প্রতিদিন নতুন নতুন খবর, নতুন নতুন আলোচনা-সমালোচনা নানা সন্দেহ দানা বাঁধছে সাধারণ মানুষের মনে। এই সেদিন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি আজীবন কারাবাসে বদল হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছে এটা একটা চালাকি, জামায়াতের সঙ্গে ভবিষ্যৎ দেন-দরবারের রাস্তা খোলা রাখা। কেউ কেউ ভাবছে অন্য কিছু। চালাকরা চালাকি করবে এটাই স্বাভাবিক। আশার কথা, এখন সাধারণ মানুষও অনেক চালাকি ধরতে পারে। যে যাই বলুক, প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সবাই চায়। এক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে যেমন, তার চেয়ে দলীয় পর্যায়ে অনেক বেশি খুন-খারাবি, অন্যায়-অবিচার হয়েছে তার বিচার হওয়া দরকার। কিন্তু আদৌ হবে কিনা তা শুধু ক্ষমতাবানরাই জানেন। ক্ষমতাবানরা যে তাদের সুবিধামতো যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তামাশা করছেন এবং অনেক অযোগ্য আইনজ্ঞকে দিয়ে কৌশলে এগিয়ে চলেছেন তা প্রায় সবার কাছে স্পষ্ট। টিভিতে নারী-পুরুষের সুন্দর মুখ দেখালেই চলে না। রায় শুনে সরকার পক্ষের কেউ মূর্ছা গেলেই তিনি যে খুব আন্তরিক এবং দক্ষ তা বলা যায় না। আর কার ফাঁসি হবে, কার জেল হবে বা কে মুক্তি পাবে গণঅধমদের মতো কেউ নির্দেশ করতে চায় না। বিচারে যা হওয়ার তাই হবে। কোনো পূর্ব ধারণা থেকে কাউকে কোনো শাস্তি দেওয়া এটাও কেউ আশা করে না। যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত সবার যে মৃত্যুদণ্ড হবে তাও ঠিক নয়, সেটা কোনো বিচারও নয়। কেউ কেউ অভিযোগ থেকে রেহাই পাবে এটাই বিচার। আর দোষী সাব্যস্ত হলেই সবার মৃত্যুদণ্ড হবে তেমনও নয়। আমরা প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের সত্যিকারের তুলাদণ্ডে মাপা ফাঁকফোকর ছাড়া ন্যায়বিচার চাই। মুক্তিযুদ্ধে যেমন অসম্ভবকে সম্ভব করেছি, ঠিক তেমনি শত চাপ প্রলোভনের মধ্যেও সারা দুনিয়ার কাছে গর্ব করার মতো মানসম্মত বিচার চাই। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, সর্বোচ্চ শাস্তিও চাই। কিন্তু সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে শর্টকাটে জীবন যন্ত্রণা থেকে তাদের মুক্তি দেওয়ার পক্ষে নই। তারা কেউ কেউ বেঁচে থেকে তিলে তিলে সারা জীবন কলঙ্কময় জীবন ভোগ করুক এমনটাও অনেকে চায়।
যাক, আজ 'বাহিরে খন্দকার, ভেতরে মোশতাক' এবং মুক্তিযুদ্ধে তার খেতাব নিয়ে আলোচনা করি। এ কে খন্দকার আমাদের অনেকের কাছে এক সময় মাথার তাজ ছিলেন। থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ায় তিনি এখন বড় বেশি নিন্দিত হচ্ছেন। এখনো আমি যেমন তাকে পাকিস্তানি দালাল মনে করি না, তেমনি খুব বেশি মুক্তিকামী স্বাধীনতাপ্রেমীও মনে করি না। মুক্তিযুদ্ধে হানদারদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা না করায় পাকিস্তানিদের কাছে এ কে খন্দকার অবশ্যই অপরাধী, আমাদের কাছে নয়। '১৯৭১ : ভেতরে বাইরে' লিখে আমাদের জাতীয় শৌর্যবীর্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কলঙ্কিত বা বরবাদ করায় প্রচলিত আইনে যদি বিচার হয়, হতেই পারে। এ জন্য তিনি পাকিস্তানের দালাল হবেন কেন? যুদ্ধাপরাধী হবেন কেন? তিনি বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়ে কোরআন স্পর্শ করে পাকিস্তান রক্ষার শপথ করেছিলেন। কিন্তু তা না করে অপরাধ করেছেন পাকিস্তানের কাছে, আমাদের কাছে নয়। মুক্তিযুদ্ধে যতটুকু করেছেন তাতে তিনি আমাদের প্রশংসার পাত্র। এ জন্য তার সারা জীবন সম্মান পাওয়া উচিত। তার ২৩২ পৃষ্ঠার বই এক-দুবার নয়, বেশ ক'বার পড়েছি। যেহেতু '১৯৭১ : ভেতরে বাইরে' নিয়ে 'বাহিরে খন্দকার, ভেতরে মোশতাক' নামে একটি বই লিখছি, সেহেতু