১৯৭৭ থেকে শুরু করে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আমাকে পেশাগত জীবনে অচিন্তনীয়, বিব্রতকর এবং হাস্যরসের অনেক ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে ডাক্তার হিসেবে। পাঠক, আপনাদের কারও কোনো ঘটনার সঙ্গে এর কোনো সাদৃশ্য থাকলে, আপনাকে বিব্রত করার জন্য এ লেখা নয়, তাই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এ ঘটনা সম্পূর্ণ সত্য, কল্পনাপ্রসূত নয়। আমি বিশ্বাস করি, ঘটনাটি পড়ে ডাক্তাররাও কিছু শিখতে পারবেন।
১৯৭৯ সালের ঘটনা, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তারদের কেবিনে থাকি। ৩ নম্বর ওয়ার্ড অর্থাৎ নাক কান গলা ওয়ার্ডে প্রায় রাত্র ১০টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ইমার্জেন্সি সব কাজ শেষ করে রুমে এসে ঘুমাব। এমন সময় ওয়ার্ডবয় নরেশ হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, স্যার একটা ভিআইপি রোগী এসেছে গলায় হাড় বিঁধে। আমি তাকে ধমক দিয়ে বললাম, তুই কি করে বুঝলি হাড় আটকিয়েছে। সে তখন এক্স-রে ফিল্মটা আমাকে দিয়ে বলল, স্যার দেখেন। দেখেই নিশ্চিত হলাম বেশ বড় একটা গরুর মাংসের হাড় খাদ্যনালির মুখে গেঁথে আছে। চট্টগ্রামে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটে। সাধারণত ঈদ অথবা ওরসের সময়। সে ক্ষেত্রে সাধারণত বেশির ভাগ রোগীই থাকেন গরিব। কারণ হিসেবে আমার যা মনে হয় তা হলো গরিব মানুষগুলো ওরসে গেলে একটু তাড়াতাড়ি এবং বেশি খেতে চায়। তাই দুর্ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয়ত, খাবার টেবিলে বেশি আড্ডা অর্থাৎ কথাবার্তা হলে, অসতর্কতার জন্য এ ঘটনা ঘটতে পারে।
সাধারণত রাতের বেলায় আসা এ ধরনের রোগীদের জন্য আমরা যা করি তা হলো, রোগীকে মুখে খেতে না দিয়ে স্যালাইন দিয়ে রেখে দিই, সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক চলে, পরের দিন সকালে রুটিন অপারেশনের আগে তা বের করার ব্যবস্থা নিই। একই চিকিৎসার কথা যখন নরেশকে বললাম, সে তখন বিনয়ের সঙ্গে বলল, রোগীটা ভিআইপি এবং খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি তাকে বললাম, ননীদাকে ডাকলে কি আসবে? কারণ একটু আগেই তিনি সার্জারি, ইএনটি এবং গাইনির ইমার্জেন্সি অপারেশনগুলো শেষ করে রুমে ফিরেছেন। নরেশ আবারও বলল, স্যার রোগীর সঙ্গে ৭-৮ জন লোক এসেছে, ভালো পোশাক পরিহিত এবং ইংরেজিতে কথা বলছে। সবাই বয়সে আপনার চেয়ে অনেক বড়। যার গলায় হাড় তিনি চট্টগ্রাম কলেজের পদার্থ বিদ্যার সহযোগী অধ্যাপক। সত্যি কথা বলতে দ্বিধা নেই, অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওয়ার্ডে গেলাম। রোগীদের সঙ্গে কথা বলে যা জানলাম তারা সবাই চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষক। ঈদের পর দিন, একটা ফ্যামিলি গেট টুগেদারের মতো। রাত ১০টায় খেতে বসেছেন, দুর্ভাগ্যক্রমে তার গলায় হাড়টা ঢুকে গেছে। ক্লিনিকেলি বোঝার জন্য রোগীকে বললাম, হাল্কা করে একটু ঢোক গেলেন দেখি! রোগীর ঢোক গেলার সময় মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝে নিলাম শতকরা একশ ভাগ নিশ্চিত যে হাড় গলায় আছে।
