রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন- 'বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে'। তিনি যখন লিখেছিলেন তখন তার মাথায় ব্রিটিশদের অত্যাচারের কথা ছিল। কবি সেদিন যা লিখে গেছেন তা আজও ধ্রুব সত্য। বেশ কয়েক বছর আগে দক্ষিণের তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সম্প্রতি ব্যাঙ্গালুরু আদালত তাকে শুধু সাজাই দেয়নি, ভারতের প্রচলিত আইনে তার বিধায়ক পদও কেড়ে নিয়েছে। তামিল ও কানাড়া ফিল্মে এক সময়ের ডাকসাইটে অভিনেত্রী জয়ললিতা। তার হিরো ছিলেন এআইডিএমকে-র রামচন্দ্রণ। সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখতেন তার চিরশত্রু ডিএমকে-র করুণানিধি।
কেন এই প্রসঙ্গ? ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে একই নিয়ম একই আইন একই সংবিধান সবার জন্য। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো আইন মানতে চান না। গত সপ্তাহে কলকাতা হাইকোর্টে একে একে পাড়ুই-কাণ্ড, তাপস পাল, যাবদপুর বিশ্ববিদ্যালয় কাণ্ডে নাস্তানাবুদ হওয়ার পরও তিনি লম্ফঝম্ফ করছেন। যে কোনো ঘটনাই ছোট, সাধারণ এবং তুচ্ছ তার চোখে। তার একটাই বক্তব্য- সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং কুৎসা করছেন। কিন্তু যাদের নিয়ে উনি তেজ দেখাচ্ছিলেন তারাই এখন প্রাণের ভয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
সারদা কাণ্ডের পর সামনে এসেছে রোজভ্যালি কাণ্ড। এরাও একটি বড় চিটফান্ড গোষ্ঠী। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা বলছেন, ২৫০০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল। সেগুলো সব ফ্রিজ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যে এত বড় সাপ বেরিয়ে পড়বে, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে বোঝেননি বা বুঝলেও তাদের চাপের সামনে নতিস্বীকার করেছিলেন। ওই সময়, ২০১২ সালের মে মাসে দার্জিলিংয়ের ডেলোর সরকারি বাংলোয় গভীর রাতে সুদীপ্ত সেন এবং গৌতম কুণ্ডু (রোজভ্যালির মালিক)-দের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে আলোচ্য বিষয় ছিল এই দুই চিটফান্ড সংস্থা তাকে দেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দেবে। এ জন্য ১৫-২০ কোটি টাকাও খরচ করতে প্রস্তুত ছিলেন তারা। বদলে তাদের লোক-ঠকানো ব্যবসা চালানোর সুবিধা করে দিতে হবে।
২০১২ সাল থেকেই তার এই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন গোটা দেশ জানত। তবে তার নেপথ্যের ঘটনা এবার চিটফান্ড মালিকরাই ফাঁস করে দিলেন। এই দুটি চিটফান্ড ছাড়াও মোট ৩৫৪টি চিটফান্ড সংস্থা এ রাজ্যে রয়েছে। এদের সঙ্গে জড়িত আছেন তৃণমূলের কোনো না কোনো নেতা, সাংসদ, বিধায়করা। ইতিমধ্যে মমতার দলের প্রায় ১০ জন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে জেরা করেছেন তদন্তকারী অফিসাররা। তদন্ত এখনো চলছে। তদন্ত যে কবে শেষ হবে তা নিয়ে নানা মহলে সংশয় আছে। লাখ লাখ গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষ চিটফান্ড কোম্পানিগুলোর হাতে প্রতারিত হয়েছেন। আর মমতা বলে যাচ্ছেন কিছুই হয়নি। কিন্তু রাজ্যের মানুষ প্রতিনিয়ত বুঝতে পারছেন কী ঘটে চলেছে। তিনি কী চান? কেন চান? আগামী পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই তার।