তার বইটি মেয়েদের উকুন বাছার মতো লাইনে লাইনে চিহ্ন করার চেষ্টা করেছি। কেউ কেউ তার খেতাব কেড়ে নিতে চায়, কেউ তাকে মুক্তিযোদ্ধা থেকে বাদ দিতে চায়, তা চাইতেই পারে। চাইতে আর দোষ কি? আসমান থেকে কমলা খাওয়ার কারও শখ হলে হতেই পারে, সেটা বাস্তব কিনা বিচার করে দেখতে হবে। আমি তার বীরউত্তম খেতাব নিয়ে আলোচনা করতে চাই। আগে মনে করতাম এ কে খন্দকার মুক্তিযুদ্ধে না জানি কত কী করেছেন। সেনা, বিমান, নৌবাহিনীর মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ হওয়ায় তার আরও বড় কিছু পাওয়া উচিত ছিল। এ ক'বছরে তার কাছে নিজেকে বেশ হীনমন্য মনে করতাম। আমার থেকে ১৭ বছরের বড়, আমি যে বছর জন্মেছি সে বছর তিনি মেট্রিক পাস করেছেন। মেট্রিক আবার এখন অনেকেই বুঝবে না। এখন মেট্রিকের জায়গায় SSC। আইএ, আইকম, আইএসসি এর স্থলে HSC। তাই সব সময় মনে হতো জনাব খন্দকারও বীরউত্তম, আমি লাচার, আনপর, এক সময়ের সেনাবাহিনীর সামান্য সিপাই কী করে বীরউত্তম হই। এখন দেখছি আমাদের সঙ্গে বড় জালিয়াতি করা হয়েছে, ভীষণ ঠকানো হয়েছে সাধারণ যোদ্ধাদের, নির্মমভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে জনসাধারণকে। এর কোনো বিচার হবে এখন আর তেমনটা আশা করি না। কিন্তু এ কে খন্দকার বই লিখে আমাদের প্রতি, গণমানুষের প্রতি যে অন্যায় করেছেন সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বসূচক খেতাবের কাইটেরিয়া ছিল, যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে সাহসী ভূমিকা রাখবে তাকে শ্রেণীমতো খেতাব দেওয়া হবে। সাহসিকতা বিবেচনায় যাকে যে খেতাবই দেওয়া হোক প্রধান শর্তই হবে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ। সেটা শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত অথবা শত্রুকে আক্রমণ করে নাস্তানাবুদ করে যেভাবেই হোক। মূল কথা প্রত্যক্ষ যুদ্ধ। যে কারণে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি এমএজি আতাউল গনি ওসমানীকে বীরত্বসূচক খেতাব দেওয়া হয়নি বা তিনি নেননি। খেতাব পাননি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রী পরিষদ সদস্য ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক, একজন MNA, MP-কেও দেওয়া হয়নি। যুবনেতা সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, কে এম ওবায়দুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক খেতাব পাননি। ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আসম আবদুর রব, আবদুল কদ্দুস মাখন কাউকে দেওয়া হয়নি। প্রত্যক্ষ যুদ্ধ ছাড়া বীরত্বসূচক খেতাবের প্রশ্ন এলে ওই সময়ের MNA, MP যারা পাকিস্তানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল তারা ছাড়া সবাইকে খেতাব না দিয়ে উপায় কোথায়? ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন আরও যারা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ছিল তাদের কেন্দ্রীয় কমিটির সবাইকেসহ সব জেলা শাখার অন্তত সভাপতি সেক্রেটারিকে অবশ্যই খেতাব দিতে হয়। ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক চট্টগ্রামের স্বপন, ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সেক্রেটারি বা সভাপতি দাউদকান্দির দাশপাড়ার নজরুল এদের খেতাব না দিয়ে উপায় কী? সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তিনি কেন পাননি? এ জন্য পাননি বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক এ বীরত্বসূচক খেতাবগুলো দেওয়া হয়েছে প্রত্যক্ষ যোদ্ধাদের। যারা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন তাদের। ২৩২ পৃষ্ঠার খন্দকারের বইয়ে কোথাও তার সরাসরি কোনো যুদ্ধে অংশ নেওয়া, এমনকি কোনো যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাওয়ারও তো কোনো ঘটনা দেখলাম না। তাহলে তিনি খেতাব পেলেন কী করে? নাকি নিজে খেতাব বিতরণ কমিটির সভাপতি ছিলেন, তার জুনিয়ররা কমিটিতে ছিলেন বলে নিজেরটা নিজেই বাগিয়ে নিয়েছেন? এমন তো হওয়ার কথা নয়। তিনি লিখেছেন, ৪ঠা মার্চ ১৯৬৯ পর্যন্ত একনাগাড়ে ২০ বছর পাকিস্তানে থেকে স্কোয়াড্রন লিডার হিসেবে ঢাকার দায়িত্ব নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। এর আগে বাঙালির গৌরব '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৫৪-র যুক্তফ্রন্টের বিজয়, '৬৬-র ৬ দফা, '৬৯-র ১১ দফা ও গণঅভ্যুত্থানের কিছুই জানতেন না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় লাখো মানুষ সংগ্রাম করে জেলের তালা ভেঙে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে এর কিছুই নাকি তার জানা ছিল না। সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদও তার 'শান্তির স্বপ্নে' বইয়ে '৭১-এর অক্টোবরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকা আসার আগে বাংলাদেশে কী হয়েছে তার কিছুই জানতেন না। মানে সব এক গোয়ালের গরু। মইন ইউ আহমেদের বই থেকেই আগামী পর্বে কিছু তুলে দেব। তার বীরউত্তম খেতাবে বলা হয়েছে- "আব্দুল করিম খন্দকার (এ কে. খন্দকার) ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে গ্রুপ ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন। পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজিত কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান বাতিল এবং তৎপরবর্তীতে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে তিনি অধীনস্থ এমওডিসি কমান্ডারের মাধ্যমে বাঙালি এমওডিসিদের ছুটি নিয়ে এবং সম্ভব হলে অস্ত্রসহ মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে ঘটে যাওয়া আরও কিছু ঘটনায় তিনি পাকিস্তানিদের মনোভাব বুঝতে পেরে বিদ্রোহ করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ২৫ মার্চ রাতের ক্র্যাক ডাউনের পর দুই দিনের ছুটি নিয়ে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ১৫ মে তিনি উইং কমান্ডার বাশার, স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দিন, ফ্লাইট লে. সুলতান, ফ্লাইট লে. কাদের, এক্স ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজা ও ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলমসহ আগরতলা গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে একটি বিমান বাহিনী গঠনের উদ্দেশে তিনি ১৯-২০ মে দিলি্ল যান। সময় আসলে সাহায্য করা হবে- এ আশ্বাসে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক সহায়তা প্রদানে অক্ষমতা প্রকাশ করলে মে মাসের শেষদিকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে তিনি স্থলযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিবাহিনীর জন্য রিক্রুটমেন্ট ট্রেনিং, ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র করে বিভিন্ন সেক্টরে প্রেরণ করা ছিল তার প্রধানতম দায়িত্ব। তিনি অত্যন্ত কুশলতা, দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এ দায়িত্ব পালন করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। পূর্ণাঙ্গ সশস্ত্র বাহিনী গঠনের প্রশ্নটিকে সামনে রেখে ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতের নাগাল্যান্ড ডিমাপুরে গঠন করেন বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে এ বাহিনীকে তিনি অত্যন্ত সফলভাবে ব্যবহার করেন। উন্নততর যুদ্ধ পরিকল্পনা ও কৌশল প্রয়োগ করে নিখুঁত নিশানায় বোমাবর্ষণ করে শত্রুবাহিনীর সরবরাহ লাইন ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হন। ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেন।
