বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি যে কত খারাপ তা প্রতিদিনের খবরের কাগজ পড়লেই বোঝা যায়, যদিও খবরের কাগজে রাজনৈতিক হত্যা ও গুমের খবর সবটা প্রকাশ হয় না। এর পর সরকারের 'সম্প্রচার নীতি' আইনে পরিণত হলে হয়তো একেবারেই প্রকাশ হবে না। অথবা সেটাই প্রকাশ হবে, যা হচ্ছে সরকারের ভাষ্য।
ক্রসফায়ার সম্পর্কে সরকারের ভাষ্য যে সত্য নয়, এটা সবাই জানে। ক্রসফায়ারের শব্দগত অর্থ হলো এই যে, দুই পক্ষের গোলাগুলিতে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বেঘোরে প্রাণ দিল। প্রতিটি ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে সরকার এটাই বলে থাকে। এটা যে কত বড় রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচার তা সবাই জানেন। তবু সরকার সেই মিথ্যাচারই করে চলেছে নির্লজ্জের মতো। এখন ক্রসফায়ারের একটা যথার্থ মানে বুঝে নিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। ক্রসফায়ারের আসল মানে হলো, কোনো ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে বিনা বিচারে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা। এটা সাধারণত র্যাব করে থাকে। এখন পুলিশও করে এবং প্রশাসনের উপরতলার নির্দেশেই তা হয়ে থাকে। ক্রসফায়ার শুরু করেছিলেন খালেদা জিয়া। বর্তমানে শেখ হাসিনার সরকার সেটাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গুম। খুন ও গুমের পরিমাণ এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা পর্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। শাহ্ এর আমলে ইরানে, অথবা সুহার্তোর আমলে ইন্দোনেশিয়ায় যেভাবে বিরোধী পক্ষকে উধাও করে দেওয়ার ঘটনা ছিল, মনে হয় বাংলাদেশেও সেই প্রাকটিস শুরু হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো বিশ্ববিখ্যাত এবং অত্যন্ত সম্মানজনক প্রতিষ্ঠানও যথেষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে গুম-খুন শুধু বৃদ্ধিই পায়নি, এর সঙ্গে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীও জড়িত। গত ৩ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- "অ্যামনেস্টির ভাষ্যমতে ২০১২ সাল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের শিকার হওয়া অন্তত ২০ জনের ঘটনা তদন্ত করেছে অ্যামনেস্টি। এর মধ্যে নয়জনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। দুই মাস পর্যন্ত আটক থাকার পর ছয়জন বাড়ি ফিরেছে। বাকি পাঁচজনের এখনো কোনো খোঁজ মেলেনি। অ্যামনেস্টি বলছে, ২০টি ঘটনা তদন্ত করলেও বাস্তবে গুমের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার কথা। অনেক অপহরণের ঘটনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হচ্ছে। বিরোধী দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিশানা করে এসব অপহরণের ঘটনা ঘটেছে।"
সব গুম ও খুনের ঘটনা যে রাজনৈতিক কারণে হচ্ছে তা আমি বলব না। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে পুলিশ ও র্যাবকে বার বার ব্যবহার করতে করতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, র্যাব নিজেই আপেক্ষিক স্বাধীনতা ভোগ করছে এবং তার কোনো কোনো সদস্য এ সুযোগে ব্যক্তিগতভাবে ভাড়াটিয়া খুনি হিসেবে কাজ করছে। এ অভিযোগ অনেক পুরনো। কিন্তু সাহস করে কেউ বলতে পারেননি। মানহানির মোকদ্দমা অথবা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাহানির জন্য রাষ্ট্রদোহিতার মামলা হতে পারে এই ভয়ে অনেকেই নীরব থেকেছেন। কিন্তু বাস্তব ঘটনা প্রকাশ হবেই। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় প্রকাশ পেল র্যাবের সদস্যরা কীভাবে সাত খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল।
