১. বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নানা জায়গায় দেখা হয়। কথা হয়। মামলায় মামলায় জর্জরিত নেতা-কর্মীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বইছে। এ রক্তক্ষরণ যতটা না তাদের প্রতি সরকারের দমন, নির্যাতন ও মনোভাবের কারণে তার চেয়ে বেশি নিজেরা সুসংগঠিত হয়ে দাঁড়াতে না পারার ব্যর্থতায়। সবচেয়ে বেশি দহন হচ্ছে দলের সেই প্রাণশক্তি যারা সেনাশাসক এরশাদ জমানায় ভঙ্গুর, বিধ্বস্ত বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আন্দোলন সংগ্রামে মাথার মুকুট করে নিরন্তর সংগ্রাম করেছিলেন সেই ছাত্রদল করে উঠে আসা নেতা-কর্মীদের বুকের ভিতর। চাপা কান্না, কষ্ট গ্রাস করেছে নেতা-কর্মীদের। সেই ছাত্রদল করে উঠে আসা নেতা-কর্মীদের অংশটি এখন মাঠের বিএনপির নেতৃত্বে। এরশাদ জমানায় অকাল-বৈধব্যের শ্বেতশুভ্র শাড়ি পরিহিতা রাজনীতিতে একেবারেই অনভিজ্ঞ বেগম খালেদা জিয়া শিক্ষাঙ্গন-নির্ভর শক্তিশালী তারুণ্যের ছাত্রদলের ওপর ভর করেই সাতটি বছর আন্দোলন করেছিলেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে গণরায় নিয়ে ক্ষমতায় এসে চমকে দিয়েছিলেন। সেই সময় নানা দফা ভাঙনে বিএনপি নামের ক্ষমতাচ্যুত দলটির জাতীয় পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতারা যোগ দিয়েছিলেন এরশাদ সরকারের সঙ্গে। তবুও শুধু ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের উঠে আসা শক্তির ওপর আন্দোলনে পথ হেঁটেছিলেন খালেদা জিয়। সেই সময়কার কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের ছাত্রদল নেতৃত্বই আজকের বিএনপির মূল শক্তি। আজ ছাত্রদল বলতে কোনো শক্তি বিএনপির জন্য মাঠে দৃশ্যমান নয়। অছাত্রদের এমন এক সংগঠন ছাত্রদল যার কোনো আকর্ষণও নেই। কিন্তু জিয়াউর রহমানের বিএনপি ছিল দলছুটদের এক মিলনমেলা। সেখানে অনেক নবাগতের সঙ্গে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে মিলিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগবিদ্বেষী ’৭১-এর পরিত্যক্ত মুসলিম লীগ আর চীনপন্থি ন্যাপের দলছুট নেতারা। কিন্তু খালেদা জিয়ার বিএনপি দাঁড়িয়েছিল দলের প্রতি অনুগত, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের প্রতি আবেগাপ্লুত ছাত্রদলের ওপর ভর করে। সেই ছাত্রদল থেকে ইতিমধ্যে সারা দেশে অনেকে মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন। কেন্দ্র থেকে দলের তৃণমূল নেতৃত্বে ঠাঁই পেয়েছেন। জিয়াউর রহমান একজন সেনাশাসক হিসেবে আদর্শচ্যুত অতি ডান, অতি বামদের নিয়ে ক্ষমতায় এসে বিএনপি গঠন করলেও বেগম খালেদা জিয়া রাজপথ থেকে একজন গণতান্ত্রিক নেত্রী হিসেবে ভঙ্গুর বিএনপিকে পুনর্গঠন করে আন্দোলনের পথ পাড়ি দিয়ে ‘৯১ সালে গণরায় নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। এরশাদ জমানায় সেনাশাসকের দক্ষিণহস্ত জেনারেল চিশতী যিনি বঙ্গভবনে প্রবেশ করলে অনেকের সঙ্গে তাদের চেয়ারও দাঁড়িয়ে যেত তিনি বিএনপিকে মুছে দিতে চেয়েছিলেন। বিএনপি ভাঙার নেপথ্য কারিগর জেনারেল চিশতীর হম্বিতম্বি দেখে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে এক বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আবদুস সামাদ আজাদ বলেছিলেন, ‘বিএনপিকে শেষ করা যাবে না। বেগম সাহেবার আঁচলেই আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তি বাঁধা থাকবে।’ ‘৯১ সালের নির্বাচনে অনেকে নিশ্চিত ছিলেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসছে। কিন্তু এরশাদ ও তার জাতীয় পার্টির জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নির্বাচনে না দিয়ে অতি আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগ দাবার চালে ভুল করেছিল। গণতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে ’৯১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় নিশ্চিত করেছিল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে আসা বিএনপি। অনেকে বলাবলি করেন, বর্তমানে বিএনপি যে পরিস্থিতির মুখোমুখি একই সঙ্গে জীবনের পড়ন্ত বেলায় বেগম খালেদা জিয়ার মাথার ওপর ঝুলন্ত দণ্ডের খড়গ, নির্বাসিত পুত্রদের অবস্থা আর মামলায় মামলায় জড়ানো দলটির পরিণতি করুণ থেকে করুণতর হবে। এমনকি সেদিনও যারা বিএনপিকে ক্ষমতার পাদপ্রদীপে দেখতেন তারাও বলছেন বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটির চ্যাপ্টার আপাতত ক্লোজড। কিন্তু আসলে কি তাই? সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামত আজ হোক, কাল হোক, পরশু হোক রাজনীতির মঞ্চে বিএনপিরই প্রত্যাবর্তন ঘটবে যদি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অব্যাহত থাকে। কারণ, এ দেশে বিকল্প বাম শক্তির সম্ভাবনা যেমন বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে তেমনি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি। তবে বিএনপিকে দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ পথে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েই তা অর্জন করতে হবে।
২. দুই দুই বার গণরায়ে ক্ষমতায় অভিষিক্ত খালেদা জিয়ার বিএনপি এখন রীতিমতো চোখে শর্ষে ফুল দেখছে। বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের বিরুদ্ধেই ২৭টি মামলা রয়েছে। কোনো কোনো মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা খালেদা ও তার পুত্র তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এখন বিচারাধীন। শুধু খালেদা পরিবারই নয়, গোটা বিএনপিই এখন উদ্বিগ্ন। একুশের গ্রেনেড হামলার মামলায় তারেক রহমানের নাম সম্পূরক চার্জশিটে চলে এসেছে। খালেদা জিয়ার নামও আসি আসি করছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৬৩টি মামলার ১৫টিতেই চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। শতাধিক মামলা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে রয়েছে। এহছানুল হক মিলন প্রায় হাফ সেঞ্চুরির কোটায় এসে থমকে দাঁড়িয়েছেন। নাটোরের অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর অবস্থাও তাই। আমানউল্লাহ আমানসহ যেদিকেই তাকানো যায় সেদিকেই মাথার ওপর মামলার পাহাড়। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মতো অভিজ্ঞ সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্যের গুলশানের বসতভিটা নিয়ে টানাটানি চলছে। লাখের ওপরে মামলার জালে সারা দেশের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু বিএনপিকে যেভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় টেনে নেওয়ার কথা ছিল বৈরী স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সেভাবে টানতে পারেনি নেতৃত্ব। বিএনপি শাসনামলের পাপের বোঝায় ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে শোচনীয় ভরাডুবির আগেই ওয়ান-ইলেভেনের দুই বছরে দলটির সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে যায়। কিন্তু ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর সংসদে আসন যা-ই থাকুক না কেন, বিএনপি রাজনৈতিকভাবে পথ হাঁটতে পারেনি। এমনকি সংসদ বর্জন দলের জন্য ক্ষতি বয়ে আনা ছাড়া লাভের মুখ দেখায়নি। রাজপথে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতকে নিয়ে নামতে গিয়ে বিতর্কের মুখেই পড়েনি, দমন-নির্যাতনের অগ্নিরোষে পতিত বিএনপি হোঁচট খেয়েছে বারবার। হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরের সমাবেশের প্রতি খালেদা জিয়ার আকস্মিক এক রাতের অকুণ্ঠ সমর্থন শেষ পর্যন্ত চরম হঠকারিতায় পরিণত হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের নেপথ্যে খালেদা জিয়ার ওপর যারা ভর করেছিলেন তাদের আর পরে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি বিশ্বায়নের এই রাজনীতিতে পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের রাষ্ট্রপতি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরকালে কাদের ইঙ্গিতে ও পরামর্শে খালেদা জিয়া বৈঠকসূচি বাতিল করে সর্বনাশা পথে পা বাড়িয়েছিলেন, তা আজও খোলাসা হয়নি। খেসারত তার এখনো দিতে হচ্ছে। শুধু হঠকারিতানির্ভর বিভ্রান্তির রাজনীতিতে বিএনপির পথচলার এখানেই শেষ নয়।
৩. একটানা পাঁচ পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির বিস্ময়কর বিজয় দুনিয়াকে জানিয়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ জোট সরকারের আমলেও নানা কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ জনগণ বিকল্প শক্তি হিসেবে বিএনপির দিকেই ঝুঁকেছে। কিন্তু জনমত পক্ষে জানার পরও খালেদা জিয়া যেমন নির্বাচনমুখী দলকে সামনের পথে টেনে না নিয়ে পেছনে হেঁটেছেন, তেমনি লন্ডনে নির্বাসিত তারেক রহমানও হিসাবের অঙ্কে ভুল করে বসেছেন। একটি নির্বাচনমুখী দল বিএনপিকে ভোটের ময়দান থেকে টেনে নিয়ে জামায়াত-শিবিরের সহিংস হরতাল-অবরোধের উগ্র নাশকতার রাজনীতির পাল্লায় তুলে দিয়ে নির্বাচনী ট্রেনটি মিস করে বসেছেন। শেখ হাসিনার গণভবনের আমন্ত্রণ, অন্তর্বর্র্তী সরকারের পছন্দসই মন্ত্রণালয়সহ ১০টি মন্ত্রণালয় গ্রহণ না করার খেসারত বড় আকারেই দিতে হয়েছে। বিএনপি নামের দলটির নেতা-কর্মীদের চোখেমুখে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে বিষাদের ছায়া। দলের অভ্যন্তরে প্রশ্ন উঠেছে, কারা এ সর্বনাশা পরামর্শ দিয়েছিলেন। যে খালেদা জিয়া ছাত্রদলের মাঠকর্মীদের, বিএনপির পোড় খাওয়া মাঠনেতাদের এরশাদ জমানায় টেলিফোন করতেন সেই নেত্রীকে এখন মাঠের নেতাদের কাছ থেকে নক্ষত্রের দূরত্বে রাখা হয়েছে। কারা রেখেছেন? যারা রেখেছেন তাদের নাম ক্ষোভ আর হতাশার সুরে মাঠকর্মীদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। অভিযোগ রয়েছে, এসব গণবিচ্ছিন্ন সাবেক আমলা গুলশান বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়কে করপোরেট হাউসে পরিণত করেছেন। অন্যদিকে পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে করে ফেলেছেন গুরুত্বহীন। রাজনৈতিক সব সিদ্ধান্ত গুলশান কার্যালয়ে বসে নাইটক্লাবের মতো রাত গভীরে ছুটে আসা আমলারা গ্রহণ করছেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেখানে তাহাজ্জুদ ও ফজরের নামাজ আদায়ের পর সাতসকালে কাজ শুরু করেন, রাজনীতির দাবার চাল দেন সেখানে বিএনপি নেতৃত্বকে ভাবতে তার গুলশান কার্যালয় খুলতে হয় গভীর রাতে। অর্থাৎ রোজকার রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেই তো বিএনপি নেতৃত্ব ১৭-১৮ ঘণ্টা পিছিয়ে আছে তার প্রধান প্রতিপক্ষ থেকে। মাঠনেতাদের, কর্মীদের সঙ্গে তাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার কালেভদ্রেও দেখা হয় না। এমনকি দলের স্থায়ী কমিটির অনেক নেতাকেও দেখা করতে হলে নানা বাধা অতিক্রম করে পৌঁছাতে হয়। ৩৮৬ সদস্যের নির্বাহী কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতারাই বিএনপি রাজনীতির প্রাণভোমর। কিন্তু তাদের সঙ্গেও দুই মাস, তিন মাসে একান্তে কথা বলা দূরে থাক, মুখদর্শন পর্যন্ত হয় না। বিএনপির অনেকেই বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে গণভবনে বসে মাঠকর্মীদের দর্শন