২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১১:১৯

উন্নয়নের প্রতীক একজন কামরুল ইসলাম সিদ্দিক

নঈম নিজাম

উন্নয়নের প্রতীক একজন কামরুল ইসলাম সিদ্দিক

সময়টা ১৯৯৯ সালের মে মাস। আমি থাকি লালমাটিয়াতে। হঠাৎ সকাল সকাল ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙে। ঘুমচোখে ফোন ধরতেই অপরপ্রান্ত থেকে বললেন, আমি কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। আপনি তৈরি হোন। এলজিইডির বিদায়ী প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে এমনই সম্পর্ক ছিল। তিনি পিডিবির নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন। এলজিইডি থেকে বিদায় নিয়ে মন ভালো নেই। আসলে নিজের হাতে গড়া একটি প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নিতে কার ভালো লাগে? কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের অবস্থানও তাই। দেশের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রী তাকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে পাঠিয়েছেন। সাহসী মানুষটি মন খারাপ হলেও পিছু হঠেননি। নতুন দায়িত্বকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন। পিডিবি অফিসে তার প্রথম দিনে আমি গেলাম সঙ্গে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাঁড়িয়ে আছে ফুল নিয়ে। সবার সামনে সিবিএ’র প্রভাবশালী নেতারা। সবার পেছনে বড় কর্মকর্তারা। সামনে দাঁড়ানো সিবিএ নেতারা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন বড় বড় শ্রমিক নেতা হিসেবে। বিরক্ত হলেন কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। বললেন, এ প্রতিষ্ঠানে কার কি পরিচয় তা দিন। সিবিএ নেতা, শ্রমিক নেতা আমার কাছে বিবেচ্য নয়। এরপর বেরিয়ে এলো সবার প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়। এক পর্যায়ে সদস্য, প্রধান প্রকৌশলী পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বললেন, আপনারা পেছনে কেন? সামনে আসুন। পিছু হঠলেন সিবিএ নেতারা। 

পিডিবিতে তিনি দীর্ঘ সময় ছিলেন না। অতি অল্প সময়ে দেশের বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন। পিডিবির অভ্যন্তরীণ সংস্কারও করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে পিডিবির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি হতো না। যে যেখানে ছিলেন সেখানেই থাকতেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ, বদলি ছিল ট্রেড ইউনিয়নের দখলে। দায়িত্ব নিয়েই তিনি এ ধারা ভেঙে দেন। সারা দেশের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গণবদলি করেন এক জেলা থেকে অন্য জেলায়। এ ব্যাপারে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টা, নেতাদের কোনো তদবিরই তিনি আমলে নেননি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা বাড়াতে তিনি এমন করেন। কাজ না করলে নিয়োগ-বদলি স্বাভাবিক ঘটনা, এ দৃষ্টান্ত তিনি শুরু করেন। এ ব্যাপারে সিবিএ’র আধিপত্য, রক্তচক্ষুকে মূল্য দেননি। তিনি যোগদানের আগে পিডিবির কর্মকর্তারা ভয়ে থাকতেন। ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা সব কিছু চালাতেন। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক কর্মকর্তাদের অধিকার ফিরিয়ে এনে কাজের গতি সৃষ্টি করেন। 

আমাকে একবার নিয়ে যান আশুগঞ্জ পাওয়ার প্লান্ট দেখাতে। তখন মোবাইল টেলিফোনের যাত্রা মাত্র শুরু হয়েছে। আধুনিক ডিজিটাল যোগাযোগ থেকে আশুগঞ্জ পাওয়ার প্লান্ট পিছিয়ে। ফ্যাক্স ও টেলিফোন তারা ব্যবহার করত না। আমার হাতে থাকা মোবাইল ফোন দেখিয়ে তিনি বললেন, তোমরা মোবাইল কিনো। ফ্যাক্স চালু কর। এরপর চালু করবে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট। অনুমোদনের জন্য ঢাকায় ফাইল পাঠানোর দরকার নেই। টাইপরাইটার বদল করে কম্পিউটার কেনারও নির্দেশ দেন। পিডিবির হেড অফিসেও কম্পিউটার যুগের সূচনা কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের আমলে। বিদ্যুৎ খাতের লুটপাটও তিনি কমিয়ে আনেন। এ খাতের মাফিয়া ব্যবসায়ীদের তিনি লাঘাম টেনে ধরেন। এ মাফিয়াদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি মাঝে মাঝে আমাকে বলতেন।

