নুরুল কাদের খানের (স্যার) সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়, কলকাতায়। অবশ্য তার নাম এবং তার সম্পর্কে অনেক গল্প-কাহিনী শুনেছি তারও অনেক আগে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবনের শেষের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ছাত্ররা নুরুল কাদের খান নামের সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত ছিল। বিশেষ করে যারা সিএসএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তাদের কাছে এ নামটি খুবই আকর্ষণীয় ছিল। এ নামের ব্যক্তিটি বোধ হয় ভিতরে ভিতরে অনেকের রোল মডেল ছিলেন। মোট কথা আমাদের মধ্যে নুরুল কাদের খান নামের একটা জাদুকরী প্রভাব ছিল। সময়টা ষাটের দশকের মাঝামাঝি।
তার সম্পর্কে যে কথাটি আমাদের মাঝে ঘটা করে চাউর হয়েছিল তা হলো নুরুল কাদের খান একজন সিএসপি অফিসার, যিনি বর্তমানে চাঁদপুরের সাবডিভিশনাল অফিসার (এসডিও), বাংলায় মহকুমা প্রশাসক। এই তরুণ কর্মকর্তা দেখতে খুব সুন্দর, চলন-বলনে অসাধারণ চৌকস এবং কাজেকর্মে বেশ তৎপর। মেধাবী তো বটেই। অল্প বয়সেই তিনি যথেষ্ট পরিচিতি এবং প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। এসব সুনামের সঙ্গে অনেক রংচঙ্গা গল্পও তার সঙ্গে জড়িত ছিল, যা তার বয়সের সঙ্গে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ। তার প্রতি সুন্দরী মহিলাদের আকর্ষণের গল্প ছিল ঈর্ষণীয়। আমরা গভীর আগ্রহ নিয়ে এসব গল্প শুনতাম আর ভাবতাম আমাদের নামে ভবিষ্যতে এ ধরনের গল্প জড়িয়ে গেলে বোধ হয় মন্দ হবে না। ভাবসাব এমন যে, আমরা তখন আধা সিএসপি হয়ে গেছি। পরীক্ষাটা শুধু বাকি রয়েছে। নুরুল কাদের খানের মতো 'রঙিলা' হওয়ার স্বপ্নে আমরা হবু সিএসপিরা তখন বিভোর।
তারপর আমরাও এক সময় সিএসপি হয়ে গেলাম। জানলাম নুরুল কাদের খান '৬১ ব্যাচের কর্মকর্তা। সে ব্যাচে আরও রয়েছেন আসাফউদ্দৌলা, হুসাইন তৌফিক ইমাম, শামীম আহসান, রফিক উল্যাহ চৌধুরী, মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন, নুরুল ইসলাম শামস। এরা প্রত্যেকেই স্বনামধন্য, একাই একশ; আরও ছিলেন কিছুটা নিরীহ প্রকৃতির তিনজন কর্মকর্তা এএনএম ইউসুফ, নুরুল আমিন খান এবং জালালুদ্দিন আহমেদ। এ ব্যাচের কর্মকর্তাদের সম্পর্কে কথা উঠলে আমরা প্রায়ই বলাবলি করতাম যে, এত কাবিল-কুতুব নিয়ে লাহোর একাডেমি তথা লাহোর মহানগরী টিকে থাকল কী করে। এ দুই প্রতিষ্ঠান হয় তাদের সানি্নধ্যে মাতোয়ারা হয়েছিল অথবা 'ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি' বলে চিৎকার করছিল। চৌকস চলন-বলন এবং সর্বজনীন পরিচিতির দিক থেকে শুধু '৬৭ ব্যাচকে '৬১ ব্যাচের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কোথায় যেন এদের একটা স্বাতন্ত্র্য রয়েছে।
নুরুল কাদের খানের কথায় আসি। '৭০ সালের শেষ ভাগে, যতদূর মনে পড়ে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে, আমরা একাডেমির ট্রেনিং এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জেলা সংযুক্তি শেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসি। সহকারী কমিশনার হিসেবে বিভিন্ন জেলায় আমাদের পোস্টিং হয়ে যায়। আমার পোস্টিং হয় যশোর জেলায়। এ সময় শুনতে পাই নুরুল কাদের খান (স্যার) পাবনার জেলা প্রশাসক হয়েছেন। তার সম্পর্কে বলা হচ্ছিল যে, তিনি ডিসির বাংলো এবং সার্কিট হাউসের বাথরুমটি টাইলস সংযোগে সুসজ্জিত করেছেন। পাবনায় খুব শানশওকতের সঙ্গে ডিসিগিরি করছেন।