দেন। বিরোধী দলে গেলে সুধাসদনের দরজা খুলে রাখেন কর্মীদের জন্য। সেখানে এত বড় রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মুখেও সাধারণ কর্মীরা দূরে থাক, বিএনপির ডজন ডজন মামলার শিকার, জেল খাটা নেতাদেরও খালেদা জিয়া মুক্তিলাভের পর ডেকে নিয়ে একান্তে কথা বলেন না। বিএনপির ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটি আর ৩৮৬ সদস্যের নির্বাহী কমিটির সঙ্গে জেলা নেতারা অবাক বিস্ময়ে দেখেন কীভাবে খালেদা জিয়ার মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচিতে রাজধানীতে আসা তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা আশ্রয় দূরে থাক সহানুভূতি জানানোর মতো কাউকেও খুঁজে পান না।
৪. আলোচনা হচ্ছে কর্মসূচি কার্যত ক্ষমতার মোহে খালেদা জিয়াকে চার দেয়ালের ভিতর বন্দী করে রাখা অরাজনৈতিক আমলারা গ্রহণ করে থাকেন। অন্তহীন বেদনার সঙ্গে নেতারা সেই বার্তা বহন করে কখনো নিজেরা কখনো বা কর্মীদের মাঠে নামান। গণমাধ্যমে প্রকাশের পর এসব কর্মসূচিতে মাঠে নামা কর্মীরা পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। কোথাও মামলা খান, কোথাও বা জেল খাটেন। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই মহা দুর্দিনে নেতারা মোবাইল ফোন নিয়ে যেতে পারেন না। এমন কুপরামর্শ এসব বর্ণচোরা সুবিধাভোগী আমলাই দিয়ে এসেছেন। এত বড় দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের প্রতি খালেদা জিয়াকে সন্দিহান করে তোলা হয়। হতাশাক্ষুব্ধ দলের নেতা-কর্মীরা লক্ষ্য করেন খালেদা জিয়া যা বলছেন অনেক সময় তার সঙ্গে লন্ডনে নির্বাসিত তারেক রহমানের বক্তব্যের কোনো তাল লয় ছন্দ নেই। সেখানেও অদক্ষ দলবিচ্ছিন্ন ক্ষমতার বেনিফিশিয়ারিরা তারেক রহমানকে ঘিরে আছেন। এ ছাড়া দলের একটি অংশ যেমন এখনো খালেদা জিয়াই শেষ কথা মনে করেন তেমনি আরেক অংশ তারেক রহমানই এই সময়ের বিকল্প মনে করেন। তেজগাঁও এলাকায় একটি দলকানা দৈনিকের অফিসে বসে তারেক রহমানের সঙ্গে তাদের যোগসূত্রের দোহাই দিয়ে এমন করে কথা বলেন যে, তাদের সিনিয়র নেতাদের সমীহ করতে হয়। মহানগর বিএনপিতে নতুন কমিটি ঘোষণা হলেও বিএনপির জন্য এখনো ইতিবাচক কিছু ঘটেনি। এদিকে ২০-দলীয় জোট কার্যত নামসর্বস্ব, প্যাডসর্বস্ব। কুড়ি দলে কারা আছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতারাও ঠিকমতো বলতে পারেন না।
৫. গুলশান দলীয় কার্যালয়ে নির্দিষ্ট বৃত্তের ভিতরে খালেদা জিয়াকে আটকে রাখা গণবিচ্ছিন্ন আমলারা অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক দিয়ে ব্যস্ত রাখলেও দলের ত্যাগী নেতারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ফিরে যান। দেখা আর হয় না। কেউ কেউ বলেন, বিশেষ করে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর গুলশান কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফ্যাশনে, চলনে-বলনে এমন ভাব নেন যে বিএনপি যেন ক্ষমতায় এসে গেছে। এই চেহারার এখনো পরিবর্তন হয়নি। এদের আচরণ মাঠকর্মীদের যন্ত্রণার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এত এত বিপর্যয়ের পর বাস্তবতা হচ্ছে খালেদা জিয়ার নিজের যেমন বয়স হয়েছে তেমনি শারীরিক নানা অসুস্থতাও দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে নির্বাসিত পুত্রদের মাথার ওপরও নানা দণ্ডের খড়গ ঝুলছে। বিএনপিকে যে পরিবর্তিত পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে দলের নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করার মাধ্যমে জনগণের মতামতকে পক্ষে টেনে গণতান্ত্রিক ধারায় সামনে অগ্রসর হতে হবে সেই গ্রহণযোগ্য রোডম্যাপ এখনো কর্মীদের সামনে আসছে না। আন্দোলনের হাঁকডাক আর ছিটেফোঁটা কর্মসূচি দেওয়া হলেও মাঠ নেতা-কর্মীদের কোনো আগ্রহ কুড়াচ্ছে না। বিএনপি রাজনীতির দুর্গ বলে খ্যাত ঢাকায় দলের অবস্থা অপরিবর্তিতই নয়, রীতিমতো করুণ। দলের অনেকে মামলা আর জেল নিয়ে ব্যস্ত, আর যারা টাকা কামিয়েছিলেন তারা সেই যক্ষের ধন রক্ষায় নানা মহলে যোগাযোগ চালিয়ে যেতেই তৎপর।