র্যাবের জড়িত থাকার ঘটনাটি প্রথমে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী তিরস্কার পর্যন্ত করেছিলেন। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে র্যাবের কর্মকর্তারা ধরা পড়েন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল আশঙ্কা করছেন অদূর ভবিষ্যতে র্যাবের দুষ্কর্মকে আরও ভালোভাবে আড়াল করা হবে, র্যাবকে প্রটেকশন দেওয়া হবে। র্যাবকেও আর প্রশ্ন শুনতে হবে না। জবাবদিহিও করতে হবে না। একটি নিবন্ধে তিনি বলেছেন, "র্যাবের অবশ্য ভয় নেই। এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না তাদের। এমনকি এসব প্রশ্ন শুনতেও হবে না ভবিষ্যতে আর। কারণ এসব নিয়ে কথা বলার ক্ষমতা বেশি দিন থাকবে না গণমাধ্যমের। তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা, সম্প্রচার নীতিমালা, মানহানি আর রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার অভিনব সম্প্রসারণ আরও বেশি কণ্ঠরোধ করবে গণমাধ্যমের। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে র্যাবের কর্তারা ধরা পড়েছেন। র্যাবের সেই ভয়ও কাটবে দ্রুত। নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর তিরস্কার শুনেছেন হাইকোর্ট, অভিশংসনের ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী শাসিত সংসদের হাতে চলে এলে তিরস্কারের প্রয়োজনও ফুরাবে।"
এখন যা চলছে তা আর যাই হোক গণতন্ত্র নয়। কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড সৈয়দ আবু জাফর আহমদ এটাকে বলেছেন, 'কর্তৃত্ববাদী শাসন'। সাম্প্রতিক সময়ের সরকারি স্বৈরাচারের কয়েকটি উদাহরণ টেনে তিনি বলেছেন, 'ফ্যাসিবাদ বললে হয়তো অতিকথন হবে, কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর ভেতর ক্রমেই ফ্যাসিবাদী প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।' (সিপিবির মুখপত্র একতার ৭ সেপ্টেম্বরের সংখ্যা)।
সাম্প্রতিক সময়ের যেসব ঘটনা তিনি উল্লেখ করেছেন তা জানা বিষয় হলেও প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। "৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ২৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভেঙে শপিংমল ইত্যাদি নির্মাণের প্রতিবাদে বেইলি রোডে ছাত্র-শিক্ষক অভিভাবকদের সমাবেশ ছিল। পুলিশ তা করতে দেবে না, মাইক কেড়ে নিয়ে গেল, মাইকের তার ছিঁড়ে দিল। কয়েক দিন আগে কামরাঙ্গীরচরে জলাবদ্ধতার বিরুদ্ধে এলাকাবাসী মানববন্ধন করবে। পুলিশ তাও করতে দেবে না। গত মাসে তোবা গার্মেন্টের শ্রমিকদের অনশন ধর্মঘট ভাঙার জন্য পানি, বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে পিপার স্প্রে (বন্য জানোয়ারদের ওপর তা প্রয়োগ করা হয়) করে, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে, মালিক, পুলিশ ও ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হামলা যা অতীতের বর্বরতার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।"
শাসকশ্রেণির বর্বরতা, হিংস্রতা, মিথ্যাচার, নৃশংসতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় 'সম্প্রচারনীতি' ও সংসদ কর্তৃক বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা, তাহলে অধ্যাপক আসিফ নজরুল যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, সেটাই সত্য হবে। গণতন্ত্রের লেশটুকুও থাকবে না।
একটা প্রশ্ন আমার মনে প্রায়ই জাগে। হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট এখন মোটামুটি সরকারের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। মিডিয়ার অধিকাংশের মালিক সরকারপন্থি। তাহলে এ দুটোকে দমন করার দরকার কী? অনেক ভেবেছি। এ প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত এই যে, সরকার কারও ওপরই সামান্যতম ভরসা করতে পারছে না। কোনো সরকারের গণভিত্তি যখন একেবারে শূন্যের নিচে নেমে যায় তখনই এ অবস্থা তৈরি হয়। দ্বিতীয়ত, সরকারের নৈতিক মনোবল একেবারেই নেই। ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার যে গায়ের জোরে ক্ষমতায় আছে, তা দেশবাসীও যেমন জানে, বিশ্ববাসীও তেমনি জানে। ফলে সরকারের নৈতিক ভিত্তি একেবারে দুর্বল। এ অবস্থায় সরকারকে নির্ভর করতে হয় র্যাব, পুলিশ, আমলা আর দলীয় মাস্তানদের ওপর। এ সুযোগটা তারাও নেয়। ফলে দুর্নীতি, স্থানীয় পর্যায়ে বেপরোয়া লুটপাট ও সন্ত্রাস স্বাভাবিকভাবেই বিস্তার লাভ করবে। হয়েছেও তাই।