নরেশকে বললাম, সার্জারির জন্য সম্মতিপত্রে রোগীর দস্তখত নিতে এবং সাক্ষীস্বরূপ অন্য একজনের দস্তখত নিতে। এটাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু সাক্ষীর দস্তখত নিয়ে ঠেলাঠেলি। কারণটা বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হলো না। উনারা আমার মতো একটা জুনিয়র ডাক্তারকে দিয়ে এ অপারেশন করাতে সাহস পাচ্ছিলেন না। আমি তাদের আশ্বস্ত করলাম, আমি অপারেশন করতে পারব। রোগীদের একজন বললেন, আমিন সাহেবকে আনানো যায় না। আমি বললাম, আমাদের বিভাগে তিনজন আমিন স্যার আছেন। আমার সিনিয়র আমিন ভাই (আবু সফি আহমেদ আমিন) এইমাত্র বাসায় গেছেন, প্রয়োজন হলে ডাকব। আর, এস আমিন ভাই (নূরুল আমিন চৌধুরী) আমি ব্যর্থ হলে, উনাকে ডাকব, উনি আসবেন। অধ্যাপক নূরুল আমিন স্যারকে পেতে হলে আগামীকাল সকালে পাবেন। আর এটা চিকিৎসা বিজ্ঞানে এত জরুরি নয় যে, আমি উনাকে জরুরিভাবে ডাকতে পারব। কিন্তু আপনারা দস্তখত না দিলে আমি করব না। কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই মুহূর্তে আমি কনজারভেটিভ ট্রিটমেন্ট দিয়ে রাখব। রোগী তখন অত্যন্ত ধমকের সুরে তার সহকর্মীদের বললেন, 'আমি সম্মতি দিয়েছি, তোমাদের সাক্ষী হতে আপত্তি কোথায়। ডাক্তার সাহেব আপনি অপারেশন করে দিন, আমি লিখে দিচ্ছি। আমার মৃত্যুর জন্য আমি ছাড়া অন্য কেউ দায়ী নয়।' বলেই নরেশের হাত থেকে সম্মতিপত্র টান দিয়ে নিয়ে গেলে উনার এক সহকর্মী দস্তখত দিলেন। ইতিমধ্যে রাত প্রায় ১১টা ৩০ মিনিট বেজে গেছে। ভদ্রলোকের স্ত্রীসহ আরও কিছু সিনিয়র শিক্ষক চলে এসেছেন। তাদের মধ্য থেকে একজন বললেন, প্রাণ গোপাল তুমি পারবে তো? জবাবে বললাম ইনশাল্লাহ। 'ইনশাল্লাহ' শব্দটির প্রতি আমার খুব দুর্বলতা। কারণ ভারতীয় সেনাবাহিনীর পর্বত ব্রিগেডের প্রধান জেনারেল ওভান ১৯৭১-এর অক্টোবর মাসের কোনো এক সময় ত্রিপুরাতে এসেছিলেন দেরাদুনে উনার অধীনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুজিব বাহিনীর সদস্যদের আগরতলার গ্লাস ফ্যাক্টরির চৎব-রহফঁপঃরড়হ ক্যাম্প ভিজিট করতে। উনি তখন মুজিব বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে বলেছিলেন, “I have never heard such a mighty word like ‘Insallah’, which your great leader Sheikh Mujibur Rahman uttered on 7th March” অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর সেই উক্তি 'এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।'
যেই আমি ইনশাল্লাহ বললাম, উনারা সবাই হেসে উঠলেন। যাই হোক, রোগীকে ওটিতে নিয়ে গিয়ে অপারেশন টেবিলে শোয়ায়ে, আইভি ড্রিপ লাগিয়ে প্রথমেই টেলিফোন করলাম আমার বন্ধু অ্যানেসথেটিস্ট মরহুম ডা. হারুনকে এবং বললাম, দোস্ত, ননীদার আজকে জরুরি ডিউটি আমি জানি, কিন্তু উনি যদি না আসেন, তুই একটু আসিস, আমি একটা ভিআইপি রোগী নিয়ে বিপদে আছি। সেও বলল, কাল সকালে করলে হয় না? আমি তাকে রাগত স্বরে বললাম, তাহলে আমি তোকে টেলিফোন করলাম কেন? দেখি ননীদা আসে কি-না, না হলে তোকে আসতে হবে। ননীদা আমাদের সিনিয়র। অধিকন্তু একটু রাগী। তাই টেলিফোনে না বলে, নরেশকে পাঠিয়ে দিলাম ডেকে আনার জন্য। ননীদা আসলেন। উনি আসতে বাধ্য হলেন। কেননা নরেশের বিনম্র অনুরোধ কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। উনাকে রোগীর পরিচয় দেওয়ার আগেই উনি যা-তা বলতে লাগলেন। আমাকে ধমক দিয়ে বললেন কাল সকালে করলে কি হতো? যাই হোক উনি যা বললেন, রাক্ষসের মতো খেলে তো এরকম হবেই। আরও অনেক কিছু...।