২. ১২ নভেম্বর '৭০-এর সাইক্লোনের আঘাতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হলো। রিলিফ কাজে আমাকে ভোলায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সেখানে মাসদুয়েকের মতো থাকতে হলো। রিলিফ ডিউটি থেকে অব্যাহতি পেয়ে আমরা যোগ দিলাম দক্ষিণ চট্টগ্রামের সুনুতি সার্ভে ক্যাম্পে। ১ মার্চ '৭১ সালে জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার পর সারা প্রদেশে গণবিস্ফোরণ ঘটল। ঢাকা স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রিকেট খেলা গণরোষে তাৎক্ষণিক পণ্ড হয়ে গেল। মিছিল, শোভাযাত্রা, হরতাল আর অসহযোগ আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান অচল হয়ে গেল। আমাদের সার্ভে ট্রেনিং ক্যাম্প বন্ধ হয়ে গেল। আমরা যে যার জেলায় ফিরে গেলাম। একদিকে আন্দোলন চলছে, অন্যদিকে ইয়াহিয়া-মুজিবের সংলাপ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর জনতার প্রচণ্ড চাপ, স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হবে। আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পৈশাচিক আক্রমণ চালিয়ে শত শত নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিকে খুন করে বসল। ঢাকা শহর বিধ্বস্ত করে ফেলল। শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। ঢাকা নগরীর বাইরের বাংলাদেশ মুক্ত, স্বাধীন।
আমি তখন নড়াইলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে ব্যস্ত। মহকুমা প্রশাসক ঢাকা চলে যাওয়ার পর নড়াইল শহরে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কাজের দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর। এমএনএ হাফিজ সাহেব মাঝে-মধ্যে আসেন। এ সময় জানতে পারলাম পাবনার ডিসি নুরুল কাদের খান বীরদর্পে তার জেলায় যুদ্ধ সংঘটিত করছেন। জেলার সরকারি-বেসরকারি সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পাবনা, কুষ্টিয়া অঞ্চলে তখনো পাক হানাদার বাহিনী আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরাই এসব জেলার প্রশাসনিক যন্ত্র থেকে শুরু করে প্রায় সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। নুরুল কাদের খান পাবনা অঞ্চলের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এমনটি শুনতে পেলাম। ধীরে ধীরে পাক সেনারা বিভিন্ন জেলা এবং মহকুমা শহরে প্রবেশ করল। আমাদের তখন পিছু হটার পালা। নড়াইল পতনের পর আমরা লোহাগড়া উপজেলায় চলে গেলাম। তখন জানলাম নুরুল কাদের খান (স্যার) পাবনার ট্রেজারির টাকা-পয়সা ট্রেনে তুলে ট্রেন নিয়ে কুষ্টিয়া জেলার কোনো এক সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে পেঁৗছে গেছেন। সেখানে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছে। এখন তিনি কলকাতায় অবস্থান করছেন।