এ ধরনের সন্ত্রাস চালিয়ে বহুদিন ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল সুহার্তো বা ইরানের শাহ অথবা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক শাসক। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের তুলনা চলে না। প্রথমত, ওইসব দেশ এমনিতেই ধনী দেশ। তেল সম্পদে ভরা। বাংলাদেশে সেরকম প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। তা ছাড়া জনসংখ্যাও বাংলাদেশে বেশি। এখানে জনগণকে ভাত-কাপড়ে খুশি রাখাও কঠিন। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের আছে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য যা ওইসব আরব দেশের ছিল না। ফলে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী ধরনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে আরও ২০ বছর রাজত্ব করবে এমন ভাবনা যে শাসকরা করছেন, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।
এ কথা ঠিক, এখন কোনো শক্তিশালী বিরোধী দল নেই। বিএনপি সর্ববৃহৎ বিরোধী দল হওয়া সত্ত্বেও মাঠের আন্দোলন করতে পারছে না। না পারারই কথা। কারণ জনগণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে পাল্টাপাল্টিভাবে নির্বাচিত করলেও বিএনপি এমন কোনো জনপ্রিয় দল নয় যে, তার জন্য জীবন বাজি রেখে মানুষ রাস্তায় নামবে। শ্রেণি চরিত্রগতভাবে উভয়ই এক। সবই ধনিক শ্রেণির দল। সাধারণ মানুষের দাবি-দাওয়া, জীবন-জীবিকা ও দুঃখ-কষ্ট থেকে তারা অনেক দূরে। দুটোই দুর্নীতিবাজ। আর যে গণতন্ত্রের কথা বলে তারা এখন গলা ফাটাচ্ছেন, সেই গণতন্ত্র তাদের আমলেও ছিল না। র্যাব তাদেরই সৃষ্টি। ক্লিনহার্ট অপারেশনের নামে তারাও যৌথবাহিনীর হেফাজতে মানুষ মেরেছে, বর্বর নির্যাতন চালিয়েছে। আবার সেই নির্যাতনকারীদের রক্ষা করার জন্য বেগম খালেদা জিয়া পার্লামেন্টে দায়মুক্তির আইন পাস করেছিলেন। সেই খালেদা জিয়াকে কি গণতন্ত্রী বলতে হবে? পদ্মা সেতুর মহা কেলেঙ্কারির কথা উঠেছে (যদিও আজ্ঞাবহ মেরুদণ্ডহীন দুদক সব আসামিকে নির্দোষ বলেছে) বলে কি হাওয়া ভবনের কেলেঙ্কারির কথা ভুলে যেতে হবে? হ্যাঁ, এখন গুম, খুন, নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। তাই প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসা গণবিরোধী সরকারের অপসারণ দরকার। কিন্তু তার বিকল্প নয় বিএনপি। বিকল্প হতে হবে তাদেরই যাদের ভাবমূর্তি পরিষ্কার, যারা সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। অর্থাৎ সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় আস্থাশীল, যারা জনগণের, বিশেষ করে গরিব শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারবে, এমন শক্তিকেই। সেই শক্তি এখনো তেমনভাবে দৃশ্যমান নয়। কিন্তু এ ছাড়া আর বিকল্পও নেই।
আওয়ামী লীগ তো বটেই, এমনকি বিএনপিতেও এক সময় সংগ্রামী কর্মীদের সমাবেশ ঘটেছিল। একদা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে কিছুটা আদর্শবাদের স্পর্শ ছিল- জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ। বিএনপি যদিও সেনা ছাউনি থেকে সৃষ্ট, তবু এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারও রূপান্তর ঘটেছিল। কিন্তু নব্বই পরবর্তী সময়ে উভয় দলেরই নৈতিক অবনতি ঘটেছে। পালাক্রমে ক্ষমতায় থেকে তাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয়েছে। উভয় দলের শীর্ষে ও তৃণমূলে জমায়েত হয়েছে সুবিধাভোগীরা। এ প্রসঙ্গে গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বাংলাদেশ প্রতিদিনের উপ-সম্পাদকীয় কলামে কাজী সিরাজ যথার্থই লিখেছেন, "... রাজনীতি এ দেশে এখন আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই, চলে গেছে অরাজনৈতিক ব্যক্তি, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, কালো টাকার মালিক, অসাধু ব্যবসায়ী এবং গডফাদারদের হাতে। দেশে চলছে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি। চলছে বেপরোয়া 'বাজিকরী'। রাজনীতি যাতে আর কখনোই রাজনীতিবিদদের হাতে বা নিয়ন্ত্রণে ফিরে না আসে তা-ই যেন নিশ্চিত করতে চাইছে দেশের প্রধান দুই দল- আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।"
এ প্রবণতাকে রুখতে হবে। শাসকগোষ্ঠীর ভয়ঙ্কর ফ্যাসিবাদী প্রবণতাকেও পরাজিত করতে হবে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি ব্যতীত নতুন বিকল্পের কথা ভাবতে হবে। যারা সাহসের সঙ্গে, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে স্বৈরাচারকে মোকাবিলা করে গড়ে তুলবে নতুন ধারার গণমানুষের রাজনীতি। সেই রাজনীতির উদ্বোধন ঘটুক।
লেখক : রাজনীতিক।