১৭ জুলাই, ২০১৯ ১৯:০১

ভুলেও আত্মহত্যা নয়

রিয়াজুল হক

ভুলেও আত্মহত্যা নয়

রিয়াজুল হক

আনন্দবাজার পত্রিকায় জনপ্রিয় সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। সাক্ষাৎকারের একটি জায়গায় তিনি উল্লেখ করেছিলেন, “গভীর একটা অবসাদ। বয়স তখন আটাশ-উনত্রিশ। মনে হচ্ছিল সব শেষ। এই দীর্ঘ অবসাদ এমন জায়গায় নিয়ে গেল যে আমি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলাম”। কিন্তু তিনি বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন তাঁর এমন সিদ্ধান্ত থেকে। পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্য তিনি সমৃদ্ধি করে চলেছেন। 

১৯৩৫ সালে জন্মগ্রহণকারী এই সাহিত্যিক যদি আটাশ বছর বয়সে আত্মহত্যা করতেন, তবে ১৯৮৫ সালে শিশু সাহিত্যে অবদানের জন্য বিদ্যাসাগর পুরস্কার, ১৯৭৩ ও ১৯৯০ সালে আনন্দ পুরস্কার, ১৯৮৮ সালে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার কিংবা ২০১২ সালে বঙ্গবিভূষণ লাভ করেছেন, সেটা কি সম্ভব হত?  

আমাদের দেশে যৌতুক, দাম্পত্য কলহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, পরকীয়া প্রেম ইত্যাদি কারণে গৃহবধূদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটে। এছাড়া ধর্ষণ, পরীক্ষায় পাস না করা, প্রেমে ব্যর্থতা, দারিদ্র্য, অযাচিত গর্ভধারণ, মেলামেশা কম করার প্রবণতা, বেকারত্বের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। একটা বিষয় লক্ষণীয়, আত্মহত্যাকারী শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত যাই হোক তাদের বিচার বিবেচনার পার্থক্য তেমন একটা চোখে পড়ছে না। অনেকে সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না এই অজুহাতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। সমাজ কি একা একা তৈরি হয়? আমরা তৈরি করি। একজন অপমানিত মানুষ যদি লজ্জায় মুখ না লুকিয়ে অপমানের প্রতিবাদ করে, প্রত্যেকটি মানুষ তাদের নিজেদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিচার দাবি করে, তবে শতভাগ নিশ্চিত থাকুন অন্যায় কমে আসবে এবং সমাজ বদলে যাবে। 

জে.কে রাওলিং এর কথা সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই। তরুণ বয়সে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং বিষন্নতার কারণে তিনি আত্মহত্যার কথাও চিন্তা করেছিলেন। শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে সৃষ্টি করলেন ‘হ্যারি পটার’ নামের অমর সৃষ্টি। এক সময়ের ’নো বডি’ জে.কে রাওলিং এখন বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর নারী। আমরা কেউ জানি না ভবিষ্যতে আমাদের সামনে কি অপেক্ষা করছে। একটু অপেক্ষা করুন, সমস্যা কেটে যাবে। দুই মিনিটের সিদ্ধান্তে আপনি কেন নিজেকে শেষ করবেন।

মহান স্রষ্টা সারাজীবন আপনাকে দুঃখে কষ্টে রাখবে এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই। এর বাস্তবিক উদাহরণ হতে পারে আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। জন্মের ৯ বছরের মাথায় মাকে হারানো, ১৯ বছর বয়সে বোনকে হারানো, ২২ বছর বয়সে ব্যবসায় মার খাওয়া, ২৩ বছর বয়সে চাকরি হারানো এবং আইন স্কুলে ভর্তি না হতে পারা, ২৪ বছর বয়সে দেউলিয়া হওয়া, পরবর্তীতে যুদ্ধ থেকে ফিরে প্রাপ্য সম্মান না পাওয়া, বিয়ে করার পূর্ব মুহূর্তে ভালোবাসার মানুষটির মৃত্যু এবং নাভার্স ব্রেকডাউনে ছয় মাস শয্যাশায়ী হওয়া, সন্তানের মৃত্যু, ৩৪ বছর বয়সে কংগ্রেস নির্বাচনে হেরে যাওয়া, ৪৭ বছর বয়সে মাত্র ১০০ ভোটের কারণে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে হেরে যাওয়া, ৪৯ বছর বয়সে সিনেটর নির্বাচনে হেরে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। জীবনের ৪৯টি বছর প্রায় প্রতিটি কাজে ব্যর্থতার পর ৫১ বছর বয়সে ১৯৬০ সালে আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন আব্রাহাম লিংকন। পূর্বের কোনো ব্যর্থতাই তখন আর ব্যর্থতা থাকল না। স্বেচ্ছায় মৃত্যু কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না।

কোনো বিপদ আসলে ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান নয় বরং সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। জীবন তো শুধু আনন্দ-ফূর্তির জায়গা না। দুঃখ-কষ্ট আসলে মেনে নিতেই হবে। পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু পালিয়ে বেড়ানোর মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। আমাদের দেশে পারিবারিক সম্পর্ক এখনও অটুট। একজন মানুষ যখন আত্মহত্যা করে, তখন ভেবে দেখা উচিত তার উপর যারা নির্ভরশীল কিংবা তাকে যারা ভালোবাসে তাদের কথা। এছাড়া অনেক দেশের আইনে আত্মহত্যা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। ধর্মীয় অনুশাসন অবজ্ঞা, আইন লঙ্ঘন এবং অন্যায়ের সাথে আপোষ করে আত্মহত্যার মাঝে সার্থকতা কোথায়?

লেখক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক। 

বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম

সর্বশেষ খবর