২২ জুলাই, ২০২০ ১১:৫৮

অনুভূতির আওয়ামী লীগ আজ কোথায়?

বাণী ইয়াসমিন হাসি

অনুভূতির আওয়ামী লীগ আজ কোথায়?

বাণী ইয়াসমিন হাসি

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ শুধু একটা রাজনৈতিক দল নয়, আওয়ামী লীগ একটা অনুভূতির নাম। আমি আওয়ামী লীগের সন্তান, আওয়ামী লীগের ঘরেই আমরা জন্ম। আওয়ামী লীগ যখন ব্যথা পায়, আমারও কিন্তু হৃদয়ে ব্যথা লাগে। আওয়ামী লীগের একটা কর্মী যদি ব্যথা পায়, সেই ব্যথা আমিও পাই।’

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একটি অংশের নেতা কর্মীদের কনভেনশনে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন এই দলের নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এই দল মানুষের প্রয়োজনে কাজ করে যাচ্ছে এমনকি বলা যায় আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছে এই মানুষের প্রয়োজনেই।

দুর্যোগে, দুর্বিপাকে মানুষের কল্যাণে সবার পাশে আওয়ামী লীগ। দুর্যোগের মুহূর্তে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, এটি আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক চরিত্র। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এই দলটির যে কোনো সময়ে নিজেদেরকে মানুষের কল্যাণে উজাড় করে দিয়েছে। যেমনটি করেছে ১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ে, যার ভয়াবহ তাণ্ডবে ৫ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল, ১৯৮৫ সালের ঘূর্ণিঝড়, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় যার তাণ্ডবে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়, ২০০৭ সালের সিডর, ২০০৯ সালের আইলা এবং সম্প্রতি করোনার মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এই সকল দুর্যোগে আওয়ামী লীগ ও এই দলের নেতাকর্মীদের ভূমিকা ছিল অনন্য।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী একটি রাজনৈতিক দল। দলের জন্মের সঙ্গে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নাম জড়িয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নানা ঘাত প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে অন্ধকার দুঃসময় অতিক্রম করে দলটি বিকশিত হয়ে গণমানুষের আস্থার আর ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এই দেশে স্বাধিকার স্বাধীনতার সাফল্যে গৌরব অর্জন করে গোটা জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করে গণরায় নিয়ে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। পচাত্তরের ১৫আগস্ট পরিবার পরিজনসহ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে শুধু ক্ষমতাচ্যুতই করা হয়নি হাজার হাজার নেতা কর্মীকে দেশান্তরী ও কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে।

পচাত্তরের পর বা ২০০১ এর নির্বাচনের পর এমন লাখে লাখে ঝাকে ঝাকে আওয়ামী লীগ কিন্তু ছিল না। আজ গোটা দেশটাই যেন আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ। বিএনপি জামায়াত শাসনামলে এই সুযোগসন্ধানীরা তাদের ছাতার তলে ভিড় করেছিলে। আর আওয়ামী লীগের অনুভূতিপ্রবণ নেতা কর্মীরা শেখ হাসিনাসহ গ্রেনেড হামলার শিকার হয়েছিলেন। জেল-জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। মিথ্যা মামলা ও পুলিশি নির্যাতন ভোগ করে ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছিলেন। দলের সেই দুঃসময়ে আজকের এই মতলববাজদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার যদি কোন সংকট আসে, এরা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।

দলের দুঃসময় এলে এইসব হাইব্রিড, অনুপ্রবেশকারী সুযোগসন্ধানীদের যে খুঁজে পাওয়া যাবে না সেটি দলের হাই কমান্ডের উপলব্ধি করার সময় এখন। এইসব বসন্তের কোকিল বা কাউয়াদের এখন দূরে সরানোর সময়। তা না হলে নকলের ভিড়ে আসল হারিয়ে গেলে দলকে চড়া মূল্য দিতে হবে।

গত এক যুগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে সুযোগ সন্ধানী এসব আশ্রিতরা চাটুকারিতা মোসাহেবি ও নানা ‌অনৈতিক সুযোগ সুবিধা আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে নিজেদের আখের গোছানো ছাড়া আর কিছুই করেনি। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছিলেন ‘ত্যাগী কর্মীরা অভিমানী হয়, তারা বেইমানি করে না।’ আর এই সুবিধাভোগী নানা শ্রেণী পেশার যে নব্য আওয়ামী লীগারে ঐতিহ্যবাহী অনুভূতি প্রবণ দলটিতে গত ১২ বছরে ভরে গেছে তারা কেবল নিজেদের লাভ ক্ষতির হিসাবই বোঝে। সৈয়দ আশরাফের অনুভূতি বোঝে না। আবেগ অনুভূতিহীন স্বার্থান্ধ সুবিধাবাদী বর্ণচোরারা যখন যারা ক্ষমতায় তাদের পায়ের কাছে নানা বেশে দাসের মতো বসে থাকে। তাদের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে দলকে বিব্রত করে। ত্যাগী কর্মীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। তাদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এমনকি দেশের বাইরে থেকেও প্রতিদিন অসংখ্য ফোনকল পাই। সবার বক্তব্যের সারমর্ম করলে যেটা দাঁড়ায় সেটা হলো, দিনশেষে তাদের প্রিয় আপা আর দলটা ভালো থাকুক। ভাগ্যহত প্রেমিকের মতনই তাদের অবস্থা। দূর থেকেই যদি দেখে প্রিয় মানুষ আর সংগঠনটা ভালো আছে তাতেই সব তৃপ্তি আর প্রাপ্তি। হ্যাঁ তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় বৈকি। তারা তাদের আপাকে নিয়ে চিন্তিত, আপার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।

এদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, ব্যাপারটা কিন্তু এমনও নয়। তারা তাদের মায়া কাটাতে পারে না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাথে তাদের যে ঘোর লাগা প্রেম সেটা যেমন খাঁটি তেমনই দূর্নিবার। আফসোসটা কোথায় জানেন চটুল প্রেমিকের চটকদারী মোহে আসল প্রেমিককে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি তারপরও আশাবাদী। কারণ একজন শেখ হাসিনা আছেন যে। এই গ্রহণের কাল কাটবেই। অনুভূতির আওয়ামী লীগ আসল হীরে মানিক ঠিক খুঁজে নেবে। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ পথ হারাবে না। আওয়ামী লীগ যখন জেতে, একা জেতে। কিন্তু যখন হারে তখন গোটা দেশটাই হেরে যায়।
এদেশে পাপুলরা সপরিবারে এমপি হয়। সাহেদ সাবরিনাদের জন্য গণভবনের দুয়ার খুলে বসে থাকে কেউ কেউ। কেবল ওয়াসীর মায়ের জন্যই কেউ থাকে না। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে মরে যাওয়া ওয়াসীর মা আজ পর্যন্ত আপার সাথে দেখা করতে পারেননি।

না, ওয়াসীর মায়ের কান্না আপা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়নি কেউ। কারণ ওয়াসী যে ছাত্রলীগ করতো। ছাত্রলীগ করা এই সময়ে সবচেয়ে বড় অপরাধ যে! ওয়াসীর মায়ের ‌অন্তহীন অপেক্ষা। ওয়াসীর বয়স যখন তিন বছর তখন স্বামীকে হারিয়েছিলেন তিনি। তারপর একার সংগ্রাম।ছেলেকে দেশের নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি করিয়েছিলেন। হাজারটা স্বপ্ন বুনেছিলেন; ছেলে পাশ করে বের হলেই সব কষ্ট ধুয়ে যাবে।

এমন শত শত ওয়াসীর প্রেম মিশে আছে যে দলটাতে তার উল্টোপথে হাঁটা কর্মীদের রক্তাক্ত করে, যন্ত্রণা বাড়ায়। রাজনীতিতে নাকি ‌‌অভিমানের জায়গা নেই। কিন্তু গভীর প্রেম থেকেই তো অভিমান জন্ম নেয়। প্রতিটা কর্মীর তীব্রতম প্রেম তার সংগঠন। অনুভূতির অনেকটা জুড়ে এই প্রেম। হাজারো চটকদারী আর কেনাবেচার ভিড়ে সেই অনুভূতির আওয়ামী লীগ আজ কোথায় ?

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট।

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন

সর্বশেষ খবর