ননীদা যখন আইভি চ্যানেলে অজ্ঞান করার ওষুধপত্র দিচ্ছেন তখন রোগী বলে উঠল, “Nani! what is lotted, can never be blotted”। দাদা অাঁতকে উঠলেন। পদার্থ বিদ্যার শিক্ষক তখন বললেন, চট্টগ্রাম কলেজে আমি তোমার সময় প্রভাষক ছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ননী দা উনার পায়ে ধরে সালাম করে উনাকে আশ্বস্ত করে অজ্ঞান করে দিলেন, আমিও মুহূর্তের মধ্যে মাংসসহ হাড়টা বের করে দিলাম। ৮-১০ মিনিটের মধ্যে রোগী জেগে উঠেই প্রথম প্রশ্ন, ডাক্তার সাহেব বের করতে পেরেছেন? আমাকে একটু দেখান। হাড়টা উনাকে এবং উনার সহকর্মীদের দেখিয়ে, উনার সহধর্মিণীর হাতে দিয়ে, রোগীর সঙ্গে উনাকে কথা বলিয়ে, গভীর রাতে সবাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিলাম এবং বললাম আপনাদের দেখতে হবে না, আমরাই দেখব। রোগীকে পোস্ট অপারেটিভ না দিয়ে ওয়ার্ডেই পাঠিয়ে দিলাম। কারণ সিস্টারদের তুলনায় ওয়ার্ডবয় নরেশ অনেক দক্ষ। দুর্ভাগ্য এই নরেশ আনোয়ারাতে তার নিজ বাড়িতে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে গভীর রাতে ডাকাতের গুলিতে অল্প বয়সেই মারা যান। নরেশ সত্যিকার অর্থে এক দুঃসাহসী ছেলে ছিল। রোগীর প্রতি নরেশের মমত্ববোধ এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। নরেশকে দিয়ে যে কাজ আমরা ১০ মিনিটে করাতে পারতাম, অন্যদের দিয়ে সেটা এক ঘণ্টায়ও করানো যেত না।
ডা. হারুন অপারেশনের মাঝামাঝি সময়ে এসে হাজির হলে, ননী দা বললেন, হারুন একটু আগে এলে তো আমি এ বিড়ম্বনায় পড়তাম না। অর্থাৎ উনার শিক্ষকের কাছে উনি লজ্জিত হতেন না। হারুন জিজ্ঞেস করল, কি বিড়ম্বনা? জবাবে বললাম পরে জেনে নিও। ডাক্তারদের প্রতি আমার অনুরোধ, রোগী যে কষ্ট নিয়েই আসুক না কেন রোগীর প্রতি কোনো রকমের ঠাট্টা-বিদ্রূপ আচরণ কখনো কাম্য নয়। আমরা যারা সার্জন, সবাই জানি কোনো রোগীকে অজ্ঞান করার আগে যেসব কথা রোগীর সামনে বলা হয়, তা জ্ঞান ফিরে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রোগী Hallucinate করে। রোগীকে অজ্ঞান করার প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে শেষে যেই অনুভূতিটি লোপ পায় তা হলো শ্রবণ এবং জ্ঞান ফিরে পাওয়ার প্রক্রিয়ায় যেই অনুভূতিটি সবচেয়ে আগে ফিরে আসে তাও হলো শ্রবণশক্তি। তাই ওটিতে এমন কোনো কথা বলা উচিত না যা রোগীর মানসিক অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে। এমনকি রোগীর অ্যানেসথেসিয়া প্রক্রিয়ার কোনো স্তরে যদি অবচেতনের মাত্রা হালকা হয়ে যায় তাহলেও সে সব শুনতে পায়। মানুষের গলা থেকে এ ধরনের অবাঞ্ছিত বস্তু যেমন- Artificial teeth/tooth, meat bones, fish bones, safety pin, pin, জেমস ক্লিপ, সুই, meat bolus, seeds, coin ইত্যাদি বের করার প্রশিক্ষণের জন্য চট্টগ্রাম ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের নাক কান গলা বিভাগের বিকল্প কিছু নেই।
