সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে নিয়োগের জন্য নির্বাচিত ৬১৫১ চিকিৎসক বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগদান করেছেন মোটামুটি একটি রাষ্ট্রীয় অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর এই বিশাল সুশৃঙ্খল অনুষ্ঠানের জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য চিকিৎসক এবং জনগণের কাছ থেকে। ৬১৫১ চিকিৎসকের অন্তর নিংড়ানো শ্রদ্ধা এবং প্রণতি জানানো উচিত সরকারের প্রতি। সর্বোপরি দেশের মানুষের প্রতি হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তরুণ চিকিৎসকদের মনে রাখা উচিত, দেশটি আমাদের। রাষ্ট্র নামক প্রশাসনযন্ত্রটি যে আনুষ্ঠনিকতার মধ্যে তাদের সম্মান দিলেন, তার প্রতিদান দিতে হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম বলেছেন, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে। গ্রামেগঞ্জে যোগাযোগের উন্নতি হয়েছে। বিদ্যুৎ আছে, স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল আছে। সর্বোপরি ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবাদে মুঠোর মধ্যে লেখাপড়া, তথ্য-প্রযুক্তি, সংবাদ আদান-প্রদান সবই পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশে, দেশের যে কোনো জায়গায় বসে, শুধু একটা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে।
আমাদের মতো ব্যাগভর্তি বই নিয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই আজকের তরুণ চিকিৎসকদের। যখনই কোনো রোগীর কোনো উপসর্গের সঙ্গে রোগ নিরূপণ কষ্ট হয়ে যাবে, তখনই তারা মোবাইল বা ইন্টারনেটে গিয়ে কি কি সম্ভাব্য ডায়াগনোসিস হতে পারে তা দেখে নিতে পারবেন। আমি যা করি তা হলো কোনো রোগীর রোগ নিরূপণ করতে না পারলে তাকে শুধু রুটিন পরীক্ষাগুলো করতে দিই। বাসায় ফিরে রোগীর উপসর্গের সঙ্গে সম্ভাব্য কি কি রোগের সাদৃশ্য আছে তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখি। পরবর্তী দিনে রোগী যখন রুটিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে আসে তখন মোটামুটিভাবে দুটো মিলিয়ে একটা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি। রুটিন পরীক্ষাগুলো লিখলে মেডিকেল ইথিকসের ব্যত্যয় ঘটে না। সেটাই আমরা শিখেছি এবং অন্যকে শেখাই। রুটিন পরীক্ষাগুলো হলো CxR, Blood for CBC, Urine for R/E & Stool for R/E। তবে পায়খানা বা ঝঃড়ড়ষ পরীক্ষাটি সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। পৃথিবীতে যেভাবে ল্যাবরেটরি সার্ভিস বা রেডিওলজিক্যাল সার্ভিসের উন্নতি হয়েছে, সেভাবে ল্যাবরেটরি নির্ভর না হয়ে ক্লিনিক্যাল নির্ভর হওয়া বাঞ্ছনীয়। তরুণ চিকিৎসকদের বলি জীবনের শুরুতে আমাদের খারাপ দিকগুলো অনুসরণ করবে না। যেমন বাজারে প্রচলিত অভিযোগ, আমরা কমিশন নেই। মনে রাখবে তিনটি কথা, Nothing is impossible, No body is indispensable and Nothing is secret। তারুণ্যের কাছে সবই সম্ভব এবং পৃথিবীতে, তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে কিছুই গোপনীয় রাখা সম্ভব নয়।
আর যদি সম্ভব হতো তাহলে আমেরিকার দুর্ধর্ষ সংস্থা CIA হলো সে দেশের Principal Intelligence Gathering Agency, আর সেই CIA-এর দলিল হাওয়ায় ভাসত না। বিভিন্ন ডিপ্লোমেটিক মিশনের মাধ্যমে তথ্যসংগ্রহ করতে গিয়ে ধরা পড়ে বহিষ্কৃত হতো না। তাই ভয়শূন্য চিত্তে, স্বীয় বুদ্ধিতে, সঠিক বিবেচনা এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্রষ্টার নাম মনে রেখে, রোগীদের সেবা করে যাবে, দেখবে জয় সুনিশ্চিত, সুনাম অবধারিত। অধিকন্তু মানবিক গুণাবলি তোমাকে অাঁকড়ে রাখবে। একদিন দেখবে কোনো অসততাই তোমাকে স্পর্শ করবে না। কিছুদিন আগে একটা নিবন্ধে আমি লিখেছিলাম ডাক্তার-রোগী এবং হাসপাতালের মধ্যে সম্পর্ক কি? সোজা ভাষায় পূজারি-দেবতা-মন্দির। অর্থাৎ ডাক্তার হিসেবে তুমি সেবক বা পূজারি, রোগী তোমার দেবতা, আর ওই দেবতারা সেবা নিতে আসেন হাসপাতাল নামক মন্দিরে। হিন্দু শাস্ত্রে একটি প্রবাদ বাক্য আছে 'অতিথিবিমুখ হলে, ধর্ম যায় মা রসাতলে।' একজন ডাক্তারের কাছে রোগী হলো অতিথি বা দেবতা। তোমাদের মধ্যে হয়তো অনেকেই আছ, যাদের এমবিবিএস পাসের পরে, মা-বাবা, ভাইবোনকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। মনে রাখবে, তোমরা যে বেতন পাবে তার অর্ধেক দিয়ে কৃচ্ছ্রতা সাধন করে চলা যাবে। বাকি অর্ধেক সহায়তা কাজে ব্যয় করবে। দ্বিতীয়ত গ্রামেগঞ্জে যেখানেই তুমি রোগীদের সাহায্য করার জন্য প্রাকটিসে বসবে, দেখবে হাত খরচের পয়সা অনায়াসে আসবেই। আবারও তোমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব হিন্দু শাস্ত্রের একটি প্রচলিত বাক্যের প্রতি, যা হলো- 'লক্ষ্মী এবং সরস্বতী একসঙ্গে এক গৃহে অবস্থান করেন না।' অর্থাৎ 'ধনের দেবী লক্ষ্মী যখন ঘরে ঢুকে, বিদ্যাদেবী সরস্বতী তখন বীণা ও পুস্তক হাতে প্রস্থান করে।' এমনকি মা দুর্গা দেবী তার দুই কন্যা লক্ষ্মী এবং সরস্বতীকে তার দুপাশে রেখেছেন, একসঙ্গে এক পাশে রাখেননি। হয়তোবা ধন এবং বিদ্যার অনিবার্য সংঘাত এড়াতেই।
গ্রামে বা শহরে যেখানেই তোমাদের জন্ম হোক না কেন, নিশ্চয়ই দেখেছ কোনো জমিদারের জমিদারিত্ব শেষ হতে তিন প্রজন্মের বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়নি, বরং তাদের প্রথম প্রজন্ম অতি কষ্টে রোজগার করেছে, ন্যায় বা অন্যায় যেকোনোভাবে ধন-সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, অতি কৃপণভাবে চলে- শুধু জায়গাজমি কিনেছেন। যাকে বলা হয় 'কেনারাম'। দ্বিতীয়, প্রজন্ম বিলাসিতা করে ভোগ করেছে, বিক্রি করে হয়েছে 'বেচারাম'। তৃতীয়, প্রজন্মের বিক্রির কিছু ছিল না, তাই হয়েছে দুঃখীরাম। চতুর্থ, প্রজন্ম হয়েছে 'ভিক্ষারাম'। কোনো সম্পদ অসৎ পথে উপার্জিত হলে তা কখনো তিন প্রজন্মের বেশি ধরে রাখা সম্ভব নয়।
অনেক রোগী হয়তো খুব গরিব অথবা একজন সম্মানিত পণ্ডিত ব্যক্তি, যার কাছ থেকে তুমি ফিস নিতে না চাইলে তিনি বলবেন, 'ডাক্তার সাহেব এটা আপনার ব্যবসা, ফিস নেবেন না কেন?' বিনয়ের সঙ্গে ওই ব্যক্তিকে জবাব দেবে, 'ডাক্তারি আমার পেশা, এটা কোনো ব্যবসা নয়।' মনে রাখবে অনেক রোগীই তোমাকে এসে বলবে ডাক্তার সাহেব উপরে স্রষ্টা এবং নিচে আপনি। কখনো বলবে না, মাঝে দুর্গা, শিব, লক্ষ্মী বা সরস্বতী। এতবড় একটা সম্মান পাওয়ার পর তোমার দায়িত্ব কি হওয়া উচিত? এটা বিশাল দায়িত্ব বা গুরু দায়িত্ব, নিজের জীবনের বিনিময়ে অন্যের জীবন বাঁচানোর দায়িত্ব। নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে অন্যের জীবনে বা পরিবারে আনন্দের ধারা বইয়ে দেওয়ার দায়িত্ব। আমি যখন ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি থেকে রওনা দেব, তখন আমার ডাক্তার দাদু শ্রী অশ্বিনী কুমার দত্ত, যাকে ডাক্তারি পড়ানোর জন্য তার বড় ভাই শ্রী রাম চন্দ্র দত্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। সেই দাদু তার Sir William Osler-এর লেখা মেডিসিন বইটা খুলে, প্রথম পাতায় লেখা বিখ্যাত উক্তিটি লিখে নিতে বললেন, উক্তিটি ছিল ‘A doctor is a student till his death and when he fails to be a student he dies’ এবং বললেন পড়ার টেবিলের উপরে বড় করে লিখে ঝুলিয়ে রাখতে। আমি দাদুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলাম। তারপরও ১২ নভেম্বর '৭০-এর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর যখন ১০ দিনের জন্য কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়, তখন বাড়ি চলে আসি, বাড়ি থেকে ফিরে যাওয়ার সময় শৈল্পিকভাবে লেখা Osler-এর উক্তিটি আমাকে হাতে ধরিয়ে দেন। আমিও আগের মতো আমার হাতের লেখাটা ফেলে দিয়ে দাদুর লেখাটা টেবিলের উপর রেখে দেই। প্রসঙ্গক্রমে বড় দাদুর একটা উপদেশ যেটা এ মুহূর্তে তোমাদের জন্য প্রযোজ্য না হলেও অবতারণা করছি।