নড়াইল, খুলনার গ্রামেগঞ্জে পালিয়ে থেকে অবশেষে ২২ মে ১৯৭১ সালে আমি যখন বিধ্বস্ত অবস্থায় লুঙ্গি পরে কলকাতায় হাজির হলাম, নুরুল কাদের খান তখন মুজিবনগর সরকারের সেক্রেটারি, জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। বসেন কলকাতার বাংলাদেশ মিশনে। (পদবির মাঝখানে কমা দেওয়া তিনি পছন্দ করতেন না।) ওয়ালি ভাই (মাগুরার সাবেক মহকুমা প্রশাসক, পরবর্তীকালে সরকারের সচিব) আমাকে নুরুল কাদের খানের কাছে নিয়ে গেলেন। আমার অবস্থা দেখে তার কী মনে হয়েছিল জানি না। তবে মনে হয় খুব একটা 'ইমপ্রেসড' হননি। যাক, আমার পোস্টিং হয়ে গেল প্রায় তাৎক্ষণিক। অর্থমন্ত্রীর একান্ত সচিব। আমার অফিস ৮নং থিয়েটার রোডে। থাকি ওয়ালি ভাইয়ের সঙ্গে, কারনানি স্টেটের সঙ্গে লাগোয়া একটি বাসায়। দুই রুমের একটি মেস; শোবার ঘরে আমরা জনাচারেক বাসিন্দা। একটি খাবার ঘর কাম বসার ঘর।
৩. নুরুল কাদের খানের (স্যার) সঙ্গে ক'দিন আর দেখা হয়নি। হঠাৎ একদিন দেখলাম থিয়েটার রোডের অফিসে লোকজনের আনাগোনা, চলাফেরা এবং দল পাকিয়ে আলাপ-আলোচনার পরিমাণটা একটু বেশি। বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। একটু পরই খবর এলো প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুজিবনগর সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি আলোচনায় মিলিত হবেন। এ সময় নুরুল কাদের খান (স্যার) ব্যাপারটি সম্পর্কে আমাদের অবহিত করলেন। আওয়ামী লীগের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মুজিবনগর সরকারে সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের প্রভাব সহ্য করতে পারছিলেন না। তারা প্রশাসনিক কাজে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিলেন। এ নিয়ে প্রায়ই তর্কবিতর্ক হতো। এ সময় একজন নেতা সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেন। তার প্রতিবাদে নুরুল কাদের খান (তিনি অবশ্য খান শব্দটি ব্যবহার করতে চাইতেন না) কর্মবিরতির হুমকি দিলে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপিত হয়। প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ে কর্মরত সব কর্মকর্তাকে আলোচনার জন্য ডেকে নেন। প্রধানমন্ত্রী তার ধীশক্তি, বক্তব্য মাধুর্য এবং আন্তরিকতার মাধ্যমে বিষয়টি অতি সুন্দরভাবে নিষ্পত্তি করলেন। এ সভায় নুরুল কাদের (স্যার) ও তার সুললিত এবং তীক্ষ্ন বক্তব্য রেখে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।
এরপর থেকে নুরুল কাদেরের (স্যার) সঙ্গে আমার সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। দেখা-সাক্ষাৎ এবং আলাপ-আলোচনার পরিমাণ বেড়ে যায়। তার ব্যাপারে আমার যে ভয়ভীতি এবং আড়ষ্টতা ছিল তা কমে যায়। অফিসে এবং অফিসের বাইরে তার সঙ্গে ওয়ালি ভাই এবং আমার দেখা-সাক্ষাৎ হতো। একাধিকবার তিনি আমিনিয়া, আমজাদিয়া এবং এ জাতীয় রেস্টুুরেন্টে আমাদের আপ্যায়ন করেছিলেন। বিদেশের মাটিতেও আমরা তাকে চলনে-বলনে অতীব চৌকস দেখেছি। আমার সব সময় মনে হয়েছে মুজিবনগর সরকারের জন্য তিনি এক অসাধারণ সম্পদ যাকে নিয়ে সরকার গর্ব করতে পারে।
