বর্তমান সময়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে আলোচিত নাম হলো ইমরান খান। রাজনীতিতে তিনি সমাদৃত, সমালোচিত এবং বিতর্কিত। কিন্তু ক্রিকেট তারকা হিসেবে তিনি শুধু সমাদৃতই ছিলেন দেশে-বিদেশে। ফাস্ট অর্থাৎ দ্রুতগতির বোলার হিসেবে তার খ্যাতি ছিল পৃথিবীর ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে। ভালো ব্যাটিংও করতেন এবং সেই তার সময়ে ইমরান ছিলেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ 'অলরাউন্ডার'। তবে বোলার হিসেবেই তার ছিল মূল পরিচয়। এই বোলিং ইমরানকে দিয়েছিল সীমাহীন প্রশংসা। তার বোলিংশৈলীর একটি আকর্ষণ ছিল 'বাউন্সার' বল। মাঝে মাঝে 'সুইং' বল করলেও ক্রিকেট তার সফল উত্তরসূরি ওয়াসিম আকরাম সেই 'সুইং' আরও ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন। কিন্তু 'বাউন্সার' বলে ইমরান ছিলেন প্রায় অদ্বিতীয়। পৃথিবীর সেরা ব্যাটসম্যানরা এই বলে ভীত থাকতেন। ইমরানের মুখ্য অস্ত্র ছিল এই 'বাউন্সার'- যা তিনি সব সময় ব্যবহার করতেন না। মোক্ষম সময়ে এর ব্যবহার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বেশ কার্যকরী হয়েছে। এমনকি বলকে মোকাবিলা করতে গিয়ে দক্ষ ব্যাটসম্যানরা বিভিন্ন 'পয়েন্টে' ক্যাচ দিয়ে আউট হয়েছেন। দীর্ঘ ক্রিকেট জীবনে তিনি খ্যাতিই অর্জন করেছেন।
কিন্তু ক্রিকেট খেলা আর রাজনীতি এক নয়। যদিও বিভিন্ন পেশার খ্যাতিমান ব্যক্তিরা রাজনীতিতে এসে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়তো ব্যর্থ হয়েছেন, কেউ কেউ আবার যথেষ্ট সাফল্যও পেয়েছেন। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে রোনাল্ড রেগান থেকে শুরু করে ভারতের দক্ষিণ রাজ্য তামিলনাডু ও অন্ধ্রপ্রদেশের এমজি রামচন্দন, এনটি রামরাও কিংবা জয়রাম জয়ললিতারা রাজনীতিতে এসে সফল হয়েছেন- যেভাবে সাফল্য পেয়েছিলেন অভিনয়ের জগতে। ভারতের ২০১৪ সালের নির্বাচনে অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী, সংগীত শিল্পীরা সংসদ সদস্য হয়েছেন। এপ্রিল-মে মাসের এই নির্বাচনে সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রার্থী ছিলেন এক সময়ের 'ড্রিম গার্ল' বলে পরিচিত হেমা মালিনী। তিনি উত্তর প্রদেশের হিন্দু ধর্মের পবিত্র শহর মথুরা থেকে নির্বাচিত হয়েছেন বিজেপির প্রার্থী হয়ে। আমি সেই নির্বাচনের আগে ভোট ও রাজনীতি পর্যবেক্ষণের জন্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে মথুরায়ও গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি মথুরায় যদি হেমা মালিনীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। আগ্রা থেকে দিলি্ল যাওয়ার পথে সেখানে গিয়ে হেমার সন্ধান আমি পাইনি। তিনি নির্বাচনী এলাকা গ্রামাঞ্চলে ছিলেন। শুনেছি হেমাও নির্বাচনী জনসভায় দাবি করেছেন যে রাজনীতিতেও তিনি সাফল্য পাবেন। তবে তারা অনেকেই জয়ী হয়েছেন 'মোদি ঝড়ের' কারণে। এটাকে রাজনীতিতে সফলতা বলা যায় না। কৃতিত্ব স্বাভাবিকভাবেই দাবি করছেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি 'টি বয়' অর্থাৎ চা-বিক্রেতা থেকে আজ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের সরকারপ্রধান। ঘুরে বেড়াচ্ছেন বড় বড় দেশ- ব্রাজিল, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সত্যিকারের রাজনীতিই মানুষকে শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। আবার জনকল্যাণবিহীন আদর্শচ্যুত রাজনীতি সাফল্যের উচ্চশিখর থেকে ধরাশায়ী করতে পারে। এক্ষেত্রে ভুল, গর্ব, অহমিকা এবং স্বার্থান্বেষী রাজনীতি এমনি করুণ পরিণতিতে অবদান রাখে। রাজনীতিতে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। অন্য পেশায় অনেক কিছু বলা যায়। অবশ্য, রাজনীতি পেশা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়, যদিও বলা যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটাও হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি হবে একটি জনকল্যাণমূলক 'মিশন'- সেখানে দেওয়ার রয়েছে, পাওয়ার সুযোগ কম। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেটা হচ্ছে কি?