৬. দেশের মানুষের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব থাকলেও জাতির শোকাবহ দিন ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিনের কেক কাটা উৎসবের সমালোচনায় ছিল মুখর। কিন্তু এক অদৃশ্য শক্তি আর দলকানা মোসাহেবদের আজ্ঞাবহতার কারণে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এত বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে পথ হাঁটলেও সমালোচনার তীরে ক্ষত-বিক্ষত ১৫ আগস্ট জন্মদিনের কেক কাটার উৎসব বন্ধ হয়নি। এমনকি যুদ্ধাপরাধের অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতকে ছেড়ে রাজনীতিতে পথ হাঁটা বিএনপির এখনো শুরু হয়নি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি আওয়ামী লীগ সেনাশাসনামলেও উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ’৭৮ ও ’৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। ’৭৯ ও ’৮৬-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়েছে। বৈরী স্রোতের বিপরীতে অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে একুশটি বছর আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে পথ হেঁটেছে। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা কখনো এত বড় দীর্ঘ স্বাধিকার স্বাধীনতার সংগ্রাম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে করলেও বিদেশি কূটনীতিকদের প্রতি নয়, আস্থার জায়গায় দেশের জনগণকেই রেখেছেন। আওয়ামী লীগও এ একুশটি বছর জনগণের মতামতকে পক্ষে নিয়ে লক্ষ্য অর্জনের কঠিন সংগ্রাম করে গেছে। কিন্তু, খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের সেদিনের সরকারি চাকরিজীবীরা রীতিমতো এখনো দিবাস্বপ্ন দেখছেন। পশ্চিমাসহ দেশে-বিদেশে নানা মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, উঠবস করছেন। যেন আলাদিনের চেরাগের দৈত্যের মতো বিদেশি প্রভুরা আসবেন আর নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবেন। এ ধরনের আভাস-ইঙ্গিত যেমন নিজেরা বিনিময় করছেন তেমনি অন্যদেরও দিচ্ছেন। কেউ কেউ বলেন, এসব মূর্খ আমলার আশার বাণী শুনে কোন সুদূরের দিকে তাকিয়ে খালেদা জিয়া তার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সংগ্রামমুখর দিনগুলো ভুলে গিয়ে আশায় আশায় পথ গুনছেন। অন্যদিকে লন্ডনে বসে তারেক রহমান ইতিহাস নিয়ে অদ্ভুত সব কথাবার্তা বলে হাস্যরস তৈরি করছেন। এমনকি সব মহলে গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ভারমুক্ত তো করছেনই না, উল্টো তাকে নাকি সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সর্বত্র বলাবলি ইতিহাস থেকে শিখে খালেদা জিয়াকে এসব গণবিচ্ছিন্ন আমলার বৃত্তের বাইরে এসে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে জনগণের দুয়ারে দুয়ারেই যেতে হবে। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও হঠকারী পথ নিলে ব্যর্থ বিপ্লবের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করে জনসমর্থন সঙ্গে নিয়ে আগামী দিনের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়াই হবে উত্তম। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এমনকি সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনও হতে পারে। কিন্তু তা কখনোই হরতাল, অবরোধ, ঘেরাওয়ের মতো সহিংস কর্মসূচির মাধ্যমে নয়। শান্তিপূর্ণ পথেই ধৈর্য নিয়ে হাঁটতে হবে বিএনপিকে। আর খালেদা জিয়াকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে সাবেক আমলানির্ভরতা কাটিয়ে কর্মীনির্ভর হয়ে উঠবেন। বিদেশনির্ভরতা কাটিয়ে মানুষের প্রতি আস্থাশীল হবেন। সহিংস পথ ছেড়ে শান্তিপূর্ণ পথে লক্ষ্য অর্জনের দিকেই অগ্রসর হবেন। আর ইতিহাসের মীমাংসিত সত্যকে গ্রহণ করেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের রাজনীতিই হবে সেই পথের চেতনা। এ মুহূর্তে খালেদা জিয়া কি আমলানির্ভর গুলশানের করপোরেট অফিসের বৃত্ত ভাঙতে পারবেন? এটাই আজ নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তর তাকেই খুঁজে বের করে সমাধান দিতে হবে।
বি. দ্র. : এরশাদ জমানায়ও সিলেট বিভাগে বিএনপি বলতে কিছু ছিল না। সুনামগঞ্জে নাদের, রেজাউল, শওকত, সেলিমরা হাতে গোনা কয়েকজন ছাত্রদল কর্মী আর বিএনপির পড়ে থাকা ওয়াকিবুর রহমান গিলমানসহ কয়েকজন ছিলেন চোখে পড়ার মতো। স্থানীয় রাজনীতিতে তাদের অনেকে গুনতেনও না। এখন জেলা সদরে বিএনপির তিনটি গ্রুপ। ’৯১ সালের নির্বাচনে সিলেট বিভাগে মাত্র সিলেট সদর আসনটি মরহুম খন্দকার আবদুল মালিক বিজয়ের বরমাল্য পরে খালেদা জিয়াকে উপহার দিয়েছিলেন। মরহুম সাইফুর রহমানের মতো নেতারও জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। সিলেট বিভাগে বিএনপি এখন অনেক শক্তিশালী। সিলেট সিটি মেয়রও বিএনপির। ইলিয়াস আলীর মতো নেতা ফিরে আসেননি। এ নিয়ে টুঁশব্দ নেই। বিএনপি যেন এক ঝড়ে পড়া পাখি। কেন? উত্তর কি কখনো খুঁজেছেন?
শিরোনাম
- শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠাই হবে মে দিবসের অঙ্গীকার : শিমুল বিশ্বাস
- লিবিয়া থেকে কাল দেশে ফিরছেন ১৭৭ বাংলাদেশি
- চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ ত্বরান্বিত করতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
- প্রাক-প্রাথমিকে ১৫০০ বিদ্যালয়ে স্মার্ট টিভি-ল্যাপটপ দেবে সরকার
- জ্বালানি তেলের নতুন দাম নির্ধারণ
- দাবানলে জ্বলছে ইসরায়েল, হন্য হয়ে পালাচ্ছেন বাসিন্দারা
- দেশব্যাপী শব্দদূষণবিরোধী অভিযানে ২৬৫ হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ
- তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে তুরস্কের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ
- পুঁজিবাজারে সূচক কমলেও লেনদেন বেড়েছে
- গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু নেই, হাসপাতালে ভর্তি ২৯
- দেশের রিজার্ভ বেড়ে ২৭ বিলিয়ন ডলার
- মুহুর্মুহু রকেট হামলায় বিপর্যস্ত মার্কিন রণতরী, বাধ্য হলো পিছু হটতে
- ছাত্রলীগের নির্যাতনের সহযোগী শিক্ষক-কর্মকর্তার বিচারের দাবিতে ঢাবি ছাত্রদলের বিক্ষোভ
- মিরাজের ঘূর্ণিতে তিনদিনেই জিতল বাংলাদেশ
- প্রিপেইড গ্যাস মিটার নিয়ে প্রতারণা এড়াতে তিতাসের সতর্কবার্তা
- শিল্পীদের মেধাসম্পদ সংরক্ষণে কাজ করছে সরকার : শিল্প উপদেষ্টা
- সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
- ১১৯তম প্রাইজ বন্ডের ড্র, প্রথম বিজয়ী নম্বর ০২৬৪২৫৫
- রাজধানীর উত্তরায় ঢাবির বাসে হামলা, গ্রেফতার ৫
- প্রথম আলোর বিরুদ্ধে মামলার আবেদনকারীকে হুমকির অভিযোগ
পর্যবেক্ষণ
খালেদা জিয়া কি আমলানির্ভর গুলশান করপোরেট অফিসের বৃত্ত ভাঙবেন?
পীর হাবিবুর রহমান
অনলাইন ভার্সন

এই বিভাগের আরও খবর
সর্বশেষ খবর

চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ ত্বরান্বিত করতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
২৪ মিনিট আগে | জাতীয়

সাবেক সংসদ সদস্য শাহরিন ইসলাম তুহিনের মুক্তির দাবিতে নীলফামারীতে আইনজীবীদের বিক্ষোভ
৪৩ মিনিট আগে | দেশগ্রাম