে একজন উপদেষ্টা আছেন যিনি একুশের গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনার জীবন রক্ষায় অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি যে দায়িত্ব পেয়েছেন সেটি দক্ষতার সঙ্গে পালন করছেন। বাদ বাকিদের অবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশাসন লেজেগোবরে অবস্থায় ফেলা হয়েছিল। আমলা ও হাইব্রিড নির্ভরতার কারণে ব্যাংকিং খাত থেকে অর্থনৈতিক খাত নাজুক অবস্থায় চলে গিয়েছিল। গার্মেন্ট খাত নিয়ে লড়ার মতো নেতৃত্বই সেদিন দাঁড়ায়নি। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, শিল্প কল-কারখানা রক্ষা, আবাসন খাতের সংকট নিরসন দূরে থাক আরও বেশি ঘনীভূত করা হয়েছিল। এই সরকারে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, মোহাম্মদ নাসিমের মতো রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঠাঁই পাওয়ায় সরকার এখন অনেকটা চাঙ্গা। সরকার ব্যবসাবান্ধব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জমে থাকা সংকটের সমাধান করছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেন-দরবার পুরোদস্তুর চালিয়েছেন আমাদের গার্মেন্ট খাতের জিএসপি সুবিধা আদায়সহ স্বার্থ রক্ষায়। বিগত রমজানে বাজার ছিল নিয়ন্ত্রণে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে এসে অর্থহীন টাকা খরচের বিদেশ সফর বাতিল করায় অনেকেই নাখোশ। কিন্তু রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার কারণে দেশের পরিবেশের উন্নয়নে বিদেশি তহবিল জোগাড়ে নীরবে ঠিক কাজটি করে যাচ্ছেন। এ জন্য ঢোলবাদ্য বাজিয়ে হামেশা দলবল নিয়ে বিদেশ সফর করতে হয় না। যোগাযোগমন্ত্রী থাকাকালেও জাপানের প্রধানমন্ত্রীসহ বিশ্বব্যাংকের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে বৈঠক করে কাজ বাগিয়েছিলেন। বিশাল আবাসন খাতের সঙ্গে জড়ানো হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ সুরক্ষায় সিনিয়র মন্ত্রীরা রাজনীতির অভিজ্ঞতা থেকে একযোগে কাজ করছেন। তাদের সঙ্গে আগের সরকারের ওবায়দুল কাদের তো রয়েছেনই, এমনকি গ্রামীণ রাজনীতি থেকে উঠে আসা মুজিবুল হকও সাফল্য দেখিয়েছেন। সাবেক আমলাদের দাপট কিছুটা কমলেও এখনো শেষ হয়নি। অর্থমন্ত্রীর দক্ষতা ও সততা আড়ালে পড়ে গেছে তার অতিকথনে। সম্প্রতি বন্যাদুর্গত এলাকায় মানুষ যখন তাদের ফসলি জমির তলিয়ে যাওয়া বীজতলা, ভেঙে যাওয়া ঘরবাড়ি মেরামতে ত্রাণ সাহায্য চাচ্ছিল তখন সাবেক আমলা-মন্ত্রীরা নৌকাবাইচের আয়োজন করেছিলেন। শেখ হাসিনা রাজনীতির দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েই আসেননি, একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবার ও প্রাচীনতম দলের নেতৃত্বে অভিষিক্ত হয়েই এসেছেন। মানুষের অনুভূতি-আবেগ উপলব্ধি করার কারণেই নৌকাবাইচ বন্ধ করেন। তারপরও একটি উপজেলায় বিএনপির উপজেলা চেয়ারম্যানকে নিয়ে হাইব্রিড আওয়ামী এমপি নৌকাবাইচ করেছেন। সংস্থাপন সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীকে পেশার তারে জড়ানো জীবনের শুরু থেকেই চিনি। মেধাবী, দক্ষ, সৎ ও আপাদমস্তক কবি এই সরকারি আমলার সুনাম চারদিকে। তার একটি গণমুখী চরিত্র রয়েছে। নিরহংকারী এ মানুষটি ছাত্রলীগের মহাদুর্দিনে ভূমিকা রেখেছেন। এ ধরনের আমলা যারা ছাত্র রাজনীতির দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসেন তারাই কেবল রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যুক্ত হলে মানুষের কল্যাণের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারেন। অতীত যাদের নীতিহীনতার পথে ভ্রষ্ট হয়েছে, সুবিধাবাদিতায় চিহ্নিত হয়েছে তারা উচ্চশিক্ষিত সিএসপি আমলা হিসেবে অবসর জীবনে রাজনীতিতে উপর থেকে ঠাঁই নিয়ে ক্ষমতার বৃত্তে বন্দী থাকেন। মানুষের ভাষা শুনতে পান না। কর্মীদের ভাষা জানেন না। দলের প্রতিও আনুগত্য রাখেন না। ক্ষমতাটা ভোগ করে যান শুধু। মাঝখানে তাদের ব্যর্থতার বোঝা টানে দলের লাখ লাখ কর্মী। তাদের দায়িত্বহীনতা এবং গণমানুষের ভাষা না বোঝার ক্ষমতার খেসারত দেয় দল। তাই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যেটি বলেছেন সেটি দলীয় নেতাদের ভাষাই নয়, কর্মীর ভাষাই নয়, মানুষের ভাষা। এখনই এসব বয়সের ভারে ন্যুব্জ ক্ষমতাভোগী আমলাদের দূরে না সরালে গণমুখী রাজনীতিতে সরকার ও দলকে পদে পদে হোঁচট খেতে হবে। তারা ফের অবসরে যাবেন। বিপর্যয়ে পতিত দলকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। কী সরকার, কী বিরোধী দল উভয়কেই আজকের দিনে গণমানুষের কল্যাণে রাজনীতিকে সামনের দিকে টানতে হলে, মানুষের আস্থা অর্জনের পথে নিতে হলে এদের সরিয়ে রাজনীতিবিদদেরই আস্থা, বিশ্বাস ও দায়িত্বের জায়গায় সামনে দিতে হবে। এমনকি মন্ত্রী আর দলই নয়, করুণার বশবর্তী হয়ে সরকারের ওপর মহল থেকে নানা জায়গায় দায়িত্বশীল পদে রাজনৈতিক নিয়োগের ক্ষেত্রে আজ্ঞাবহ অযোগ্যদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। এসব জায়গায় দক্ষতার বিকল্প নেই। সুরঞ্জিতকে একা বললেই হবে না, জীবনের পড়ন্ত বেলায় বর্ণাঢ্য অতীত সামনে রেখে আমু-তোফায়েল-সেলিমদেরও বিনয়ের পর্দা সরিয়ে এসব কথা প্রকাশ্যে না হোক প্রধানমন্ত্রীকে অন্তত বলতে হবে। এ কে খন্দকারের বই নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে সাবেক আমলা অর্থমন্ত্রী মুহিত সংসদেও বলতে পারতেন, প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিতে পারতেন, বাইরে বলার মধ্য দিয়ে মানুষের আবেগ-অনুভূতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। দলীয় কর্মীদের মতামতের বিরুদ্ধে তো বটেই। এখানেই রাজনীতিবিদ ও আমলাদের পার্থক্য। রাজনীতিবিদরা দল, মানুষ ও দেশের স্বার্থ সামনে রেখে কথা বলেন। আমলারা যা বলেন তার নেপথ্যে কী এক অদৃশ্য যোগসূত্র থেকে যায়!
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।