পাকিস্তানের রাজনীতির অধুনা আলোচিত ব্যক্তি ইমরান হয়তো রাজনীতির বিচিত্র গতিপথ সেভাবে অনুধাবন করতে পারেননি। ক্রিকেটের অবিশ্বাস্য খ্যাতি এবং ব্যক্তিগত জীবনের অশান্তির পর তিনি হয়তো ভেবেছিলেন যে রাজনীতি তাকে গুরুত্ব ও সান্ত্বনা দেবে। হয়তো তিনি বেশ কিছু রাজনীতি থেকে পেয়েছেনও। কিন্তু এবারের সরকার পতনের আন্দোলন রাজধানী ইসলামাবাদে সমর্থকদের নিয়ে দিনের পর দিন সংগ্রাম চালিয়ে সম্ভবত ইমরান এখন ক্লান্ত। অনেকটা একই অবস্থায় আছেন ধর্মীয় নেতা থেকে রাজনীতিবিদে রূপান্তরিত কানাডাবাসী তাহিরুল কাদরী। কাদরী পাকিস্তানের গত বছরের মে মাসের নির্বাচনের আগে কানাডা থেকে দেশে ফিরে এসে আলোচনায় এসেছিলেন। তবে তিনি সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। তার বেশ সমর্থক ও অনুরাগী আছে পাকিস্তানে। এবার গত মাস অর্থাৎ আগস্টে সরকার পতনের লক্ষ্যে ইমরান খানের সঙ্গে যৌথ না হলেও সমান্তরাল আন্দোলনে অবতীর্ণ হন। উভয়েই সমর্থকদের নিয়ে লাহোর থেকে ইসলামাবাদে গিয়ে অবস্থান নেন। এক সময় মনে হয়েছে নওয়াজ শরিফের সরকার রোধহয় আর নেই। উল্লসিত হয়েছেন ইমরান-কাদরী। কিন্তু সেটাও আর হয়নি। স্তিমিত হয়ে উঠেছে সেই আন্দোলন। প্রতীয়মান হচ্ছে যে প্রাণে পানি পেয়েছেন নওয়াজ শরিফ। পার্লামেন্টে বড় সংখ্যা গরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও এবং মাত্র ১৫-১৬ মাস ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও তার সরকারের এমনি অবস্থা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু পরিবার নিয়ে আগের মতো দুর্নীতি, অনেকটা অদক্ষতা এবং মানুষের কল্যাণে কাজ করার মতো নেতৃত্বের অপ্রতুলতাই নওয়াজ সরকারকে এই পরিস্থিতিতে নিয়ে এসেছে। শক্তিশালী সেনাবাহিনী অনেক কিছু বিবেচনা করে হয়তো সরকারকেই শেষ পর্যন্ত সমর্থন দিয়েছে যদিও এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে। তা সত্ত্বেও সরকার বেঁচে গেলেও দুর্বল হয়েছে। দেশের ক্ষতি হয়েছে। সরকার-বিরোধী আন্দোলনের জন্য শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টরা পাকিস্তান সফর স্থগিত করেছেন। বড় কথা চীনের প্রধানমন্ত্রীর নির্ধারিত সফরটি বাতিল হওয়ায় পাকিস্তান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইমরানের দল পিটিআই গত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং আগের তুলনায় বেশ ভালো করে যদিও মুসলিম লীগ (নওয়াজ) ও পিপলস পার্টির পরে তৃতীয় অবস্থানে আছে। তখন ইমরান কোনো বড় ধরনের কারচুপির অভিযোগ তোলেননি। পার্লামেন্টের অধিবেশনে তার দল অংশ নিচ্ছে। তাহলে এখন কেন ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলে সরকারের পদত্যাগের দাবি? রাজধানী ইসলামাবাদে বেশ কয়েক হাজার সমর্থককে নিয়ে অবস্থান নিলেও দেশের অন্যান্য স্থানে আন্দোলনের নমুনা প্রত্যক্ষ করা যায়নি। সেনাবাহিনীর কিছু বক্তব্য বিভ্রান্তির সৃষ্টি করলেও কোনো চাঞ্চল্যের কারণ হয়নি। তাহিরুল কাদরীর পিএটি দল নতুন এবং অনেকটাই ধর্মীয় অনুভূতির উপর নির্ভরশীল। রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে ধর্মের সম্পৃক্ততা বাঞ্ছনীয় নয়। তথাপি বাস্তবতা হলো ধর্মের ভূমিকা অনেক সময় কার্যকর হয়ে যায়। ভারতে বিজেপির বড় জয়ে ধর্মীয় আবেদন যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলো এতে শঙ্কিত হলেও মোদি তার সাম্প্রদায়িকতার 'ইমেজ' সত্ত্বেও সেদিকে তোয়াক্কা না করে হিন্দু জাতীয়তাবাদীতেই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং নির্বাচনে সাফল্য অর্জন করেছেন। তাহিরুল কাদরী সেটা পারেননি। মোদিদের আছে অভিজ্ঞতা ও কৌশল। কাদরীদের সেটা নেই।
ইমরানের একটি 'প্লেবয়' ইমেজ ছিল সেই সময় থেকে যখন তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন। সুদর্শন ইমরানের সর্বোচ্চ সাফল্য হলো পাকিস্তানকে তার নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জয়ে সফল করা। বাংলাদেশে যেমন ক্রিকেটের জন্য তার অনুরাগী আছে, আবার বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্যের জন্য তিনি নিন্দিত হয়েছেন খুবই প্রত্যাশিতভাবে। এটা অপরিপক্বতারই নামান্তর।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে ইমরানের সমর্থক নেই তা নয়। বেশ বড় সংখ্যক তরুণ-তরুণী তার অনুরাগী। তিনি দুর্নীতি-বিরোধীনীতি অবস্থান নিয়েও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। তবে রাজনীতিতে ধাতস্থ হননি। কিন্তু যেভাবে হঠাৎ করে সরকার পতনের আন্দোলনে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন, এতে অনেকেই বিস্মিত হন। একই সঙ্গে প্রায় একই ধরনের দাবি নিয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন তাহিরুল কাদরী। ইমরানের দলের সাবেক প্রধান জাভেদ হাশমীর মতে ইমরান-কাদরী হয়তো আশ্বাস পেয়েছিলেন যে, সেনাবাহিনী এক সময় হস্তক্ষেপ করবে। বিভিন্ন কারণে আগে এবং বর্তমানেও নওয়াজ শরিফের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক ভালো নয় এবং সে কারণে হয়তো এমনি ধারণার উদ্রেক হয়েছিল। এই সময়ে সাবেক শাসক ও প্রধান বিরোধী দল পিপিপির সমর্থন নওয়াজকে সাহায্য করেছে।
পাকিস্তানের রাজনীতির অস্থিরতা হ্রাস পেয়েছে, তবে নিরসন হয়েছে মনে করা ঠিক হবে না। গত নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ এবং ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা ও একটি 'কেয়ারটেকার' সরকারের অধীনে ভোট হওয়া সত্ত্বেও সরকারের দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণেই আজ এমনি পরিস্থিতি। ইমরানের 'বাউন্সার' বল রাজনীতিতে কার্যকরী হয়নি বলেই হয়তো টিকে গেল নওয়াজ শরিফ সরকার। ইমরান এখন কি বলে আবার শান দিচ্ছেন?
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশ্লেষক।