যুদ্ধের রসদ সংগ্রহ, বহিঃবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ, যুুদ্ধ কৌশল নিয়ে বন্ধুপ্রতিম দেশের সেনাপ্রধানদের সঙ্গে মতবিনিময়, সর্বোপরি সার্বিক যুদ্ধ পরিচালনায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে 'বীর উত্তম' খেতাবে ভূষিত করা হয়।"
জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত গরিব মানুষের রক্ত পানি করা টাকা ধ্বংস করে নাপাক হানাদার জল্লাদ বাহিনীকে কত টাকা খেয়ে পাকবাহিনী লিখেছেন তা শুধু আল্লাহ পাকই জানেন। এসব পণ্ডিতের কাছে খুন-খারাবি, নারী ধর্ষণ করেও হানাদাররা পাক, আমরা মুক্তিযোদ্ধারা মনে হয় নাপাক। 'একাত্তরের বীরযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় জীবনগাথা খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা স্মারকগ্রন্থে' যেভাবে তার বীরউত্তম খেতাব নিয়ে লিখেছেন, সেখানে কোথাও কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা নেই। কথা আছে, দু'চারজনকে তিনি যুদ্ধের আগে পরামর্শ দিয়েছেন। ১৫ মে ভারতে গিয়ে ১৯ মে পায়ে হেঁটে নয়, বিমানে চড়ে দিলি্ল যান। মাঝখানে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করেন, ট্রেনিং দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠান- এসব তো আরও অনেকেই করেছে। বারাঙ্গাপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে বর্তমান ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান প্রায় ৩০ হাজার যুবককে রক্ষণাবেক্ষণ, দেখাশোনা করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। তাহলে তাকে কেন দেওয়া হলো না? তিনি সবসময় রণাঙ্গনের কাছাকাছি থেকেছেন। যে ১৫ মে তিনি ভারতে গেছেন তার ৩ দিন আগে ১২ মে আমরা বল্লার যুদ্ধে হানাদারদের তছনছ করে দিয়েছিলাম। সে যুদ্ধ শুধু পরিচালনা করিনি, নিজে করেছি। ভদ্রলোক ১৬ ডিসেম্বর আমাদের দখল করা ঢাকায় হেলিকপ্টারে উড়ে এসে সন্ধ্যার আগেই আবার ভারত চলে গেলেন, তিনিও বীরউত্তম, আর আমিও বীরউত্তম। এ কেমন বিচার? একে কোন ন্যায়বিচার বলে? এ তো ন্যায়বিচার হতে পারে না, এসব তো ঘোরতর অন্যায়। ২৫ মার্চের বেশ ক'দিন আগে থেকেই ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিক ছোটাছুটি করছিলেন। সাধ্যমতো যা করা সম্ভব তা করেছেন। জনাব জিয়াউর রহমানকে যুদ্ধে অংশ নিয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার অনুরোধ জানাতে গিয়ে পাগল ছাগল গালি শুনে অপমানিত হয়ে ফিরেছিলেন। ৪ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২ কোম্পানিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সেখান থেকে হবিগঞ্জের শমশেরনগর সীমান্তে নকশালী দমন করতে পাঠানো হয়েছিল। তারা ২৫ মার্চ নয়, দেশের অবস্থা দেখে তার আগেই তাদের কোম্পানির অবাঙালি কমান্ডার এবং অন্যদের বন্দী করে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। জনাব খন্দকারের কৃতিত্বে এসবের লেশমাত্র দেখছি না। বউ-পোলাপান নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করা, ১৯-২০ তারিখ দিলি্ল গিয়ে বিমানবাহিনী গঠন সম্পর্কে আলোচনা করে ভবিষ্যতে সময় সুযোগ হলে হবে আশ্বাস পাওয়া আর কলকাতা নিউমার্কেটে ঘুরার সময় সরকারের নির্দেশে হেলিকপ্টারে ঢাকায় আসা এবং ফিরে যাওয়া, এই কৃতিত্বে কী করে বীরউত্তম হন। বীরউত্তমের জন্য আরও কিছু করা বা বীরত্ব দেখানো দরকার, যার ছিটেফোঁটাও তো দেখছি না। কলকাতা থেকে পায়ে হেঁটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এলেও না হয় ভাবতাম চলি্লশোধর্্ব একজন মানুষ কষ্ট করে এসেছেন তাতে বীরউত্তম দিলেও না হয় সান্ত্বনা পাওয়া যেত। কিন্তু কোনো যুদ্ধে অংশ না নিয়ে খেতাব নেওয়া এ তো দেখছি একেবারে পুরোদস্তুর জালিয়াতি।
তিনি বীরউত্তম কেন বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব নিতেন। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানের সর্বজ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে যে কয়টা জেড ছিল, হেলিকপ্টার ছিল সব কয়টা নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে যেতেন, বীরউত্তম কেন, যা চাইতেন তাই নিতেন। তা কি গেছেন? যাননি। সবকয়টি বিমান উড়িয়ে দিয়ে যেতেন, সব কয়টা না পারতেন, দু-একটাতে আগুন ধরিয়ে দিতেন- কোনো আপত্তি করতাম না। আর কিছু না হোক একটা জেড-এ উঠে সীমান্তের কাছাকাছি প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে পড়ে বীরউত্তম হতেন। আর কিছু না পারতেন জেড এবং হেলিকপ্টারের তেলের ট্যাঙ্কে এক ছটাক করে চিনি দিয়ে যেতেন, তাও তো করেননি বা করতে পারেননি। তাহলে অমন জালিয়াতি কেন করতে গেলেন? বিমান বাহিনী নিয়ে লিখেছেন, সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখ বিমান বাহিনী গঠিত হয়, ৩ ডিসেম্বর বোমারু বিমান নিয়ে চট্টগ্রামে এবং অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার নিয়ে নারায়ণগঞ্জ তেলের ডিপোতে বোমা ফেলে তেলের ডিপো ধ্বংস করে দেন। সে কাজ তো তিনি করেননি, পাইলট সুলতান মাহমুদ, কো-পাইলট বদরুল আলম আর সার্জেন্ট শাহাবউদ্দিন বীরপ্রতীক করেছেন। সেখানে যে গল্প ফেঁদেছেন তা একেবারে অবিশ্বাস্য। এ যেন বাঙ্গালকে হাইকোর্ট দেখানোর প্রবণতা। শত্রুকবলিত দুই-আড়াইশ কিলোমিটার দিনেই আসা যেত না, ওভাবে রাতের অন্ধকারে শত্রুর পেটের ভিতর আসা যায়? কী করে অতটা এলেন? আর অতটা পথ পাড়ি জমিয়ে নিরাপদে বোমা ফেলে চলে গেলেন? এক জায়গায় বলেছেন, শীতলক্ষ্যা নদীর পানির উপর দিয়ে বিদ্যুতের তারের নিচ দিয়ে তার ক্যাডাররা হেলিকপ্টার চালিয়ে বাজিমাত করেছিল। ওটা রিকশা বা গরুর গাড়ি ছিল না, যে কোনো দিকে গেলে খবর থাকে না। লক বুক দেখলেই থলির বিড়াল বেরিয়ে আসবে। কবে কতক্ষণ কোনো বিমান, হেলিকপ্টার আকাশে উড়েছে সব রেকর্ড থাকে। সেই অভিযানের কথা ১২ ডিসেম্বরের পরে হলে না হয় মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর অভিযান হওয়ায় কেন যেন সন্দেহের সৃষ্টি হয়। অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারে ২ জন পাইলট, ৫ জন প্যাসেঞ্জার বহন করা যায়। হেলিকপ্টার লম্বা ৩৩ ফুট, পাখা ৩৬ ফুট ১ ইঞ্চি, উচ্চতা ১০-১১ ফুট। নিজস্ব ওজন ১১৪৩ কেজি। বহন করার ক্ষমতা সব মিলিয়ে ২২০০ কেজি। ফুল ট্যাঙ্ক তেল নেওয়া যায় ৫২৫ লিটার। সর্বোচ্চ স্প্রিড ২১০ কিমি। হেলিকপ্টার কখনো ১২০-৩০ নটিক্যাল মাইলের বেশি চালানো হয় না। একটানা পৌনে ৩ ঘণ্টা চলতে পারে। তাতে সর্বোচ্চ দূরত্ব পার করতে পারে ৫০০ কিমি। এই ধরনের হেলিকপ্টারে নারায়ণগঞ্জ এসে বোমা ফেলা বিশ্বাস করার মতো? তাও আবার শীতলক্ষ্যার পানির উপর ও বিদ্যুতের তারের নিচ দিয়ে হেলিকপ্টার চালানো কে বিশ্বাস করবে? তার চেয়ে বরং আগামী দু-এক মাসের মধ্যে জনাব খন্দকার একটা হেলিকপ্টার শীতলক্ষ্যায় বিদ্যুতের তারের নিচ দিয়ে চালিয়ে দেখিয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। প্রশ্নটা প্রথম প্রথম আমার মনেও আসেনি।
আড়াইহাজারের আমাদের প্রবীণ নেতা খোকন জসিম, সেদিন বলছিল বিদ্যুতের তারের নিচ দিয়ে কোনো সময় পাখি গেলে মাঝে মধ্যে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। সেখানে হেলিকপ্টার গেল কী করে? খোকন জসিমের প্রশ্নের উত্তর তো জনাব খন্দকারকে দিতেই হবে। কারণ প্রশ্নটা তো শুধু তার একার নয়।
লেখক : রাজনীতিক।