আজ এতদিন পর একটি কথা বলছি, বিদ্যুৎ খাতের মাফিয়ারা কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। তাই তারাই উদ্যোগ নেয় কামরুল ইসলাম সিদ্দিককে সরিয়ে দিতে। তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে বদল হন তিনি। কাজের লোক থেমে থাকেন না। আজীবনের মুক্তিযোদ্ধাও বসে থাকেন না। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক পূর্ত মন্ত্রণালয়েও ভূমিকা রাখেন। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনিয়মের ভেড়াজাল ভাঙতে থাকেন। অসাধারণ দক্ষতার মধ্য দিয়ে রাজউকে মানুষের হয়রানি কমিয়ে আনেন। একবার আমি তাকে বললাম, লালমাটিয়া মাঠটি অবৈধভাবে বরাদ্দ দিয়েছে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। তিনি ক্ষুব্ধ হলেন। ব্যথিত হলেন। বললেন, বাচ্চাদের খেলার মাঠও রেহাই দেবে না? কাল সকালে আমার বাসায় আসুন। কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের ধানমণ্ডির বাসায় গেলাম। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ডাকলেন লালমাটিয়া মাঠের সামনে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দখলদারদের দেওয়া দেয়াল ভাঙালেন। অফিসে গিয়ে বরাদ্দ বাতিল করলেন। এভাবে রক্ষা পায় লালমাটিয়ার মাঠ।

কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের সঙ্গে আমার হাজারও স্মৃতি। কোনটা আগে বলি, কোনটা পরে বলি, বুঝতে পারছি না। এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী থাকার সময়ের কথা। সময়টা ’৯১ সালের শুরুর দিকে। আমি মাত্র বিয়ে করেছি। শ্বশুরবাড়ির প্রকৌশলী আত্মীয়ের বদলির জন্য একদিন অনুরোধ জানাই তখনকার জনশক্তি প্রতিমন্ত্রী (পরে পূর্তমন্ত্রী) ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াকে। তিনি বললেন, ওরে বাবা কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের কাছে কাজ? কারও কথা শোনে না। আমারও কাজ আছে তার কাছে। দাঁড়াও, এলজিআরডি সচিব মুশফিকুর রহমান আমার বন্ধু, তাকে বলছি। এতে কাজ হলো। রফিকুল ইসলাম মিয়া আমাকে বললেন, তুমি অপেক্ষায় থাক। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক মন্ত্রণালয়ে আছে। আমার রুমে মুশফিক তাকে পাঠাচ্ছে। তখন তোমার পরিচয় দিয়ে সমস্যা বলবে। ঘণ্টা দুই পর তিনি এলেন। রফিকুল ইসলাম মিয়া নিজের এলাকার উন্নয়নের কথা বলার আগে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি কাজ করি দৈনিক আজকের কাগজে। পরিচয় পেয়ে তিনি বললেন, আপনাদের সাপ্তাহিক খবরের কাগজ এরশাদের সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে কিছু অসত্য সংবাদ পরিবেশন করছে। নিউজটা ঠিক নয়। আমি বললাম, সমস্যা নেই। আমি কথা বলব নাঈম ভাইর সঙ্গে। যাই হোক দুপুরে কথা বলে সন্ধ্যায় অফিসে গেলাম। অবাক বিস্মিত হলাম। আমার সেই আত্মীয়ের বদলির অর্ডারের কপি টেবিলে। বাংলাদেশে কোনো সরকারি অফিসে এত দ্রুত কাজ হতে পারে? এই ছিলেন কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। ম্যান অব অ্যাকশন।