এ ব্যাপারে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ আমার প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক নূরুল আমিন স্যারের কাছে, যার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ডা. নূরুল আমিন চৌধুরী আবাসিক সার্জন, অধ্যাপক আবু শফি আহমেদ আমিন এবং আমি নিজে এ কাজে সামান্যটুকু হলেও দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছিলাম। স্যার একটি বিশালাকার ছাতার মতো তিনতলায় বসে থেকেও চারতলার অপারেশন থিয়েটারের সব খবর নখদর্পণে রাখতেন। ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
ধন্যবাদ লিবিয়ার রাষ্ট্রনায়ক কর্নেল গাদ্দাফিকে, কারণ তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ থেকে সত্যিকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চার শতাধিক ডাক্তার লিবিয়াতে নিয়েছিলেন। যার জন্য শূন্যস্থান পূরণ করতে গিয়ে সরকার মেধাভিত্তিতে আমাদের কিছু ডাক্তারকে গ্রামের পরিবর্তে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সহকারী সার্জন সুপী ডিউটিতে নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ মেডিকেল কলেজগুলোর সহকারী রেজিস্ট্রার, রেজিস্ট্রার, রেসিডেন্ট সার্জন প্রায় সবাই লিবিয়া চলে গিয়েছিলেন এবং ওই সুযোগটাও আমরা কাজে লাগিয়েছিলাম সঠিকভাবে।
২. মাছের কাঁটা এবং আদালত : এই তো কয়েক বছর আগে টাঙ্গাইলের এক বিখ্যাত স্বনামধন্য রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে, গলায় মাছের কাঁটা লাগিয়ে এ্যাপোলো হাসপাতালে গিয়েছিলেন। ভর্তি করে কাঁটা বের করানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল, অর্থাৎ উনারা বের করতে পারেননি এবং বলে দিয়েছেন কাঁটা নেই। অ্যান্ডোসকপি করেছিলেন। রোগীকে ছেড়ে দেওয়ার দুই দিন পরও কষ্ট না কমায়, উনি পুনরায় আমার ছাত্র ডা. এবিএম মশিউর রহমানকে টাঙ্গাইলে দেখান। মশিউর এক্স-রে করে কাঁটা শনাক্ত করার পর, আমাকে পাঠিয়ে দেন অথবা যেহেতু ১৯৭২ থেকে ওই পরিবারের সবার সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক, তাই উনারা নিজেরাই চলে এসেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি যথারীতি ভর্তির ব্যবস্থা করে রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাব, তখন তার বড় ভাই আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাস্পদ, যিনি বর্তমানে একজন মন্ত্রী, তিনি বলে উঠলেন আমি থিয়েটারে থাকব। আমি বললাম, তাহলে আপনাকে সব কাপড়-চোপড় ছেড়ে থিয়েটারের ড্রেস পরে যেতে হবে। তারপরও রাজি হলেন। আমি একটু ভীত হলাম। উনি সারাক্ষণ অপারেশন থিয়েটারে ছিলেন। স্রষ্টার আশীর্বাদ, প্রথম চেষ্টায় কয়েক মিনিটের মধ্যে খাদ্যনালির মধ্য থেকে কাঁটা বের করে এনে দিলে, দাদা যে খুশি হয়েছিলেন, তার অভিব্যক্তি দেখে আমি আনন্দে আপ্লুত হয়েছিলাম।
যেহেতু মাছের কাঁটাটা ৪-৫ দিন আগে গলায় বিঁধেছিল এবং যেহেতু দুবার অ্যান্ডোসকপি হয়েছে, তাই রোগীকে দুই দিন হাসপাতালে রেখে সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভের পরে ছেড়ে দিই।
