শিরোনাম
২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ২১:০৫

মামুন আমাদের দূর আকাশের তারা

আশরাফুল আলম খোকন, নাসিম রুপক, জয়দেব নন্দী, রোকন উদ্দিন ও শারমিন সুলতানা লিলি

মামুন আমাদের দূর আকাশের তারা

মামুন রশীদ

মামুন নামের হাসিমুখটা নেই, দেখতে দেখতে তিন বছর হয়ে গেল। যে মামুন আমাদের ভাই, আমাদের বন্ধু, আমাদের আপনজন। আসলে সে আমাদের কতটা আপন তা এখন বুঝিয়ে দিচ্ছে অস্থির সময়। এই যে সেদিনও, ফুটবলে মেসির দল বদল নিয়ে কয়েকজন আলোচনা করছিলাম। সেখানেও কোথা থেকে যেন এসে গেল মামুন। ব্রাজিলের কট্টর সাপোর্টার মামুন এখন কি কি বলতে পারতো তাই নিয়েও কত কথা হলো। সবাই হাসলাম। সাথে কাঁদলামও কি! মামুন নেই, আর দেখা হবে না; এটা ভাবতেই কেমন যেন হাত পা ঠান্ডা হয়ে ওঠে। 

মামুনের বয়সই বা কত হয়েছিল। ৩২ কিংবা ৩৩ হবে।  খুব সংক্ষিপ্ত বয়স কিন্তু তার জীবনের বৈশিষ্টের ব্যাপ্তি অনেক। না মামুন কোনো কিংবদন্তী টাইপ কিছু ছিল না। খুব সাধারণ একজন সাংবাদিক ছিল। আহামরি কোনো সিরিয়াস টাইপ সাংবাদিকও ছিল না। তবে কাজ করতে খুব পছন্দ করতো আড্ডা দিতে এবং সমস্যা সঙ্কুল মানুষের পাশে দাঁড়াতে আরো বেশি পছন্দ করতো। আমাদের যে কারো যে কোনো সঙ্কট ও সম্ভাবনায় মামুনের সরব উপস্থিতি থাকতো। সাংবাদিকতার জন্য সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি দরকার তা হলো যোগাযোগ বৃদ্ধির ক্ষমতা। এই ক্ষমতা সমসাময়িক সকলের চেয়ে মামুনের নিঃসন্দেহে বেশি ছিল। যারা মামুনের সংস্পর্শে এসেছে তারা সহজে মামুনকে ভুলতে পারবে না। আমাদের জুনিয়রদের যে কোনো ধরনের সমস্যা তারা আমাদের সাথে বলতে সংকোচবোধ করলেও মামুনকে নিঃসঙ্কোচে বলতে পারতো। তাই জুনিয়রদের কাছেও মামুন ছিল খুব প্রিয় একজন বড় ভাই।

জীবনের নৌকায় পাল তুলে হাল ছেড়ে দেয়া ছেলেটার নাম মামুন। তার মানে এই নয় যে সে বিপথে চলে গিয়েছিল। মানেটা হচ্ছে জীবনের নৌকা যে যেদিকে যায় যাক, আমি আছি; সেই বিশ্বাস। সচারচর দেখা যায় ৩০’র কোঠায় যাদের বয়স, জীবন নিয়ে তাদের কতশত পরিকল্পনা থাকে। কিন্তু মামুনের তেমন পরিকল্পনা ছিল বলে মনে হয়নি কখনো। হয়তো ছিল, বলেনি কাউকে। শুধু বলতো, এত চিন্তা করে লাভ নাই। এত পরিকল্পনা করার সময় এখনো আসেনি। সময় হলে সব হবে। কিন্তু জীবন যে তাকে নিয়ে এত বড় পরিকল্পনা করে রেখেছিল, তা কে জানতো। ভেতরে ভেতরে মামুন কি তা জানত! মনে হয় না। তবে ক্ষণজন্মা হবে বলেই হয়তো জীবন-ঘর-সংসার এসব আর ভাবায়নি তাকে।

মামুন কথা বলতো। কারণে বলতো অকারণে বলতো। তাকে চুপ থাকতে দেখা যেত খুব কম সময়। এই বেশী কথা বলার কারণেই কখনো কখনো অনেকের কাছে হয়ে ওঠতো বিরক্তিকর। কিন্তু সেই বিরক্তিকর মানুষটা পরের মুহূর্তে কিছু না বললে পরিবেশটাই অচেনা মনে হতো। মামুনের বড় গুণটি ছিল, তার ওপর বিরক্তি ধরে রাখা যেত না। এমন কিছু বলতো বা এমন সরল মুখে আরো সরল এক হাসি দিত; যা উপেক্ষা করার সাধ্য থাকতো না। যে কোন পরিবেশে মুহূতেই নিজের দিকে সবার দৃষ্টি ফেরাতে পারত মামুন। গুমোট পরিস্থিতির হাল্কা করতেও তার জুড়ি মেলা ছিল ভার। এমন কিছু করত বা এমন কিছু বলতো যে না হেসে আসলে পারা যেত না।

এখন আমাদের বকা দেবারও কেউ নেই। পরিচিতজনদের কাছে সবচেয়ে বেশী বকা খাওয়া ছেলেটা বোধহয় মামুন। কিন্তু কেউ তাকে কখনো দূরে ঠেলে দিতে পারেনি। বরং আরো কাছে এসেছে মামুন। হয়েছে আরো আপন।  এতজন এত কিছু বলতো ছেলেটাকে। কিন্তু কখনো তাকে কেউ রাগতে দেখছে কিনা সন্দেহ আছে। বরং তার ওপর কেউ রেগে গেলেও সে হেসে যেত। সেই হাসি দেখে তার ওপর আর রেগে থাকাই কঠিন হয়ে যেত। শুধু নিজে যে হাসতো তা নয়। মানুষকে হাসাতেও পারতো মামুন। তার কারণটা হলো মানুষ হিসেবে মামুন ছিল খুবই সহজ সরল মনের একজন। তার সরলতাই তাকে সবার কাছে আপন করে তুলেছিল। এখন চারপাশটা দেখি, আর খুজি মামুনের মতো এমন নিরাগ মানুষ কোথায়।

আমাদের আড্ডায়, গল্পে; কথার পিঠে কথা ওঠে। ফিরে আসে মামুন। বুকটা হাহাকার করে ওঠে। চোখের কোনে জমে জল। পৃথিবীর ঘড়িটা মামুনের জন্য থেমে গেছে ঠিক তিন বছর আগে। আমরা এখনো ঘুরছি সেই ঘড়ির চাকায়। আর অপেক্ষা, কদিন বাদেই আবার দেখা হবে মামুনের সাথে। যেখানেই থাকুক, ভাল থাকুক মামুন। ভাল থাকুক ওই দূর আকাশের তারা হয়ে। 

পুনশ্চ: ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর হৃদযন্ত্রে ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকরা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা একুশে টিভির সাংবাদিক মামুন রশীদ।

লেখক: আশরাফুল আলম খোকন, নাসিম রুপক, জয়দেব নন্দী, রোকন উদ্দিন ও শারমিন সুলতানা লিলি।

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন 

সর্বশেষ খবর