স্বাধীনতার পর ২২ ডিসেম্বর '৭১ তারিখে কেবিনেটের সঙ্গে একই হেলিকপ্টারে এসে আমরা বঙ্গভবনে অবস্থান গ্রহণ করি। আমার আবাসস্থল ছিল 'মানুক হাউস'। জানুয়ারি '৭২-এর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমি বঙ্গভবনে ছিলাম। নুরুল কাদের (স্যার) তখন সচিব, সাধারণ প্রশাসন। আমি মনসুর আলী, যিনি মন্ত্রী অর্থ, বাণিজ্য, খনিজ সম্পদ, ভূমি মন্ত্রণালয়ের একান্ত সচিব। নুরুল কাদেরের (স্যার) সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখে আমাকে কাজ করতে হতো। বঙ্গভবনে আমাদের কাজের সময় ছিল সকাল ৮টা থেকে রাত ১টা। মাঝে-মধ্যে বিশ্রাম, খাওয়া-দাওয়ার জন্য সামান্য কিছু সময় বাদ যেত। এরপর অল্প কয়েক মাসের মধ্যে ক্ষমতার দৃশ্যপট পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক ঘটনা ঘটে গেল যার সবকটি মনে হয় স্যারের জন্য সুখকর ছিল না। প্রথমে সংস্থাপন (সাধারণ প্রশাসন) মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে সরিয়ে তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব করা হলো। এরপর সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে তাকে পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান করা হলো। দৃশ্যতই ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ সময়ে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। কোনো দুঃখ তিনি প্রকাশ করেননি। বরং দেখলাম মহাউৎসাহে তিনি পর্যটন করপোরেশনকে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। এটি বোধ হয় তার ব্যক্তি চরিত্রের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, যখন যে কাজ করেছেন উৎসাহ এবং আন্তরিকতা নিয়ে সে কাজ সম্পন্ন করেছেন। সত্যি বলতে গেলে সে কাজ উপভোগ করেছেন। এবং সে কাজের গুণগত মান সর্বোচ্চ উৎকর্ষতায় উন্নীত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সফল হয়েছিলেন। অনেক দিন তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। যোগাযোগও ছিল না। উচ্চশিক্ষার্থে আমি বিদেশ চলে গিয়েছিলাম। অনেক বছর পর দেশে ফিরেছি। স্যার ইতিমধ্যে চাকরি ছেড়ে তৈরি পোশাকশিল্পের বড় উদ্যোক্তা তথা পথিকৃৎ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দেশের রাজনীতিতে অনেক পটপরিবর্তন ঘটেছে। কোনো কিছুই তার শিল্পোদ্যোগকে এবং ব্যক্তিক আকর্ষণকে কমাতে পারেনি। ইতিমধ্যে বিয়েথা করে তিনি সংসারী হয়েছেন। ঢাকায় সুন্দর বাড়ি করেছেন। শারীরিকভাবে এত সুদর্শন এবং চৌকস লোকের স্ত্রী কেমন হয়েছে তা দেখার শখ ছিল। দেখে খুশি হলাম। ভাবীও খুবই সুন্দর। তার চেয়েও বড় কথা, খুবই আকর্ষণীয় তার ব্যক্তিত্ব। ভালো লাগল।