আনুমানিক ২-৩ মাস পরে একদিন টাঙ্গাইল প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে একটা সমন পেয়ে অাঁতকে উঠলাম। সাক্ষী হিসেবে হাজির হতে হবে। প্রথম সমনটি পাই তারিখের একদিন পরে, তাই হাজির হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দ্বিতীয়টি পেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, এ পর্যায়ে আমার কি আসতে হবে? তিনি বললেন, পরবর্তী তারিখে হাজির হলে হবে। (নিঃসংকোচচিত্তে স্বীকার করলেন উনি আমার রোগী)। অর্থাৎ রোগী এ্যাপোলো হাসপাতালের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করেছেন, ভুল চিকিৎসার জন্য। আমি হলাম সাক্ষী। অত্যন্ত বিব্রতকর। পরবর্তীতে আর কোনো সমন আসেনি, মামলার ভাগ্য কি হয়েছে জানি না। ডাক্তারি জীবনে আমি কখনো কোনো মেডিকেল সার্টিফিকেট দিইনি, সাক্ষী দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
৩. শিশুর মন্তব্য : নওরিন, ৬-৭ বছরের একটা ফুটফুটে শিশু। চট্টগ্রামের বাওয়া স্কুলের প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী, সঠিক মনে নেই। তবে আমার প্রিয় শিক্ষকদের একজন অধ্যাপক আবদুল মান্নান সিকদারের মেয়ে। স্যার, হঠাৎ করে রাত সাড়ে ৮টায়, ম্যাডামসহ নওরিনকে নিয়ে আমার চেম্বারে উপস্থিত। মেয়ের গলায় কাঁটা লেগেছে। রাতের খাওয়া থেকে উঠেই চলে এসেছে। নওরিনকে রোগীর আসনে বসিয়ে, একটু স্বাভাবিক করার জন্য, জিজ্ঞেস করলাম, স্কুলে যায় কি-না, কোন ক্লাসে পড়? কোন স্কুলে যায়? বড় মাছের কাঁটা না ছোট মাছের কাঁটা? ইত্যাদি। যেই বলল, বাওয়া স্কুলে পড়ে, তখনই আমি বললাম, তোমার প্রধান শিক্ষক এইমাত্র গলায় কাঁটা লাগিয়ে এসে, কাঁটা বের করে চলে গেল। প্রধান শিক্ষিকার সঙ্গে আমারও ভালো সম্পর্ক ছিল, কারণ মেয়ে বাওয়া স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। উনার স্বামী ছিলেন চট্টগ্রামে একজন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। উনার কাঁটা বের করতে কোনো বেগ পেতে হয়নি। এসব শুনে নওরিনের বেশ সাহস বেড়ে গেল। নিজেই বলল আমার কাঁটাটা বের করতে পারবেন তো? বললাম, তুমি সাহায্য-সহযোগিতা করলে পারব। রোগীর সহযোগিতায় কাঁটা বের করতে খুব কষ্ট হলো না। যেহেতু ছোট মাছের কাঁটা, বের করার সঙ্গে সঙ্গেই সে প্রশ্ন করল, তার প্রধান শিক্ষিকার কাঁটাটি কি ছোট মাছের না বড় মাছের। বললাম, বড় মাছের। সে একটু চুপ থেকে বলল, না ছোট মাছই হবে। উনি ছোট মাছ বলতে হয়তো বা লজ্জা পাচ্ছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি করে বুঝলে ছোট মাছ হবে? জবাবে সে বলল, বড় মাছের কাঁটা অনেক বড় হয়, তাই গলায় লাগতে পারে না। তার অভিব্যক্তি দেখে, আমি থ হয়ে গেলাম। নওরিন বড় হয়েছে। এখন স্বামীর সঙ্গে ভ্যানকুভারে থাকে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, রোগীর গলার মাছের কাঁটা, অনেক সময় নাক কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। তাই নাক কান গলায় অবাঞ্ছিত বস্তু বা Foreign body--কে সব সময় গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। যে কেউ, যে কোনো জায়গায় বের করার চেষ্টা না করাই উচিত। কাঁটা বের করা নিয়ে অনেক প্রবাদ প্রচলন আছে, যেমন- বিড়ালের পায়ে ধরা, দোয়া বা মন্ত্র পড়ে ফুঁ দেওয়া, শক্ত জিনিস গেলা। চট্টগ্রামের নন্দীর হাটের এক বুড়ি ছিলেন, এখনো আছেন কি-না জানি না, উনি কিন্তু গলার বাইরে চামড়ায় অাঁচড় দিয়ে ওই জায়গাতে তুলো অনেকক্ষণ লাগিয়ে রাখতেন, তুলো খোলার পর এর ভিতরে ওই কাঁটা পাওয়া যেত, যতদিনের পুরনো হোক না কেন। আসলে যেটা বিঁধে যায়, সেটা বের করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তবে ২৪ ঘণ্টার পরও যদি কাঁটা অনুভূত হয়, অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানো উচিত। কখনো গলায় আঙ্গুল দিয়ে বের করার চেষ্টা করা উচিত নয়।