দাদু ছোটবেলা থেকে দুটো কথাই বলতেন। একটি হলো- কখনো মিথ্যা বলবে না, শুধু জীবন বাঁচানোর জন্য হলে বলবে। দ্বিতীয়টি হলো- মানুষের অপকার করবে না, পারলে উপকার কর। জীবনে চেষ্টা করেছি, তবে কতটুকু পেরেছি তা তোমরাই বলতে পারবে।
তোমরা বা আমরা কেউ হাজার বছরের পরমায়ু নিয়ে অসিনি। গড় আয়ু ৬৯ বছর সবাই বেঁচে থাকার প্রত্যাশা করতে পারি। তবে তোমরা সবাই শতায়ু লাভ কর এ প্রার্থনা অন্তর থেকে। কিন্তু তোমাদের অনেকেই হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকতে পার, যদি এমন কোনো ভালো কাজ তুমি করে যাও, তাহলে মৃত্যুর পরও জনগণ তোমাদের হাজার হাজার বছর ধরে মনে রাখবে। অর্থাৎ জনগণের হৃদয়ে স্থান নিয়ে হাজার বছর বেঁচে থাকবে, যে রকম বেঁচে আছেন ডা. বিধান চন্দ্র রায়।
আমি এখানে কয়েকটি শব্দের কথা উল্লেখ করছি। প্রতিটি শব্দের অর্থ বিশাল। জীবনের প্রতিটি পদে এ শব্দগুলো স্মরণ কর। নির্ভীকতা, চিত্তশুদ্ধি, আত্মজ্ঞান, নিষ্ঠা ও কর্মযোগে তৎপরতা, দান, বাহ্যেন্দ্রিয় সংযম, অধ্যয়ন, তপঃ, সরলতা, অহিংসা, সত্য, অক্রোধ, ত্যাগ, শান্তি, পরনিন্দা বর্জন, জীবে দয়া, লোভহীনতা, কুকর্মে লজ্জা, অচাঞ্চল্য, তেজস্বিতা, ক্ষমা, অভিমান বর্জন। এ শব্দগুলো মর্মার্থসহ স্বীয় চিত্তে এবং উপলব্ধিতে রাখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ পুরস্কার গ্রহণ করেছেন MDG-4--এর বাস্তবায়নের জন্য। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ এমডিজি প্রথম ৬টাই পূর্ণ করেছে। যেহেতু এমডিজি-৪ নবজাতক মৃত্যু রোধের সঙ্গে জড়িত, তাই আমরা ডাক্তাররাও এর অংশীদার হিসেবে দাবি রাখতে পারি। এটা মূলত ডাক্তার ও চিকিৎসা পেশার সবার কাজের স্বীকৃতি। জাতিসংঘের বর্তমান স্লোগান Universal Health Coverage
সর্বাগ্রে বাস্তবায়নের সুযোগ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার, কারণ ৬১৫১ জন ডাক্তার ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান অব্যাহত রাখলে পুরো বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবে। কাম, ক্রোধ ও লোভ- এ তিনটি নরকের দ্বারস্বরূপ, এটা জীবনকে ধ্বংস করে, এটা আত্মার বিনাশের মূল, জীবের অধোগতির কারণ। এগুলোকে পরিহার করতে পারলেই, সত্যিকার মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা যায়। হিপোক্যাক্টাস শপথ (৫০০ B.C)) এবং জেনেভা ডিক্লারেশন (১৯৪৮) সব সময় হৃদয়ে ধারণ করতে হবে।
পরিশেষে, আমি কায়মনোবাক্যে, নীরব ভঙ্গিতে, অপলক দৃষ্টিতে, নিদাঘ আকাশের দিকে তাকিয়ে, বিশ্বনিয়ন্তা সকাশে, জানাই আমার মনের পবিত্র প্রার্থনা, তোমাদেরই মঙ্গল কামনার্থে। জীবন তোমাদের সুন্দর হোক, স্বার্থক হোক, মহিমান্বিত হোক। ছন্দভরা, নান্দনিক সেবার ব্রতে তোমাদের জীবন সুশোভিত হোক। কোটি কোটি রোগীর শরীর তোমাদের হাতের স্পর্শে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠুক। Try to be a rainbow in the cloudy sky of a sick family, society, the nation and to the global health|
পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর উক্তি প্রিয়দর্শিনী, সুভাষিনী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক উদ্ধৃত “My father once told me, people are of two types. Some do the work, some take the credit. He asked me to be in the first group as there is less competition” বিনীত অনুরোধ তোমরাও কর্ম কর, কর্ম কর। মহামতি লেনিনের ভাষায় 'তোমার কর্মই তোমাকে সুনির্দিষ্ট আসনে পৌঁছে দেবে।' মনে রেখ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সেই বিখ্যাত উক্তি 'মহৎ কাজের জন্য, মহান ত্যাগের প্রয়োজন।' এ বাক্যটি বিশ্লেষণ করলে ছোটখাটো একটা পুস্তক লেখা যাবে।
লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।