'জাতীয়তাবাদের সীমা' শীর্ষক রচনাটি বাংলাদেশ প্রতিদিন ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। পাঠকের অনুরোধে লেখাটি ধারাবাহিকভাবে শুক্রবার রকমারি পাতায় পুনঃমুদ্রিত হচ্ছে। আজ ছাপা হলো ষষ্ঠ পর্ব-
আনন্দমঠ যখন বঙ্গদর্শনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় উক্তিটি কিন্তু তখন সেখানে ছিল না, এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় যোগ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাদ দেওয়া হয়েছে নবীনা-নন্দের রণধ্বনির স্বাভাবিক একটি অংশ, 'ইংরেজ মার, মার মার যবন মার।'৫ এটিকে স্বাভাবিক বলছি এই জন্য যে, ইংরেজকেই তো মারার কথা। যুদ্ধটা চলছিল ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষদের। নবীনা-নন্দের উক্তিটিতে যবন বলতেও ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজকেই বোঝাবে, কেননা মুসলমান তখন ক্ষমতায় নেই। শাসন ক্ষমতা ইংরেজ কোম্পানির হাতে। মীর জাফর নামে মাত্র শাসনকর্তা। ঔপন্যাসিকের নিজের ভাষায়, মীর জাফর তখন, গুলি খায় আর ঘুমায়। ইংরেজ টাকা আদায় করে ও ডেসপাচ লেখে। বাঙালি কাঁদে আর উৎসন্নে যায়।
বাঙালি অর্থ হিন্দু, অযথার্থ এই সমীকরণ দাঁড় করানোর স্বাধীনতা বঙ্কিমচন্দ্র গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আনন্দমঠ তো আরব্য রজনীর গল্প নয়, এর ভিত্তি তো রয়েছে সর্ববিদিত ইতিহাসে। ইতিহাস তো মানবে না যে বাঙালি বলতেই হিন্দু বোঝাতে হবে। বলবে এটা নিতান্তই মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সত্যানন্দের বাহিনীতে অনেক মানুষ। যুদ্ধরত মহেন্দ্র উত্তেজনাবশত সন্তানদের ডাক দিয়ে বলেছে, 'ঐ দেখ, শিখরে প্রভু সত্যানন্দ গোস্বামীর ধ্বজা দেখা যাইতেছে। আজ স্বয়ং মুরারি মধুকৈটভনিসূদন কংশকেশি-বিনাশন রণে অবতীর্ণ, লক্ষ সন্তান স্তূপপৃষ্ঠে।' একটু পরেই ঔপন্যাসিক অবশ্য মহেন্দ্রের অতিশয়োক্তিকে তার অলক্ষেই শোধন করে দিয়েছেন, লিখেছেন, 'সেই সময়ে পঞ্চবিংশতি সহস সন্তানসেনা লইয়া সত্যানন্দ ব্রহ্মচারী শিখর হইতে, সমুদ্রপ্রপাতবৎ তাহাদের [অর্থাৎ ইংরেজ সেনাদের] উপর বিক্ষিপ্ত হইলেন।' এ ধরনের অতিশয়োক্তি পুঁথি সাহিত্যে দেখা যায়, সেখানে লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতারে কিন্তু সুমার করিয়া শেষ পর্যন্ত দেখা যায় চলি্লশ হাজার। উত্তেজিত ছিল, তাই অতিশয়োক্তি করেছে মহেন্দ্রের অতিশয়োক্তির পক্ষে এমন যুক্তি দাঁড় করানো সম্ভব। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র তো দো-ভাষী পুঁথি রচয়িতা নন, তিনি হচ্ছেন শিক্ষিত-শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, তার কল্পনার সমর্থনে সত্যানন্দের অসম্ভব রকমের সাফল্য অর্জন না হয় সম্ভব হলো, কিন্তু ওই পঁচিশ হাজার কৃষক-সৈন্যের সবাই হিন্দু ছিল এটা কী করে সম্ভব? এ বিভ্রম তার নিজের নয়, এটি তার জাতীয়তাবাদের- এমনটা বলাই বোধকরি সঙ্গত। কিন্তু প্রশ্ন থাকে, থাকবেই। সত্যানন্দ বেছে বেছে শুধু হিন্দুদেরকেই তার বাহিনীতে নিলেন, মুসলমানদের কাছেধারেও ঘেঁষতে দিলেন না, এরকম ঘটনা ইতিহাস-সমর্থন করে কি? বাস্তবেও কি তা সম্ভবপর ছিল? উনিশশ' একাত্তর সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতারা বামপন্থিদের যে বেছে বেছে বাদ দিতেন, প্রবেশাধিকার দিতেন না, সে রকমের ছাঁটাইবাছাই একটি বিশেষ ধরনের অনুকূল পরিবেশেই সম্ভব হয়েছিল, সত্যানন্দের জন্য তো সেই পরিবেশ থাকার কথা নয়, তার জন্য তো কোনো মিত্রবাহিনী ও আশ্রয়স্থল ছিল না, শত্রুকবলিত এলাকায় থেকেই তাকে বাহিনী গঠন ও যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়েছে। তা হলে?
তবে উপন্যাসের সব কিছু যে লেখকের অভিপ্রায় অনুযায়ী চলে তা নয়। বাস্তব সত্য কখনো কখনো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বৈকি। আনন্দমঠেও তেমনটা ঘটেছে। যেমন জীবনানন্দ ও শান্তি যখন পথ দিয়ে যাচ্ছে তখন লোকমুখে শুনতে পাচ্ছে যে 'মেলায় সমবেত সন্তানদিগের সঙ্গে ইংরেজ সৈন্যের মহাযুদ্ধ হইবে।' আর সেই যুদ্ধ যখন বেধেছে, মহেন্দ্র তখন দেখতে পাচ্ছে যে সন্তানবাহিনী টিলার ওপর থেকে 'বীরদর্পে অবতরণ করিয়া ইংরেজসেনা আক্রমণ করিতেছে।' এখানে শত্রুপক্ষ হিসেবে মুসলমান নেই, ইংরেজই উপস্থিত রয়েছে, যেমনটা তাদের হওয়ার কথা। ইতিহাসের নির্দেশ পালিত হয়েছে, ঔপন্যাসিকের আদেশ অমান্য করে।
আনন্দমঠ-এ সন্ন্যাসীদের সন্তানে পরিণত করা হয়েছে। সেটার প্রয়োজন ছিল। সন্তানেরা মাতৃভূমিকে আপন মায়ের মতো ভালোবাসে, সেই ভূমিকে স্বাধীন করতে তারা সর্বস্ব পণ করেছে। কিন্তু তাদের গোপন নেতা প্রকাশ্য হয়ে যখন বলছেন, তোমরা আত্দসমর্পণ কর, তাদের পক্ষে তখন সে অপ্রত্যাশিত আদেশে সাড়া দেওয়া কঠিন হওয়ার কথা। কঠিন হচ্ছেও। সেনাপতি সত্যানন্দকে দেখা যাচ্ছে মাতৃরূপ জন্মভূমি প্রতিমার কাছে বাষ্পনিরুদ্ধ কণ্ঠে উচ্চারণ করছে, 'তোমার উদ্ধার করিতে পারিলাম না-আবার তুমি ম্লেচ্ছের হাতে পড়িলে।' আবার পড়িলে! আগে ছিল এক ম্লেচ্ছের অধীনে, এখন থাকতে হবে আরেক ম্লেচ্ছের অধীনে। প্রথম ম্লেচ্ছ মুসলমান, দ্বিতীয় ম্লেচ্ছ ইংরেজ। দ্বিতীয় ম্লেচ্ছকেও যে মুসলমান করবে সত্যানন্দের পক্ষে সে উপায় নেই, ইতিহাস মানবে না সে হুকুম, রাজি হবে না ইংরেজকে মুসলমান করতে। যুদ্ধে সন্তানদের যখন জয় হলো তখন অবস্থাটা এমন দাঁড়াল যে 'ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে সংবাদ লইয়া যায় এমন লোক রহিল না।' অর্থাৎ এটা অস্বীকার করবার উপায় থাকছে না যে, সন্তানরা যতই বিশুদ্ধ সনাতনধর্মী হোক না কেন, যাদেরকে তারা মারছে তারা মুসলমান হিসেবে আবির্ভূত নয়, তাদের পরিচয় একটাই, তারা সবাই ওয়ারেন হেস্টিংসের ভাড়া-করা সেনা, কোনো ক্রমেই ধর্মযোদ্ধা নয়। [ চলবে ]