শুধু উপমহাদেশ নয়, গোটা বিশ্ব জেনে গেছে ২০১২ সালে দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ড। একটি কলেজের ছাত্রীকে রাতের অন্ধকারে ধর্ষণ করে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল ছয় দুষ্কৃতকারী। সাত-আট মাসের মধ্যে দোষীদের সাজা হয়েছে। ভারতের যে কোনো রাজ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে স্থানীয় প্রশাসন সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়। আর এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তার সাড়ে তিন বছরের রাজত্বে পার্ক স্ট্রিট কাণ্ড, কামদুনিসহ যতগুলো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সবগুলোকেই সামান্য ঘটনা বলে এড়িয়ে গেছেন। প্রায় সব ক্ষেত্রে ধর্ষণকারী ও খুনিরা তৃণমূলের লোক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তারা ছাড়াও পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্ট দোষীদের চিহ্নিত করা মাত্রই প্রচুর টাকা খরচ করে সরকার সে মামলাগুলো উচ্চতর আদালতে নিয়ে যাচ্ছে। এসব দেখে রাজ্যের মানুষ তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছে। তারা দ্রুত একটা বিহিত চাইছেন। রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা হলো, সিবিই তদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্ট এলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা রাস্তায় নেমে পড়ার যে হুমকি দিয়েছেন, তা পুজোর পর থেকে বোঝা যাবে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র, ঝাড়গ্রামের শিলাদিত্যদের অপরাধ ছিল 'ওরা মাওবাদী'। শিলাদিত্য প্রকাশ্য জনসভায় মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন, সারের দাম বাড়ছে কেন? মঞ্চ থেকেই মমতা শিলাদিত্যকে গ্রেফতারের হুকুম দিয়েছিলেন। স্বভাবতই বিশিষ্টজনরা প্রশ্ন তুলেছেন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় তিনি কাদের সাহায্য নিয়েছিলেন? তারা কারা। তারা আরও প্রশ্ন তোলেন, তার অন্যতম সাহায্যকারী মাওবাদী নেতা কিষেণজিকে কে বা কারা হত্যা করেছে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পারবেন এর জবাব দিতে? এই প্রশ্ন সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ এবং সুশীল সমাজের। তারা এক সময়ে মমতাকে দুই হাত তুলে সমর্থন করার পর এখন পিছিয়ে যাচ্ছেন। আরেকটা উদাহরণ দেব।
জ্যোতিবসুর মুখ্যমন্ত্রিত্বের শেষ দিকে মমতা একদিন একটি বোবা মেয়েকে রাইটার্সে নিয়ে এসে হৈ-চৈ বাঁধান, ওই মেয়েটিকে সিপিএম সমর্থকরা ধর্ষণ করেছে। সে অন্তঃসত্ত্বা। সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু কয়েকদিন পর উত্তর ২৪ পরগনায় ওই মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে একটি টেলিভিশন চ্যানেল দেখিয়েছিল মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা তো হয়ইনি, ধর্ষণের গল্পটাও বানানো। মেয়েটির নাম ছিল চপলা সর্দার।
বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ এমনকি মমতাপন্থিরাও মনে করছেন, জয়ললিতার যদি এই শাস্তি হতে পারে, তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাজা হবে না কেন? প্রশ্ন তুলেছেন কংগ্রেসের প্রধান নেতা আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, কালীঘাট-ভবানীপুর অঞ্চলে মমতার আত্দীয়স্বজনরা প্রায় ৩০০ কোটি টাকার সম্পত্তি কিনেছেন। এই টাকা এলো কোথা থেকে? এই অভিযোগ শুধু মান্নানের নয়, বাকি বিরোধীরাও একই অভিযোগ তুলছেন।
রোজভ্যালির গৌতম কুণ্ডু হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেওয়ার পর ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে। এখন শুধু একটিই আলোচনা- দিদি কি সত্যিই সততার প্রতীক, নাকি দুর্নীতির আড়াল করতে যে তৎপরতা তিনি দেখাচ্ছেন তার তুলনা ভূ-ভারতে নেই। যে পুলিশ রাজ তিনি কায়েম করেছেন, কতদিন পুলিশ তাকে বাঁচাবে? রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় না থাকলে পুলিশ কি করতে পারে তার প্রমাণ জয়ললিতা কাণ্ড। রায় বের হওয়ার আধঘণ্টার মধ্যে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তিনি ১০ বছর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