নব্বইর প্রথমদিকে আমি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব এবং পরে সংযুক্ত অতিরিক্ত সচিব হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম। নুরুল কাদের (স্যার) তখন বিজিএমইএর মুরবি্বস্থানীয় নেতা হিসেবে প্রায়শই মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত মিটিংগুলোতে যোগ দিতেন। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমি কখনো প্রধান, কখনো বিকল্প প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে এসব সভায় যোগ দিতাম। স্যার খুব জোরালো ভাষায় নানা গল্প-কৌতুক সহযোগে তার বক্তব্য রাখতেন। কখনো কখনো আমাদের সঙ্গে জোর বিতর্ক হতো। স্যার সহাস্য মুখে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন, বিতর্কে অবতীর্ণ হতেন। স্যার তখন আমাকে তার পুরনো সেই অতি কনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে বিবেচনা না করে আমার একাডেমিক যোগ্যতা এবং পদমর্যাদা বিবেচনায় রেখে স্নেহমিশ্রিত সম্মানের সঙ্গে কথা বলতেন। এটি ছিল আমার বাড়তি পাওনা, আমার সন্তুষ্টির বড় আকর। এ আলোচনার মাধ্যমে স্যারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আরও সহজ হয়ে আসে, অনানুষ্ঠানিক প্রকৃতির রূপ পরিগ্রহ করে। আমার সঙ্গে স্যারের প্রায়ই দেখা হতো গুলশান-১ নম্বরের কাঁচাবাজারে, স্যার ভালো খেতে পছন্দ করতেন, তারচেয়ে বেশি খাওয়াতে পছন্দ করতেন। তার বাসায় ডিনার খেয়ে যে আনন্দ পাওয়া যেত তা বলার নয়।
যেমন লোভনীয় খাওয়া, নিখুঁত ব্যবস্থাপনা, যেমন পুরো বাসার দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো তেমনি আনন্দঘন মোলায়েম পরিবেশ। স্যার নিজ হাতে কিছু খাবার প্রস্তুত করতেন, যেমন দুধ-পুলি। যে স্নেহ-যত্নে তিনি আমার স্ত্রী এবং আমাকে আপ্যায়ন করতেন তা আমরা কোনো দিন ভুলব না। আসলে সব দিক থেকেই তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ এক রাজপুত্তুর। রোগবালাইও বোধ হয় এ রকম ব্যক্তিত্বের প্রতি খুব তাড়াতাড়ি আকৃষ্ট হয়। নইলে অমন সুদর্শন বলিষ্ঠ দেহে এত অল্প বয়সে মরণব্যাধি বাসা বাঁধবে কেন। নানারূপ সাধ্য সাধনার মাধ্যমে একবার এ রোগকে পরাজিত করে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছিলেন। নিজের রোগ সম্পর্কে সুন্দর সুন্দর গল্প বলতেন। পরাজিত মরণব্যাধি 'রি-গ্রুপ' করে বাড়তি শক্তি নিয়ে আবার আক্রমণ করল। দেশ তখন আক্রান্ত হয়েছে '৯৮ এর মহাপ্লাবনে। একই সময়ে স্যার আক্রান্ত হয়েছেন বিদেশের মাটিতে মরণ ব্যাধির প্রকোপে। বানের পানি যখন টান দিয়েছে তখন দুরারোগ্য ব্যাধিও তাকে মরণ কামড় দিল। আমরা কিছু পানি ডিঙিয়ে তার মরণোত্তর অনুষ্ঠানে হাজির হলাম। বন্যায় দেশ তখনো বিধ্বস্ত, আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আলাহ স্বল্পসংখ্যক লোককে এমনভাবে সৃষ্টি করেন যে, তাদের বিকশিত ব্যক্তিত্ব প্রায় সবদিক থেকে আকর্ষণীয় রূপে প্রতিভাত হয়। যে কোনো 'এঙ্গেল' থেকে এদের ছবি নেওয়া হোক না কেন, সে ছবি দেখতে অতীব সুন্দর হয়। নুরুল কাদের স্যার ছিলেন তেমনি এক ব্যক্তিত্ব। তাকে আমি নানাবিধ ভূমিকায় সক্রিয় দেখেছি। প্রতিটি ভূমিকায় তাকে মনে হয়েছে অসাধারণ এক নায়ক। আমার কাছে চে গুয়েভারার একটি ফটো রয়েছে। যোদ্ধা হিসেবে যে নুরুল কাদেরকে (স্যার) দেখেছি তার সঙ্গে 'চে'র আদলের খুব মিল। ভয়ানক বলিষ্ঠ, ভয়ানক আত্দপ্রত্যয়ী। আসলে তিনি ছিলেন এক রাজপুত্তুর, যার সহকর্মী হিসেবে ক্ষণিকের জন্য হলেও আমরা হয়েছিলাম গৌরবান্বিত।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব