২৩ জুন, ২০২১ ১৯:২৩

প্রবাসে আওয়ামী লীগ

সুলতান মাহমুদ শরীফ

প্রবাসে আওয়ামী লীগ

১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে এসে ৬ দফা ও প্রদেশগুলোর পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ভিত্তিক একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রতিষ্ঠার জন্য যে গণ আন্দোলনের সূচনা করেন তারই ধারাবাহিকতায় তিনি প্রবাসে অবস্থানকারী মূলত বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি জনগোষ্ঠীকে একত্র করে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমস্ত বাঙালিদের একত্রিত করার একটি উদ্যোগের অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্যে তার শাখা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ১৯৬৯ সালে তিনি যখন আগরতলা মামলায় প্রবাসীদের অংশগ্রহণ ও সমর্থনকে বিশেষভাবে স্মরণে রেখে যুক্তরাজ্য সফরে আসেন তখন থেকেই প্রবাসে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার গোড়াপত্তন শুরু হয়। লন্ডন সফর থেকে ফিরে যাওয়ার সময় প্রবাসী বাঙালিদেরকে আওয়ামী লীগের একটি যুক্তরাজ্য শাখা গঠনের উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দেন। তারই ফলশ্রুতিতে ৬ দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রবাসে বাঙালিদের অধিকার আন্দোলনের যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল এই সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগ সংগঠন যাত্রা শুরু করে ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে। এরপর এখানে সংগঠনের প্রধান করা হয় লন্ডনে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য যে রিসিপশন কমিটি গঠন করা হয়েছিল তার চেয়ারম্যান প্রবীণ জননেতা গাউস খান সাহেবকে।     

গাউস খান সাহেবের লন্ডনে "এলাহাবাদ" রেস্টুরেন্টের ঠিকানাকে সংগঠনের প্রধান অফিস হিসেবে সে সময় ব্যবহার করা হয়েছিল। সেখান থেকে্ই দলের সমস্ত কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তখন দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন কুলাউড়া নিবাসী বদরুল হোসেন তালুকদার। এরইমধ্যে ৬ দফা আন্দোলনের সাফল্যের ফলে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে। আইয়ুবকে ক্ষমতাচ্যুত করে আরেক সামরিক জেনারেল ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। "লিগ্যাল ফ্রেইম ওয়ার্কের" আওতায় পাকিস্তানের শাসকরা ইতিহাসের প্রথম সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে একটি সাধারণ নির্বাচন দিতে রাজি হন। পাকিস্তানের গণতন্ত্রমনা দলগুলো এই সত্য মেনেই নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি হলে ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচনের দিন তারিখ ধার্য করেন। প্রবাসে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের কর্মীরা বাংলাদেশের জনগণের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং ৬ দফা ভিত্তিক একটি শাসনতন্ত্রের পক্ষে একটি ম্যান্ডেট নিতে বাংলাদেশের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার ব্রত নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন।

নির্বাচনের আগে প্রবাসীরা আওয়ামী লীগকে আর্থিকভাবে সাহায্য ও আনুসাঙ্গিক সহযোগিতার অংশ হিসাবে একটি বারো সিটের বড় বাস পাঠিয়ে দেন, নির্বাচনী প্রচারণায় সহযোগিতার জন্য। এই গাড়িটি আওয়ামী লীগের নির্বাচন প্রচারণায় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে জনগণের কাছে আওয়ামী লীগ কর্মীদের সহযোগিতায় ব্যবহৃত হয়। লন্ডনে বসে আমরা নির্বাচনে যাতে আওয়ামী লীগকে সকলে ভোট দেন তার প্রচারণা চালাতে থাকি এবং বিপুল উৎসাহের সাথে ৭০ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্রচারণা চালিয়ে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে বিপুল জয় হয় তাতে অবদান রাখতে সক্ষম হই। এই নির্বাচনে আমাদের সাহায্য সহযোগিতা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ কর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা যোগায়। ভোটে আমাদের বিপুল জয়লাভের মধ্যদিয়ে তার স্বাক্ষর পাওয়া যায়।  
১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কেন্দ্রে এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠন নিশ্চিত হয়। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সহযোগিতায় এর ফলাফলকে বানচাল করার জন্য ও ক্ষমতা হস্তান্তর না করার টালবাহানা শুরু করে। ঢাকা ও রাওয়ালপিন্ডিতে সামরিক জান্তা ও তার পদলেহী, অনুগ্রহ ভিক্ষাকারী জুলফিকার আলী ভুট্টো ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা হস্তান্তরের সকল আয়োজনকে ব্যর্থ করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। তারা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে সারা পাকিস্তানে সকল ইসলামী পছন্দ দল পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী ও পশ্চিম পাকিস্তানের লুটেরা বণিকশ্রেণী সহযোগিতা নিয়ে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বাধা সৃষ্টি করে। এই ষড়যন্ত্রের পথ ধরে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৫ তারিখে সমস্ত আলাপ আলোচনাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ইয়াহিয়া খান সামরিক বাহিনীকে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয় এবং ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।   
          
পূর্ব বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকদের নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করতে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আমরা একদিকে বাংলাদেশের জনগণকে অস্ত্র এবং অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিতে থাকি। অন্যদিকে বিশ্ব জনমত, বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন আদায় করার জন্য ব্রিটেনকে কেন্দ্রবিন্দু করে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ও তার নির্দেশে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় প্রবাসে তাতে নেতৃত্ব দিতে অকুতোভয়ে এগিয়ে আসি।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক, দেশবরেণ্য শিক্ষক, ব্যারিস্টার বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ২৬ শে মার্চ, ১৯৭১ থেকে জেনেভায় অবস্থিত তখনকার শান্তিমিশন জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব ত্যাগ করে লন্ডনে চলে আসেন এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় নেতৃত্ব দেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাকর্মী ছাড়াও বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেট, লুটন, ব্রাডফোর্ড, বার্মিংহাম, ওল্ডহাম, ম্যানচেস্টার, কার্ডিফ, পোর্টসমাউথ, ব্রিস্টল, ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড, সেন্ট আলবানস, কভেন্ট্রি, স্কটল্যান্ডসহ সমস্ত এলাকায় যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে শাখা কমিটিগুলো ছিলো সে সমস্ত কমিটিকে সক্রিয় করে তাদের মাধ্যমে সারা ব্রিটেনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটি গণজাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হই। বাঙালি ছাত্ররা যারা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলো তারা সকলে এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে ব্রিটেনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শ্রমিক, কর্মচারী হিসোবে কর্তব্যরত পূর্ব বাংলার সমস্ত নারী পুরুষরা ও আমাদের গৃহবধূরা সকলেই এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

আমাদের সেসময় যে হাজারখানেক রেস্টুরেন্ট ও গার্মেন্টস কারখানা ছিলো, সেখানে কর্তব্যরত সকল নারী, পুরুষ, কর্মচারীরা এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে স্থানীয় জনগণের সাথে যেমন আমরা বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরতে পেরেছি, তেমনি তাদের সহযোগিতা নিয়ে ব্রিটেনের জনগণের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে পাকিস্তানিদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে হটিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের সহযোগিতা, সমর্থন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ পেতে সক্ষম হই। আমাদের এইসব প্রচেষ্টার ফলে এদেশের ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব স্টুডেন্টস, ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব টিচারস, ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস, মাইনারস ইউনিয়নসহ সমস্ত শ্রেণি পেশার জনগণকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিতে সক্ষম হই। আমাদের প্রচেষ্টার ফলে এদেশের রাজনেতিক দলগুলো বিশেষ করে, তখনকার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল কনজারভেটিভ পার্টি, প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টি এবং অন্য বিরোধী দল লিবারেল পার্টির কেন্দ্র থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত নেতাকর্মীরা আমাদের সমর্থন ও সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। আমরা স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় প্রত্যেকটি সাংবাদিক ইউনিয়নের সংবাদকর্মীদের সাথে দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করে তাদের লেখার মাধ্যমে পাকিস্তানীদের অত্যাচারের কাহিনী ব্রিটিশ মিডিয়ায় প্রচার করে বিশ্ববাসীকে আমাদের পক্ষ সমর্থনের জন্য উৎসাহিত করি। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দুই মাসের মধ্যেই এদেশের সংসদের অধিকাংশ সদস্য বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি সম্বলিত সংসদে ব্যাপক আলোচনা নিয়ে আসতে সক্ষম হই।

দুই মাসের মাথায় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, এ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, খ্রিস্টান এইডসহ অনেক সংগঠনই পাকিস্তানিদের অত্যাচার বন্ধ করার দাবি জানাতে থাকে। ব্রিটেনের জনগণের এই সমর্থন আমাদেরকে, ইউরোপের অন্যান্য দেশের লোকদেরকে অনুপ্রাণিত করে এবং আমরা তাদের সমর্থন পেতে থাকি। ব্রিটেনের ছাত্রসমাজ, ব্রিটেনের যুব আন্দোলন ও ব্যাপক জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন নিয়ে আমরা ওয়েলস এবং স্কটল্যান্ডের রাজনৈতিক নেতা এবং জনগণের কাছে আমাদের এই দুর্দিনের কাহিনী প্রচার করতে সক্ষম হই এবং তাদের সমর্থন লাভ করি। এমনকি সাউদার্ন আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসসহ সকল ইউরোপীয় দেশের সমর্থন আমরা পাই। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এ সমস্ত কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। প্রবাসী বাঙালিদেরকে একত্রিত করে সংঘবদ্ধ করে এবং সুশৃঙ্খলভাবে যে আন্দোলন আমরা পরিচালনা করি তা ইউরোপীয় জনগণের কাছে একটি বিস্ময়কর অধ্যায় হিসেবে পরিগণিত হয়।  
     
বাংলাদেশের মানুষদের ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্যোগময় দিনে যখন পাকিস্তানীরা সমস্ত বাঙালি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করছিলো তখন, ভারতে অবস্থানকারী দেশ থেকে বিতাড়িত সহায় সম্বলহীন অবস্থায় প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করে ভারতবাসীর মধ্যে যে ব্যাপক সহানুভূতি সৃষ্টি করেছিল, তাতে ভারতের তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার ভারতের জনগোষ্ঠী বিশেষ করে বাঙালি  ও পাঞ্জাবি জনগোষ্ঠী আমাদের এই মরণপণ সংগ্রামে প্রতিদিন আমাদের সাথে একত্রিত হয়ে আমাদের মুক্তি প্রচেষ্টায় সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ করেছিলো। এর ফলে সারা ভারতবর্ষে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত জনগোষ্ঠী সমস্ত ভারতবাসী জনগণের যে সহানুভূতি, সহমর্মিতা পেয়েছে তা আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে অনন্তকাল স্মরণ করবো। বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক সমাজ, সমাজের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার জনগণ, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ এই দুর্দিনে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। বাঙালি জাতি তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে। আমরা প্রবাস থেকে এই ভালোবাসার উত্তাপ এই বিপদের দিনে প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করতে পেরেছিলাম। আমেরিকার শ্রমিকরা পাকিস্তানকে দেওয়া আমেরিকার অস্ত্র শস্ত্র জাহাজে উঠিয়ে দিতে অস্বীকার করে এবং কখনও কখনও মাঝপথে জাহাজ ডুবিয়ে দিতে সাহায্য করে আমাদেরকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছিল। যদিও আমাদের পার্শ্ববতী দেশ তখনকার গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সরকারের অসচ্ছ্ব রাজনৈতিক উদ্যোগের কারণে সেখানকার জনগণ তাদের মনোভাব প্রকাশ করতে পারেনি এবং আমাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তবুও তারা আমাদের ক্ষতিসাধনে ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে এই বিয়োগান্ত নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ এই কষ্টের নদী পার হয়ে বাঙালির আগত দিনের সুখ ও শান্তির প্রত্যাশা নিয়ে স্বাধীনতার এই ঊষালগ্নকে গ্রহণ করেছিল।   
   
যেদিন বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হলো, সেদিনের দেশের অবস্থার বর্ণনা এখানে প্রাসঙ্গিক। আমাদের সমস্ত দেশটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে আমাদের জীবন জীবিকার সকল পথ সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী সেদিন আত্মসমর্পণ করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশকে এরা সম্পূর্ণরূপে ছারখার করে দিয়েছিল। দেশের যানবাহন, রাস্তাঘাট, সেতু-কালবার্ট, জলোযানসহ যাতায়াতের সকল ব্যবস্থাকে এরা ধ্বংস করে রেখে গিয়েছিল। দেশের কোন বৈদেশিক মুদ্রা ছিলো না, বিদেশ থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়ের আর্থিক সক্ষমতা না জনগণের ছিলো, না সরকারের ছিলো। বহুকাল ধরে ব্যাপক লুটপাটের ফলে প্রয়োজনীয় খাদ্যাভাব এবং অভূক্ত মানুষের হাহাকার আরও বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল। এই অবস্থা থেকে দেশকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জনগণের প্রতিনিধিদের একত্রিত করে আওয়ামী লীগের যে সরকার গঠিত হলো তাকে, এই দুর্যোগ থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। প্রবাসী বাঙালিরা যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশকে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য তাদের সমস্ত সহায় সম্পদ যা বিদেশে ছিলো সবটাই নানাপথে নানাভাবে, দেশে পাঠিয়ে এই দুর্যোগময় অবস্থা থেকে উত্তরণের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। আমাদের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার অভাব তাদের সাধ্যমতো পূরণ করতে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যা আমরা তখনও দেশে তৈরি করতে অক্ষম ছিলাম তা জাহাজ ভর্তি করে করে দেশে পাঠিয়ে দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটানোর সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি। এর ফলে কিছুটা হলেও অন্ন, বস্ত্র সহ প্রয়োজনীয় সকল রশদ কম পরিমাণে হলেও প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব দেশের মানুষ মেটাতে সক্ষম হয়। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সারা ব্রিটেন থেকে কাপড়-চোপড়, শীতবস্ত্রসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠিয়ে দেশের মানুষের অভাব কিছুটা হলেও পূরণ সক্ষম হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রবল বাধা স্বত্ত্বেও কৃষককে জমির ফসল উন্নয়নে ব্যাপক সহযোগিতা দিয়ে সরকার খাদ্যের অভাব পূরণ করার প্রচেষ্টায় সফলকাম হয়। সারাদেশের মানুষকে উদ্দীপ্ত করে সরকার খাদ্যশস্যসহ সকল দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উৎপাদন শুরু করতে সক্ষম হয়। সারা ইউরোপের ব্যাপক জনগণের সমর্থন ও ভ্রাতৃপ্রতিম ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণের আন্তরিক সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় সাহায্যের ফলে ওষুধপত্রসহ  নানা সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়েছিলো।  

