‘জাতীয়তাবাদের সীমা’ শীর্ষক রচনাটি বাংলাদেশ প্রতিদিন ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। পাঠকের অনুরোধে লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রতি শুক্রবার রকমারি পাতায় পুনঃমুদ্রিত হচ্ছে। আজ ছাপা হলো চতুর্থ পর্ব-
রমনার কালীবাড়ির মহারাষ্ট্রীয় স্বামীজির মতে আক্রমণকারীদের কণ্ঠে ছিল 'ওঁ বন্দে মারতম' রণধ্বনি। বঙ্কিমচন্দ্র ওই ধ্বনিকে যেভাবে গানে রূপান্তরিত করেছেন শিল্পমূল্যে তা অসাধারণ এবং সংগ্রামের আহ্বান হিসেবে উপন্যাসের নায়কদের মুখে যেভাবে গানটিকে নিয়ে এসেছেন তা অসামান্য। ওই উপন্যাস ও তার অন্তর্ভুক্ত গানটি জাতীয়তাবাদের হিন্দু সাম্প্রদায়িক ধারার জন্য অত্যন্ত উপকারী হয়েছে, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত করেছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সমষ্টিগত সংগ্রামকে। 'আনন্দমঠ' প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সালে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠনের তিন বছর আগে। কংগ্রেসের রক্ষণশীল অংশ 'বন্দে মাতরম'কে ভারতবর্ষীয়দের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণে আগ্রহী ছিল, এ জন্য তারা চাপও সৃষ্টি করেছে। তাদের পক্ষে এটা করা খুবই স্বাভাবিক ছিল। কংগ্রেসের রাজনীতিতে বঙ্কিমচন্দ্রের এই রচনাটির প্রভাব হিসাব করা দুঃসাধ্য।
উপন্যাস হিসেবে 'আনন্দমঠ' অত্যন্ত সুখপাঠ্য ও রোমাঞ্চকর। এই গ্রন্থে যেমন ইতিহাস আছে, তেমনি রয়েছে ইতিহাসের বিকৃতি এবং অত্যদ্ভুত সব ঘটনা। বিশেষ করে মহাপুরুষের আগমন ও প্রস্থান তো আরব্য উপন্যাসের মতো কৌতূহলোদ্দীপক। পাশাপাশি দুর্ভিক্ষের বর্ণনা অত্যন্ত বাস্তববাদী। চরিত্র অঙ্কনের বঙ্কিমচন্দ্রীয় দক্ষতারও অভাব নেই। কিন্তু 'আনন্দমঠ' তো কেবল উপন্যাস নয়, সেই সঙ্গে এটি জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের একটি ধারার মূল্যবান প্রচার-দলিলও বটে। এতে ওই ধারার মতাদর্শের চুম্বকটির দেখা পাই। এই জাতীয়তাবাদ স্বাধীনতা চায়, কিন্তু সমাজ বিপ্লব মোটেই চায় না, বরঞ্চ তাকে প্রতিহত করা আবশ্যক মনে করে। বিপ্লবকে সে এতই বিপজ্জনক বলে দেখে যে এর মোকাবিলায় ব্রিটিশের সঙ্গে আপস করতে পর্যন্ত সম্মত থাকে। আর ভেতরে ভেতরে কাজ করে পরাজিতের মনোভাব।
'আনন্দমঠ'র প্রথমবারের বিজ্ঞাপনে বঙ্কিম যা লিখেছিলেন তাতে কেবল গ্রন্থের পরিচয় যে পাওয়া যায় তা নয়, যে জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা তিনি চাইছিলেন তার অবয়বও ফুটে ওঠে। তিনি লিখেছিলেন, সমাজ বিপ্লব অনেক সময়েই আত্মপীড়ন মাত্র। বিদ্রোহীরা আত্মঘাতী। ইংরেজরা বাংলাদেশকে অরাজকতা হইতে উদ্ধার করিয়াছেন। এই সব কথা এই গ্রন্থে বুঝান গেল।
'এই সব কথা' আসলে দুটি কথা। এক, বিপ্লব তো বটেই, এমন কি আপসহীন বিদ্রোহও কাঙ্ক্ষিত নয়। দুই, ইংরেজ এসে দেশবাসীর অপকারের সঙ্গে কিছুটা উপকারও করেছে। রামমোহনের সময় সমাজ বিপ্লবের প্রশ্নটা দেখা দেয়নি, তার একটা কারণ তখনো সিপাহী অভ্যুত্থান ঘটেনি। ওদিকে সিপাহী অভ্যুত্থানের সময় বঙ্কিমের বয়স উনিশ। অভ্যুত্থানের কারণে ব্রিটিশ ও বাঙালি মধ্যবিত্ত উভয় গোষ্ঠীর ভেতরই যে এক ধরনের আলোড়ন ও ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল তা তিনি দেখেছেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, সেখান থেকে তার গ্রাজুয়েট হওয়া, ডেপুটির চাকরি পাওয়া, এসবের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে বিপ্লব বিরোধিতাটা তার জন্য সমসাময়িকদের মতোই বঙ্কিমচন্দ্রের নিজের ভেতরও গড়ে উঠেছে। ইংরেজের আগমন ঈশ্বরের কৃপায় ঘটেছে, এ বোধ রামমোহনের মধ্যে জন্মেছিল; বঙ্কিমও যে অন্যরকম ভাবতেন তা নয়, তার অন্য লেখাতে অমন কথা আছে, স্বাধীনতার জন্য জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে বিষয়বস্তু করে লেখা আনন্দমঠেও তা রয়েছে। বিদ্রোহের নেতা সত্যানন্দ বিজয়ী হয়েছে, বিজয়ের সেই মহাক্ষণেই তাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে মন্ত্রদাতা মহাপুরুষ বলছেন, ইংরেজ শত্রু নয়, মিত্র বটে। ইতিহাস বলে, ওয়ারেন হেস্টিংস একজন দুর্বৃত্ত ছিলেন, অথচ ঔপন্যাসিক বঙ্কিম জানাচ্ছেন যে ওই ব্যক্তি 'ভগবানের নিয়োগে' গভর্নর জেনারেল হয়ে এসেছিলেন। মহাপুরুষের বক্তব্যের সঙ্গে বঙ্কিমের নিজের বক্তব্য এখানে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
জাতীয়তাবাদী বঙ্কিমের ভেতর স্বাধীনতার স্পৃহা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত প্রবল ছিল। বস্তুত, স্বাধীনতার জন্য সত্যানন্দের যে আগ্রহ সেটি বঙ্কিমের নিজেরও, অথচ তিনিই যে শেষ পর্যন্ত বিপ্লবের বিরোধিতা এবং ইংরেজের কাছে আত্মসমর্পণ কাম্য মনে করছেন এর কারণ কি? কারণ শ্রেণী স্বার্থ। সত্যানন্দের সেনাবাহিনীতে সদস্য সংখ্যা বিপুল, এক জায়গায় তো বলা হয়েছে সে-সংখ্যা পঁচিশ হাজার, এরা প্রায় সবাই কৃষক। যে সন্ন্যাসী-বিদ্রোহের কাহিনী অবলম্বনেআনন্দমঠ রচিত আদতে সেটি ছিল একটি কৃষক বিদ্রোহ। সত্যানন্দের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক মহাপুরুষ মোটেই চান না এই কৃষক বিদ্রোহ আরও এগিয়ে যাক, এগিয়ে গিয়ে বিদ্রোহ বিপ্লবের রূপ পরিগ্রহ করুক। আর বিশেষভাবে সে জন্যই সত্যানন্দকে নিবৃত্ত করা। সত্যানন্দ যা বোঝে না, মহাপুরুষ তা বোঝেন। তিনি জানেন অধিক অগ্রসর হলে কৃষকদের থামিয়ে রাখা কঠিন হবে, তারা কেবল ইংরেজকে তাড়াবে না, গোটা ব্যবস্থাটাকেই ভেঙে ফেলবে। তখন বিপদ শুধু ইংরেজের ঘটবে না, ঘটবে সুবিধাভোগী স্থানীয়দের।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মুরবি্বদের যে জ্ঞান জন্মেছিল, যার দরুন তারা দ্রুত যুদ্ধের মীমাংসা ঘটিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়ে সমাজ বিপ্লবের আশঙ্কাকে নির্মূল করতে চেয়েছেন, মহাপুরুষও সেই জ্ঞানেরই অধিকারী; তারও ভয় সমাজ বিপ্লবকে। সত্যানন্দকে নিবৃত্ত করে মহাপুরুষ তাই কৃষক বিপ্লবের আশঙ্কাকে সরিয়ে দিলেন; বিদ্রোহী কৃষক যাতে পুনরায় কৃষিকাজে ফেরত যায় এবং মহাপুরুষ নিজে যে শ্রেণীর মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করেন তাদের সেবা করা অব্যাহত রাখে সে বিষয়টা তিনি নিশ্চিত করলেন। মহাপুরুষ যেন মহাত্মা গান্ধীর পূর্বসূরি। গান্ধীও ধর্মে আস্থাশীল ছিলেন। তার জাতীয়তাবাদও ছিল আপসপন্থি এবং সামাজিক বিপ্লববিরোধী। সে জাতীয়তাবাদের অভ্যন্তরেও পরাজয়ের মনোভাব ছিল।
বিজয়ী ও বিদ্রোহী সত্যানন্দকে নিয়ে মহাপুরুষ বিলক্ষণ বিপদে পড়েছিলেন। শিষ্যকে তিনি বোঝাতে পারছেন না বিজয়ের মুহূর্তে কেন আত্মসমর্পণ করতে হবে। [ চলবে ]