বদলাই তার একমাত্র অস্ত্র। আর সঙ্গে পুলিশ। পাঁচের দশকে কলকাতায় এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বাড়ার প্রতিবাদে বামপন্থিরা সেদিন মাঠে নেমেছিলেন। সে সময় কর্তব্যরত সাংবাদিকদেরও পেটায় পুলিশ। অনেক সাংবাদিককেই হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। তারই প্রতিবাদে তৎকালীন আনন্দবাজারের সম্পাদক ময়মনসিংহের সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার লিখেছিলেন- পুলিশ জননীর গর্ভের লজ্জা। আর যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক ফরিদপুরের বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় লেখেন- পুলিশ ব্রিটিশদের জারজ সন্তান। এই দুই সম্পাদকীয় নিয়ে আলোচনা এখনো চলে সাংবাদিক মহলে। এদিকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একটি খবর চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী কোনো ঘটনা ঘটলেই জেলা পুলিশ সুপার নয়, কনস্টেবল বা অধস্তন কর্মীদের ফোন করেন। পুলিশকে দিয়ে বিধানসভা, লোকসভা, পুরসভাসহ ভোট করানো তৃণমূলের নতুন খেলা। উল্লেখযোগ্য হলো, এসব খবরের কোনো প্রতিবাদই আসে না দিদি বা তার দলের পক্ষ থেকে।
দেশের পাঁচ নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দিকে তাকানো যাক। এক ছাত্রীকে নবীনবরণের দিন শ্লীলতাহানি করে বহিরাগত কিছু যুবক এবং তৃণমূলের কয়েকজন ছাত্র। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ এবং ধরনা শুরু করে যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরা। সিপিএম থেকে তৃণমূলে আসা উপাচার্য পুলিশ ডেকে আন্দোলনরত পড়ুয়াদের সরিয়ে দিতে বলেন। তৃণমূলের পুলিশ বাহিনী রাতের বেলা আলো নিভিয়ে ওই ছাত্রছাত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বেধড়ক মারধর শুরু করে তারা। ছাত্রীদেরও রেহাই দেয়নি বর্বর পুলিশ বাহিনী। ছাত্রীদের পেটের ওপর দাঁড়িয়ে লাঠি চালায় তারা। পুলিশের সঙ্গে জুটেছিল যাদবপুর অঞ্চলের স্থানীয় তৃণমূল দুষ্কৃতিরাও। গেঞ্জি এবং হাওয়াই চটি পরেও এসেছিল পুলিশ। নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীদের ওপর এই বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে এর পরদিন থেকেই বিক্ষোভ শুরু হয় গোটা রাজ্যে। অধ্যাপক, প্রাক্তন অধ্যাপক, দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা যাদবপুরের প্রাক্তনীরা, এমনকি সাধারণ গৃহবধূরাও সোশ্যাল সাইটের মাধ্যমে তাদের ক্ষোভ উগড়ে দেন। প্রতিবাদীদের একটাই দাবি, পদত্যাগ করতে হবে উপাচার্যকে। কিন্তু ঘটনার চারদিন পরও পদত্যাগের কোনো লক্ষণ দেখাননি উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী। ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক, অভিভাবকদের আন্দোলনও চলছে সমানতালে।
পশ্চিমবঙ্গে যে চরম উচ্ছৃঙ্খলতা চলছে তা ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে। উপরের কয়েকটি ঘটনা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। আসন্ন পুজো এবং ঈদের পর পরিস্থিতি কোন দিকে যায় সেদিকে নজর রাখছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ কেন্দ্রীয় সরকার। তৃণমূলের অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছে না বিজেপিও। প্রধান প্রতিপক্ষ দল ধরে নিয়ে জেলায় জেলায় বিজেপির ওপর চলছে হামলা। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিজেপির অফিসও। বিজেপি নেতারা এসব অভিযোগ নিয়ে দিল্লিতে রাজনাথ সিংয়ের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। যাদবপুরসহ রাজ্যের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে পঠনপাঠন বন্ধ হয়ে গেছে। ছাত্রদের উসকানির মূলে রয়েছেন সততার প্রতীক দিদি। ইতিমধ্যে সাত-আটজন অধ্যক্ষ রেজিস্ট্রার পদত্যাগ করেছেন। এখন বাংলার মানুষ চাইছেন বিচারের বাণী নিভৃতে না থেকে এবার প্রকাশ হোক।