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির জনক ও তার পরিবার পরিজনকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে পাকিস্তানের দোসরররা মোস্তাক জিয়ার নেতৃত্বে জোরপূর্বক রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। এরা দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে ও ভয় ভীতি ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করে দেশের সমস্ত উন্নতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয় ও বাংলাদেশকে লুটপাটের একটি অভয়ারণ্যে পরিণত করে। ভয় ভীতি ও জোর জবরদস্তি করে দেশে এবং বিদেশে সমস্ত বাংলাদেশের নাগরিকদেরকে তাদের করায়ত্ত করার এই বিশ্বাসঘাতক সামরিক জান্তার সকল প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদেরকে একত্রিত করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নেতৃত্বে নতুনভাবে আরেকটি মুক্তিসংগ্রাম শুরু করতে হয়। এখানেও যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালিরা অগ্রণী নেতৃত্ব দেন এবং অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আমরা প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে ও দেশবরেণ্য সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সর্বাত্মক উদ্যোগকে সম্বল করে প্রবাস থেকে অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলাম। আমরা ইউরোপের দেশে দেশে ঘুরে সেসব দেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশের নাগরিকদেরকে একত্রিত করে দেশের অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত সৃষ্টি করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় লিপ্ত হই। বঙ্গবন্ধু কন্যাদ্বয় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এই সমস্ত আন্দোলনে আমাদের নেতৃত্ব দেন ও প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেন। ১৯৭৯-৮০ সালে প্রবাসে আমাদের আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। দেশেও বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ও দেশপ্রেমিক মানুষরা স্বৈরাচারী শাসকের উৎখাতের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের একাগ্রতার ফসল হিসেবে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। প্রবাসী বাঙালিদের ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে সাফল্যের নতুন সূর্যের প্রত্যাশা নিয়ে আসে। ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের জন্য দীর্ঘ অমানিশার অন্ধকার জীবন কাটাতে হয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ এসময় রাষ্ট্রক্ষমতায় আসলেও ৫ বছরের মাথায় দেশি ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফলে প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ ভুয়া ভোটারের কারসাজির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এরপর আবারও নতুন করে লক্ষ, লক্ষ দলীয় কর্মীদের উপর চলে আসে অত্যাচার ও নির্যাতনের স্টিম রোলার। এরই একপর্যায়ে আবার সামরিক জান্তার শাসন দেশকে গ্রাস করে। জেল-জুলুম অত্যাচারও নেত্রীর দীর্ঘ কারবরণের মধ্য দিয়ে জনগণের যে সংগ্রাম, তা সাফল্য দেখে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে। তখন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ও দেশের জনগণের সেবা করার সুযোগ পায়। সেই থেকে এ পর্যন্ত্ বাংলাদেশে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে জনগণের ব্যাপক কল্যাণ সাধণ করে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এই দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের প্রতিটি উন্নয়নে সমর্থন ও সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে দেশের আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং বৈষয়িক উন্নতিতে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। আমরা আজও প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সামাজিক অনুভূতি, ধর্মীয় মর্যাদাবোধ এবং বাঙালি জীবনের সকল সামাজিক ন্যায়বোধকে সুরক্ষা করে দেশের উন্নতিতে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা গর্বিত এই নতুন স্বাধীন সার্বভৈৗম বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতিতে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির নতুন প্রান্তে নিয়ে এসেছি। প্রবাসী বাঙালিরা দেশপ্রেমের এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আগামী দিনেও ধরে রাখতে সক্ষম হবে, এই প্রত্যাশা রাখি।    

 

লেখক : সভাপতি, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ 

সর্বশেষ খবর