৪. Denture না Dancer : ১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে রাত প্রায় ১০টার দিকে নাক কান ও গলা ওয়ার্ডের জরুরি ডাক এলো। ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি ১৮-১৯ বছরের একটি মেয়ে গলায় বাঁধানো দাঁত বিঁধে এসেছে। প্রত্যেকটি নাক কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞের জন্য বাঁধানো দাঁত খুবই বিপজ্জনক। কারণ সেগুলো তার দিয়ে ফিক্স করা হতো। তারগুলো এমনভাবে বাঁকানো হয় যে, এটা বের করা খুবই কঠিন হয়ে যায়।
এক্স-রে ফিল্মটা দেখে আমি, বন্ধু অ্যানেসথেটিস্ট হারুনকে টেলিফোনে বললাম, একটা রোগী এসেছে, গলায় Denture জরুরিভাবে বের করতে হবে, মেয়েটার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। টেলিফোন রাখার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়ের বড় ভাই এবং তার আরও ২ জন বন্ধু আমাকে ঘিরে ধরে বলল, আমার বোনকে আপনি কেন Dancer বা নতর্কি বললেন? আমি যতই বলি, আমি তা বলিনি, তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন। ইতিমধ্যে ডা. হারুন এসে হাজির। পরিবেশ ঠাণ্ডা করার জন্য হারুন, তার বাঁধানো দাঁত দুটো বের করে তাদের বললেন, এটা হলো Dancer। আর তোমরা যে উধহপবৎ বলছ ওটার বানান হলো DANCER।
৫. শিশুর গলায় ৫ টাকার কয়েন : ১৯৮৫ সালের কথা। ছয় বছরের এক শিশুকে নিয়ে মা-বাবাসহ আত্দীয়স্বজন এসে হাজির আমার চেম্বারে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে। সঙ্গে এক্স-রেও নিয়ে এসেছেন। সবাই উদ্বিগ্ন। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, বাচ্চাটা একটা পাঁচ টাকার কয়েন খেয়ে ফেলেছে। পরিবেশ হালকা করার জন্য বললাম, ভালোই হয়েছে, এখন পায়খানা না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। বাবা বলে উঠলেন, এটা তো গলায় আটকে আছে। পেটে তো যায়নি। আমি বললাম, পেটে চলে গেলে তো আমার কাছে আসতেন না। এক্স-রে দেখে রোগীর অভিভাবককে বললাম, মেডিকেল কলেজের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে এবং ওইখানে গেলেই অতি সহজে ডাক্তাররা বের করে দেবেন। রোগীর অভিভাবকরা বললেন, আমরা অনেক ঘুরে এসেছি, আপনি বের করে দেন। রোগীসহ চেম্বার সহকারীকে ওটিতে পাঠিয়ে সবকিছু প্রস্তুত করে আমাকে ডাকতে বললাম, নিয়মিত আমার সঙ্গে কাজ করেন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ডা. হারুনকে ডাকলাম। জরুরি বলাতে হারুন যথাসময়ে এসে হাজির। অবচেতন (বেহুঁশ) করে পয়সা বের করে দিলে ওয়ার্ডবয় নিয়ে রোগীর অভিভাবকের হাতে দিয়ে দেন। হয়তোবা কিছু বকশিশ জোটে। রোগীর ঘুম থেকে না ওঠা পর্যন্ত আমি কখনো রোগীকে ছেড়ে যাই না। রোগী ঘুম থেকে উঠেই, মা-বাবা কোথায় জিজ্ঞেস না করে বা কান্নাকাটি না করে, বলে উঠল ডাক্তার আমার টাকাটা দেন। সবাই হেসে উঠলাম। আগে শুনেছি, পাগলেও টাকা চেনে। এখন দেখলাম, শিশু-বুড়ো, পাগল, সুস্থ সবাই বোধহয় টাকা চিনতে ভুল করে না।
লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।