এলজিইডির অফিস তখন লালমাটিয়াতে। প্রকৌশলী সেলিম ও ইফতেখার তার সঙ্গে কাজ করতেন। এরপর মাঝে মাঝে ফোন করতাম। যেতাম কম। তবে মানুষটার কর্মদক্ষতার খবর রাখতাম। এরই মধ্যে একদিন কুষ্টিয়ার এক বন্ধু আমাকে নিয়ে গেলেন তার লালমাটিয়ার অফিসে। প্রাণবন্ত মানুষ। তার বিরুদ্ধে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা নানামুখী প্রচারণায় লিপ্ত। কর্মপাগল মানুষটি বিরক্ত। আমি আমার অবস্থান থেকে তার পাশে দাঁড়ালাম। এভাবে আমাদের সম্পর্ক শুরু। এরপর যখন খুশি আমি যেতাম। তিনিও ফোন করতেন। লালমাটিয়ার অফিসটির কাছেই ছিল আমার বাসা। সন্ধ্যার পর অনেক সময় হেঁটে যেতাম। আবার শুক্রবার, শনিবার তিনি অফিস করতেন। সুবিধা ছিল। দক্ষ, মেধাবী মানুষটি কাজই বুঝতেন। সচিবালয়ের ছোট দুটি কক্ষে যে এলজিইডির শুরু তার বিস্তার ঘটান লালমাটিয়ার ভাড়া বাড়ি থেকে। এরপর আগারগাঁওয়ে স্থাপন করেন প্রধান কার্যালয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অফিসটি উদ্বোধন করেন। মনে আছে, উদ্বোধনের আগে প্রতিদিন তিনি আগারগাঁও যেতেন। মাঝে মাঝে আমাকেও নিতেন। প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন চৌধুরী, আতাউল্লা ভুঁইয়া, শহীদুল হাসানসহ সবাই থাকতেন। কোথায় কোন অফিস হবে তিনি দেখে দেখে সিদ্ধান্ত দিতেন। শুধু তাই নয়, নিজে গাছ লাগানো পর্যন্ত সরেজমিন দেখতেন। সারা দেশের প্রতিটি অফিস ছিল তার নখদর্পণে। সব নির্বাহী প্রকৌশলী তটস্থ থাকতেন। সবাই তাকে বাঘের মতো যেমন ভয় পেতেন, তেমনি সম্মানও দিতেন। বলিষ্ঠ হাতে তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাকে বেশি সহায়তা করতেন শহীদুল হাসান। কাজে গাফিলতি তিনি বরদাশত করতেন না। প্রকৌশলীদের কর্মদক্ষতা বাড়াতে দেশ-বিদেশে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা নিতেন। এমন কাজপাগল মানুষ আমি আর দ্বিতীয় কাউকে দেখিনি। সততা, নিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা ছিল তার ভূষণ। বুকভরা সাহস নিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা কাজ করতেন। কোনো অন্যায় চাপের কাছে কখনো আত্মসমর্পণ করতেন না। আমার প্রতি তার স্নেহের শেষ ছিল না। এলজিইডির উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক। আমি তার রুমে বসে আছি। মিটিং দেখে চলে যেতে তৈরি হতাম। তিনি থামাতেন। বলতেন বসুন। দেখুন আমাদের কর্মকাণ্ড। আমি বসে থাকতাম চুপচাপ। তিনি প্রতিটি কাজের মনিটরিং করতেন। অদক্ষতা, অযোগ্যতা তার ডিকশনারিতে ছিল না। কাজ করার ক্ষেত্রে সময় বেঁধে দিতেন। নির্ধারিত সময়ের আগেই খোঁজখবর নিতেন। এই যুগে এমন সরকারি কর্মকর্তা বিরল। শুধু সরকারি কাজ নয়, সামাজিক কাজেও অংশ নিতেন অবসরে। ছুটে যেতেন কুষ্টিয়া ও খুলনায় পারিবারিকভাবে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা এবং সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো দেখতে।

একবার কুষ্টিয়া গেলাম তার সঙ্গে। যশোর থেকে যোগ হলেন সাংবাদিক ফখরে আলম। আমাদের নিয়ে গেলেন নিজের গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখাতে। এ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছে। বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠান। অতিথি ছিলেন প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। যশোর থেকে প্রতিমন্ত্রী এক গাড়িতে। আমি আর ফখরে আলম উঠলাম সিদ্দিক সাহেবের গাড়িতে। স্কুলের অনুষ্ঠান শেষ হলো। তিনি বাড়ির পাশের মাজার জিয়ারত করেন। এরপর যান নিজের বাড়িতে। বাবার সঙ্গে দেখা করেন। কুষ্টিয়ার উন্নয়নে তার অনেক অবদান। কুষ্টিয়ার বিষয়ে তিনি ছিলেন খাজা বাবা। কেউ এলে অনেক সময় পছন্দ না হলে হৈচৈ করতেন। কিন্তু কাজটা করে দিতেন। এলজিইডিতে এখনো কুষ্টিয়ার অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধু কুষ্টিয়াতে নয়, খুলনায়ও করেছেন। কুষ্টিয়া সফরকালে একটি ঘটনা আমাকে এখনো নাড়া দেয়। ফখরে আলম এবং আমাকে নিয়ে সার্কিট হাউসে যান তিনি। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকাল। ২০ মিনিট সার্কিট হাউসে অবস্থান শেষে যশোর ফেরার কথা। এক মহাঝামেলা তৈরি করে আওয়ামী লীগের কিছু লোক। তারা হুট করে কামরুল ইসলাম সিদ্দিককে ঘেরাও করে। তাদের দাবির শেষ নেই। কথার শেষ নেই। এমনকি অভিযোগেরও শেষ নেই। মূল অভিযোগ, আওয়ামী লীগের আরেকটি গ্রুপকে তিনি প্রশ্রয় দেন। আমি আর ফখরে আলম কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বুঝতে পারি বিকালের ফ্লাইটে বোধহয় ঢাকায় ফেরা হবে না। যে ঝামেলায় পড়েছি তা শেষ হতে সময় নেবে। ১০ মিনিট তিনি সবার হৈচৈ শোরগোল শোনলেন। তারপর আমাকে কাছে ডাকলেন। সবার সামনে আমার পরিচয় দিলেন। আমি হতবাক। কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে ধরে নিয়েছি পরিস্থিতির শিকার হলে সবাই মিলেঝিলে হব। কিন্তু কামরুল ইসলাম সিদ্দিক জানেন, কীভাবে ব্যক্তিত্ব দিয়ে সবকিছু সামাল দিতে হয়। তিনি ১০ মিনিটের মধ্যে সবকিছু সামাল দিলেন। সবাইকে শান্ত করলেন। এক পর্যায়ে আমার ডানহাত ধরলেন। আমরা গাড়িতে উঠলাম। পেছনের পরিস্থিতি ততক্ষণে শান্ত। আসলে তিনি সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারতেন।

আরেকটি ঘটনা। এলজিইডি অফিসে গেলাম এক বিকালে। আমার সঙ্গে সংসদ সদস্য মীর্জা আজম। রংপুরের দুজন এমপি এলেন। তারা প্রধান প্রকৌশলীর সামনের চেয়ারে বসা। আমি আর আজম ভাই বসলাম সোফাতে। হঠাৎ রংপুরের এক এমপি চেঁচামেচি শুরু করলেন। বললেন, এলজিআরডি মন্ত্রী রংপুরে যে অঙ্গীকার করে এসেছেন সেগুলো হয়নি। আপনি নিজেকে কি মনে করেন? এমপির বক্তব্যে শালীনতা ছিল না। আমরা দুজন হতবাক। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ইংরেজিতে বললেন, এটা আমার অফিস। আপনি এখানে চিল্লাচিল্লি করতে পারেন না। এখনই বের হন। আর আপনি ভবিষ্যতে আসার আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসবেন। হৈচৈ শুনে ছুটে আসেন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল হাসান। তিনি দুই এমপিকে নিয়ে বেরিয়ে যান। মীর্জা আজম আমাকে বললেন, চলুন। আজ যে কারণে আপনাকে নিয়ে এলাম বলব না। আমি বললাম, কামরুল ভাই আজ চলে যাই। তিনি হাসলেন। বললেন, বসুন। কফি দিতে বললেন আমাদের। কিছুক্ষণ গল্প-গুজবের পর আজম ভাইর সব কাজ করে দেন। হুমকি-ধমকি তিনি প্রশ্রয় দিতেন না। আরেকবার এক মন্ত্রী ফোন করেন অবৈধভাবে ঠিকাদারির এক তদবিরে। তিনি মন্ত্রীর ফোন ধরলেন না। এতে প্রভাবশালী সেই মন্ত্রী ক্ষুব্ধ হন। আমার সামনেই সবকিছু ঘটে। আরেকটি ঘটনা না বলে পারছি না। আওয়ামী লীগের তখনকার এক প্রতিমন্ত্রীর ফোন না ধরাতে তিনি ছুটে আসেন আগারগাঁও এলজিইডি অফিসে। আমি বসা ছিলাম তার সঙ্গে। তিনি আমাকে নিয়ে বের হওয়ার মুহূর্তে লিফটের সামনে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা। সোজা বললেন, আমি জরুরি কাজে বেরিয়ে যাচ্ছি। প্রতিমন্ত্রী বললেন, আমি আপনার কাছে এসেছি। তিনি থামলেন না। সোজা এসে আমাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন।

একবার আমার সঙ্গে ঘুরতে চলে গেলেন গাজীপুরে আমার বন্ধু মেজর (অব.) জাহাঙ্গীরের বাগানবাড়িতে। আমরা পুকুর থেকে মাছ তুললাম। তাজা মাছের ফ্রাই খেলাম। ফিরলাম রবীন্দ্রসংগীত শুনতে শুনতে। তবে ফেরার পথে তিনি হঠাৎ গেলেন এলজিইডির জেলা অফিসে। অফিসের চারপাশে গাছের সংখ্যা কম দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তাদের গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন। তিনি ছিলেন পরিবেশবান্ধব মানুষ। কুষ্টিয়ায় তার গড়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গাছ লাগিয়েছেন। আমি তার সঙ্গে দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি নিয়ে কথা বলেছি। আলোচনায় নাটক, থিয়েটার, চলচ্চিত্র সব প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।

কেন জানি তিনি আমাকে ভীষণ পছন্দ করতেন। রাত-বিরাতে আমরা আড্ডা জমাতাম। দেশ-জাতি-সমাজ কোনো কিছু বাদ থাকত না। শিল্প-সাহিত্য জগতের প্রতি তার সমীহ ছিল। নড়াইল ছুটে যেতেন এস এম সুলতানের খবর নিতে। নির্জনে পড়ে থাকা শিল্পীর জন্য সড়ক নির্মাণ করে দেন। ব্যক্তিগতভাবেও ফোন করে এস এম সুলতানের খবর নিতেন। এলজিইডির জেলা প্রকৌশলীর ওপর নির্দেশ ছিল এস এম সুলতানের খোঁজ রাখা। হুমায়ূন আহমেদের অনুরোধে সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেন। অনুরোধ রেখেছেন বেলাল বেগ, কবি নির্মলেন্দু গুণসহ আরও অনেকের। একদিন আমাকে বললেন, আমি দুজন সাংবাদিকের রিপোর্ট মনোযোগ দিয়ে পড়ি। একজন মোনাজাত উদ্দিন, আরেকজন ফখরে আলম। এ দুই সাংবাদিক গ্রামীণ উন্নয়নের কথা লিখেন। মানুষের অবহেলা-বঞ্চনার কথা তুলে ধরেন। সমস্যা আর সম্ভাবনার কথা জানান। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক তাদের রিপোর্ট পড়ে ব্যবস্থা নিতেন। শুধু তাই নয়, কথা বলতেন তাদের সঙ্গেও। পত্র-পত্রিকার চিঠিপত্রের কলামও তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। গ্রামের সাধারণ মানুষ তাদের রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্টের সমস্যার কথা লিখতেন। পত্রিকার কাটিং নিয়ে অফিসে যেতেন। শহীদুল হাসানকে ডাকতেন। বলতেন, এখনই খোঁজ নাও। সমস্যার সমাধান কর।

শেষ জীবনে দেখা কম হতো। কথা হতো বেশি ফোনে। মাঝে মাঝে নিজেই ফোন দিতেন। আমিও ফোন করতাম। একদিন সোনারগাঁও হোটেলে এলেন কয়েকজন বিদেশিকে নিয়ে। আমাকে ফোন করলেন। বললেন, আমার সঙ্গে লাঞ্চ করুন। আমি গেলাম। একটি চিঠি দেখালেন। পানি নিয়ে তার কাজের প্রশংসা করে চিঠিটি পাঠিয়েছেন উত্তর কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী। আমি বললাম, আজ আপনি সরকারি কোনো দায়িত্বে নেই। তারপরও নীরবে কাজ করে চলেছেন। দেশ ও মানুষের জন্য আপনার এই দরদ বিদেশিদের কাছে লুকিয়ে নেই। তারা আপনার কাজকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। আমরা না-ই দিলাম। আসলে নিজের স্বীকৃতির বিষয়ে তিনি ছিলেন লাজুক। কখনো নিজের প্রচার করতেন না। আমি এটিএন বাংলার বার্তা বিভাগের টকশোতে মাঝে মাঝে ডাকতাম। একবার এক টকশোতে আমি ছিলাম উপস্থাপক। এক পর্যায়ে তার প্রশংসা করে আমি কথা বলার পর দেখলাম, তিনি লাজুক হয়ে উঠছেন। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক এমনই ছিলেন। বিএনপির শেষ জমানায় তিনি ঢাকা আরবান প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন। ঢাকার আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে কাজ শুরু করেন। এ সময় ড. কামাল সিদ্দিক তাকে সহায়তা করেন। কিন্তু দুর্নীতিবাজ দুই রাজনীতিবিদের বিপক্ষে তার অবস্থানকে তারা ভালোভাবে নেননি। এক পর্যায়ে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয় ঢাকাকে বদলে দেওয়ার প্রকল্প থেকে। ঢাকা সিটির উন্নয়ন সেখানেই থেমে যায়। আর গতি পায়নি।

কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ছিলেন স্বাপ্নিক মানুষ। তিনি জানতেন, স্বপ্নকে কিভাবে জয় করতে হয়। কাজ করতেন জনগণের জন্য। দেশের কল্যাণের জন্য। অর্থনীতিকে বদলে দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি বদলে যাওয়ার আধুনিক রূপকার তিনি। তার এই বিশালত্বকে স্বীকার করতেই হবে। যারা তা স্বীকার করেন না তাদের মানসিকতাই ছোট। এলজিইডির বর্তমান নেতৃত্ব এই ছোট মন নিয়েই চলছেন। এলজিইডি থেকে তার ছবি অপসারণে আমি কষ্ট পাইনি। কারণ আমি প্রয়াত কামরুল ইসলাম সিদ্দিককে চিনতাম-জানতাম। এলজিইডিতে কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের কোনো স্মৃতিচিহ্ন থাকলে তার আত্মা আজ কষ্ট পেত। কারণ এলজিইডি এখন লুটেরাদের প্রতিষ্ঠান। জীবিত থাকলে এসব দেখে দুঃখ পেতেন। মৃত্যুর পর তার ছবি এলজিইডিতে থাকলে তার ভেসে বেড়ানো আত্মা আর্তনাদ করত। তাই ভালোই হয়েছে এলজিইডিতে তার কোনো স্মৃতিচিহ্ন না রেখে।

