আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন বেশ দীর্ঘ। চট্টগ্রামকে সঙ্গে ধরলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন আরও পাঁচ বছর বেশি। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলাম, বেরিয়েছি '৮১-র শেষে। নিয়মিত ছাত্র ছিলাম না, সেটা থাকা সম্ভবও ছিল না। মাঝে মাঝেই আমি এ কথা বলি। একটি নিয়মিত বড় ছাত্র সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নিয়মিত ছাত্র থাকতে পারবে না। ৭০-৭২টি সাংগঠনিক জেলায় যদি একবার করেও যান তাহলেই বছরের ১৫০ দিন পার হয়ে যায়। এ ছাড়াও রাজধানী ঢাকাতে সংগঠনের কাজ প্রায় ২৪ ঘণ্টাই। একটা সময় ছিল পাকিস্তান আমলে, যখন ভালো ছাত্ররা রাজনীতি করতেন। তারা বিতার্কিক ছিলেন, অনর্গল ইংরেজিতে বক্তৃতা করতেন। ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারা তখন একটি বিশেষ গুণ বলে বিবেচিত হতো। তালুকদার মনিরুজ্জামান, মিজানুর রহমান শেলীর মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্ররাও রাজনীতি করতেন।
স্বাধীনতার পরও এ ধারাটি মোটামুটি ছিল। আফতাব উদ্দিন আহমেদ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র বলে বিবেচিত হতো। অনার্সে ফার্স্ট হওয়া থেকে শুরু করে বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, আবৃত্তি, অভিনয় এমনকি গান গাওয়ায়ও সে পারদর্শী ছিল। পরবর্তী সময়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আফতাব উদ্দিন আহমেদ জাসদ ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন। '৭৩-এর ডাকসুর নির্বাচনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারী ছাত্ররা ডাকসু নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল।
কিন্তু অতঃপর ধীরে ধীরে ছাত্র রাজনীতির এই মান নামতে থাকল। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-যুদ্ধ পর্যন্ত এ দেশের ছাত্র সমাজ অনন্য ভূমিকা রাখে। তার মাধ্যমে সমগ্র ছাত্র আন্দোলনেরই এক ধরনের রাজনীতিকরণ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পরে ছাত্র রাজনীতিতে ভালো ছাত্রের ডিমান্ড কমে যায়। বেশি করে বিবেচনায় আসে রাজনৈতিক সচেতনতার, সাংগঠনিক দক্ষতার। এ কারণেই ৭৯ সালের ডাকুস নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র সলিমুল্লাহ খানকে জিএস হিসেবে মনোনয়ন দিলেও জাসদ ছাত্রলীগের নেতারা তার বদলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আকতারুজ্জামানকে বেশি পছন্দ করে। এটা দিয়ে আমি এ কথা বোঝাতে চাইছি না যে, এভাবে ছাত্র রাজনীতির মান পড়ে গেছে। কিন্তু ১৯৭৩-এ ডাকসুর ব্যালট বাঙ্ হাইজ্যাক একটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যে ছাত্র সমাজ ৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করল সেই ছাত্র সমাজেরই একটি অংশ সেই সদ্য স্বাধীন দেশে গণতন্ত্রের কবর খুঁড়ল। সরকারি দল এটা অনুমোদন করেছিল। কাজেই তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন? তখন ভিসি ছিলেন বোস প্রফেসর ড. আবদুল মতিন চৌধুরী। তিনি ছিলেন সরকারি দলের লোক। অতএব, তিনি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দলবাজির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ এটি।
কিন্তু এভাবে বলাও বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দুজন ভিসি পেয়েছিলাম যাদের কথা বলা উচিত। যাদের মধ্যে একজন অবশ্য ড. মতিন চৌধুরী। তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখাটাই ছিল প্রীতিহীন।
তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রভর্তির ব্যাপারে দলবাজি ছিল। মতিন চৌধুরী সাধ্যমতো সরকারি ছাত্রলীগের তদবির রক্ষা করে চলছিলেন। আমিও সে রকম ৫০টি তদবির নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। এ জন্য প্রথম সাক্ষাৎকারটিকে সৌজন্যমূলক বা প্রীতিকর বলতে পারছি না আমি। বিস্তারিত বলার অবকাশ এখানে নেই। এভাবে বলব ড. মতিন চৌধুরী আমাকে কোনো উষ্ণ সম্ভাষণ জানাননি। আমিও সরাসরি তাকে বলেছি, যেহেতু আপনি সরকারি দলের ভর্তির তদবির শুনছেন সেহেতু আমারটাও শুনতে হবে। আমি ফরমগুলো সেখানে রেখে এসেছিলাম। এখন ভাবলে খারাপ লাগে ড. মতিন অনেক জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। এখন আর তিনি নেই। থাকলে গিয়ে তার কাছে সেদিনের সেই ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইতাম। কিন্তু আমার উপায় ছিল না।
এরপর ভিসি ছিলেন ড. ফজলুল হালিম চৌধুরী। তিনিও আওয়ামী লীগের লোক ছিলেন। তার কাছেও গিয়েছিলাম ভর্তির তদবির করতে। তখন আমি ছাত্রপ্রিয়তার তুঙ্গে। ডাকসুর প্রথমবারের নির্বাচিত ভিপি। হালিম চৌধুরী বললেন, মাহমুদুর রহমান মান্না ভালো ছেলে সবাই বলে। সে ভর্তির তদবির নিয়ে এসেছে। নিশ্চয়ই এদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। তোমার দল করে তাই তুমি এসেছ।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করেছিলাম। তারপর বললাম, স্যার এরকমই তো হচ্ছে। উনি বললেন, আমরা সবাই তোমার কাছে অন্যরকম আশা করি। কিন্তু তুমিও সেই পথেই হাঁটছ। হঠাৎ করেই যেন সম্বিৎ ফিরে পেলাম আমি। বললাম আপনি বন্ধ করে দেন এগুলো। উনি আবারও বললেন, আমি বন্ধ করতে চাই, যদি তোমরা বিশেষ করে তুমি সহযোগিতা কর। কিভাবে, আমার প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ভর্তির একটি সিস্টেম তৈরি করব। এর বাইরে কিছু হবে না। কোনো অনিয়ম হবে না। আমার সন্দেহ ও প্রশ্নের জবাবে তিনি আবারও বললেন, তোমরা দেখ কোনো অভিযোগ পেলে আমাকে বল।
ড. ফজলুল হালিম চৌধুরী তার কথা রেখেছিলেন। আমি নিজের চোখে দেখেছি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক ছাত্রের ভর্তির ব্যাপারে চিঠি লিখেছিলেন; কিন্তু ফজলুল হালিম চৌধুরী তাকে ভর্তি করেননি। আর এ জন্য রাষ্ট্রপতি জিয়াও তার ওপর কোনো শোধ নেওয়ার চেষ্টা করেননি।
আজকে এ কথাগুলো মনে পড়ছে। চোখের সামনে টেবিলের ওপর বেশ কয়েকটি দৈনিক। গত কয়েক দিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে পত্র-পত্রিকায় যা লেখা হচ্ছে তা দেখছি আর ভাবছি কিভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে এসএসসি ও এইচএসসি মানের পরীক্ষার ফলাফল আকাশচুম্বী হয়ে গেছে। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা এ নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, অযথাই শিক্ষার মান বাড়িয়ে দেখানোর জন্য এগুলো করা হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে কর্তৃপক্ষীয় মহল থেকে এরকম করতে বলা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি দু'একজন শিক্ষকের কথা জানি যারা খুব নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে খাতা দেখেছেন। তাদের কর্তাব্যক্তিরা ধমকিয়েছেন এই বলে যে, তারা সরকারের সাফল্যকে খাটো করে দেখাতে চাইছেন। তাহলে তাদের দেওয়া নম্বরে পাস এবং গ্রেডিংয়ের হার এত কম কেন? ওই শিক্ষকরা নেহাতই শিক্ষক। কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী নন। অতএব, তারা উপরের নির্দেশ মেনেছেন।
এই উপরটা কত উপর। তা বোঝা যায়, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের মন্তব্য থেকে। সজ্জন বলে পরিচিত এই মন্ত্রী কিছুদিন আগে টিআইবির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তৈরি গবেষণার ওপর এক হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু ১০ দিন যেতে না যেতেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. এ কে আজাদ চৌধুরী নিজেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেন। এক এক করে নগ্ন হয়ে পড়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘুষ, দুর্নীতি, ভর্তিবাণিজ্য, সনদবাণিজ্যের চিত্রগুলো। তখন শিক্ষামন্ত্রী মুখ বন্ধ করেন।
চলতি বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি ইউনিটে পাসের গড় হার ১৪.২৬ শতাংশ। মোট তিন লাখ এক হাজার ১৩৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৫৫ হাজার ২৭৮ জন, অথচ এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। তাদের অনেকেই ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। তিনটি বিভাগে তিন লাখ পরীক্ষার্থীর শতকরা ৮০ ভাগ পাসই করতে পারেনি। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করতে বাংলা ও ইংরেজিতে বাধ্যতামূলক ৮ নম্বর পেতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় বেশির ভাগই ফেল করেছে বাংলা ও ইংরেজিতে। সবচেয়ে আশ্চর্য হলো গ ইউনিটের পরীক্ষার ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্য উত্তীর্ণ হয়েছেন মাত্র দুইজন।
সারা দেশের বিবেক প্রকম্পিত হয়েছে। কোথায় যাচ্ছি আমরা। অথচ সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ শিক্ষামন্ত্রী এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পদ্ধতিকে দায়ী করেছেন। তিনি এ ভর্তি পরীক্ষাকে অপ্রয়োজনীয়ও বলেছেন।
সেই যে ফজলুল হালিম চৌধুরীর সময় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা প্রক্রিয়া চালু হয়েছে তা নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেনি। এ শিক্ষামন্ত্রী এবং তার সরকারও কখনো কোনো কথা বলেনি। প্রায় ছয় বছর ধরে শিক্ষাক্ষেত্রে কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য অন্যায় ও মিথ্যাচার হয়ে আসছে তা যখন এমন নগ্নভাবে ধরা পড়েছে তখন খুবই শান্তশিষ্ট শিক্ষামন্ত্রীও শিষ্ট থাকতে পারেননি। তিনি এমনকি ভয় দেখিয়েছেন এই বলে যে, বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ৭৩ পরিবর্তন করবেন তারা।
এরা সম্প্রচার আইন করেছে, বিচারপতিদের অপসারণের জন্য সংবিধান সংশোধন করেছে, অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন হরণের জন্য হাত বাড়িয়েছে। কিন্তু এবারও প্রতিবাদ করেছেন আরেক ভিসি যিনি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে আছেন। তিনিও একজন সরকারি দলের কর্মী আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। পরীক্ষা পদ্ধতির কোথায় কোথায় ত্রুটি আছে সেটা শিক্ষামন্ত্রীকে দেখিয়ে দিতে বলেছেন। শিক্ষামন্ত্রী এ প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি। কী জবাব দেবেন তিনি? বিভিন্ন বিভাগে পরীক্ষার যারা কর্তা তারা তো অধিকাংশই নীল দলের লোক।
সাধারণ মানুষ কোনো দলাদলি চায় না। বিশেষ করে জ্ঞানের জগতে, শিক্ষার চর্চায়। দুঃখজনক হলেও এই সরকার জ্ঞানের জগতেও দলের বিস্তার করেছে। এর আগে যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারাও সেটা করেছেন। আমরা এর অবসান চাই।
নজরুলের সেই বিখ্যাত কবিতা, 'হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন/কাণ্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।' শিক্ষাকে ডুবিয়ে দিচ্ছে ওরা। এই অপচেষ্টা রুখতে হবে। শিক্ষাকে বাঁচাতে হবে। দেশ বাঁচাতে হবে।
আমি একটি প্রস্তাব দিতে চাই। একটি পত্রিকায় পেলাম, গত সাত-আট বছর আগে ব্রিটেনে একটি সংস্থার জরিপে বেরিয়ে আসে প্রতি পাঁচজন শিক্ষার্থীর একজন ভালোভাবে শিখছে না। সরকার কিন্তু পরস্পরকে দোষারোপ না করে আরেকটি সংস্থাকে দিয়ে জরিপ করাল। দেখল তথ্য ঠিক আছে। তখন কেন ভালোভাবে শিখছে না সেই কারণ খুঁজে বের করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হলো। আমাদেরও সেভাবে এগোতে হবে।
শিক্ষামন্ত্রীকে বলছি, যদি আপনি দলকানা না হন, যদি আপনি হুকুমের দাস না হন তবে এ উদাহরণটি অনুসরণ করুন। দোষারোপের সংস্কৃতি বাদ দিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করুন এ ভয়াবহ ব্যর্থতার। দেশকে ভালোবাসলে দেশের কথা ভাবুন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কথা ভাবুন। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে এটা আপনার বিশেষ দায়িত্ব। অন্ধ আনুগত্য আর হুকুম পালন কোনো সততার পরিচায়ক নয়।
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।
ই-মেইল : [email protected]