এলজিইডির এখনকার দায়িত্ববানরা কামরুল ইসলাম সিদ্দিককে মনে করছেন না। তার ছবি বা কোনো স্মৃতিচিহ্ন রাখেননি এলজিইডি অফিসে। তাতে কিছু যায়-আসে না। তিনি বেঁচে থাকবেন তার কাজে। সচিবালয়ের দুই রুমের অফিস দিয়ে এলজিইডির যাত্রা শুরু করেন। এরপর লালমাটিয়ার ভাড়া বাড়ি। পরের বিশালত্বের ইতিহাস সবার জানা। একাত্তরে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। স্বাধীনতার পর প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। দক্ষ প্রশাসক। মধ্যরাতেও অফিস করতেন। শুক্র, শনিবারও ছুটি কাটাতেন না। কর্মপাগল মানুষটির ছেলেমেয়েরা বাবার স্নেহ পায়নি। স্ত্রী বঞ্চিত হয়েছেন স্বামীর সান্নিধ্য থেকে। বাংলাদেশটাই ছিল কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের বুকজুড়ে। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। আর্তমানবতার সেবায় কাজ করতেন। সারা দেশ চষে বেড়াতেন। সব সময় চিন্তা-চেতনায় লুকিয়ে ছিল বাংলাদেশ। আমি এমন দেশপ্রেমিক মানুষ খুব একটা দেখিনি। তিনি আজীবন যোদ্ধা ছিলেন। একাত্তর সালে দেশের জন্য অস্ত্র তুলে নেন কাঁধে। এরপর স্বাধীন দেশে সংগ্রাম শুরু করেন উন্নয়নের। গ্রামীণ অবকাঠামোর আধুনিক রূপকার হিসেবে ভাবা হয় তাকে। তার তুলনা তিনি নিজেই। এমন দেশপ্রেমিক বার বার জন্ম নেয় না। একবারই নেয়।

পাদটীকা : মৃত্যুর কয়েক দিন আগে তিনি আমাকে ফোন করেন সুইডেন থেকে। বললেন, পানিবিষয়ক সেমিনার করে নিউইয়র্ক যাব। বেশ কিছুদিন থাকব। আমি জানতাম আমেরিকায় ছেলে-মেয়ে-বোন থাকেন। একবার ম্যানহাটনের রাস্তায় গাড়ি করে আমি ঘুরছি। কামরুল ভাই হাঁটছেন কন্যা ও বোনকে নিয়ে। গাড়ি থামিয়ে তার কাছে ছুটে গেলাম। তিনি আমাকে দেখে অভিভূত। আমারও ভালো লাগল। আসলে এই মানুষটিকে দেখলেই মন ভালো হয়ে যেত। সুইডেন থেকে নিউইয়র্ক গেলেন। উঠলেন ছেলের বাসায়। একদিন সকালে অফিসে এসে মেইল চেক করছি। আমাদের কয়েকজনকে একটি মেইল পাঠিয়েছেন কামরুল ভাই। তিনি নিউইয়র্কে ভালো আছেন। ফিরে আসবেন ঈদের পর। আমি মেইলটি পড়ছি। এমন সময় ফোন করেন এলজিইডির প্রকৌশলী ইফতেখার। তিনি বললেন, একটি শোক সংবাদ আছে। আমাদের স্যার নেই। তার গলা কান্নাজড়িত। আমি বুঝতে পারছি না কোন স্যার। তাই বোকার মতো প্রশ্ন করলাম, কোন স্যার। তিনি বললেন, কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। বিস্ময়ে হতবাক। বললাম, আপনার ভুল হচ্ছে। আমি মাত্র তার মেইল পড়ছি। তিনি ভালো আছেন। তিনি আবার বললেন, মেইলগুলো করার পরই তিনি ইন্তেকাল করেন। ফোন রেখে দিলাম। অনেকক্ষণ বাকরুদ্ধ ছিলাম। কি করে সম্ভব? কামরুল ভাই আপনি এত তাড়াতাড়ি এভাবে চলে গেলেন? 

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর