২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৩:৩৩

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ও জিয়ার রাষ্ট্রদ্রোহিতা

শ ম রেজাউল করিম

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ও জিয়ার রাষ্ট্রদ্রোহিতা

শ ম রেজাউল করিম

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। বিশ্ব ইতিহাসে ঘৃণ্য কালো আইন নামে যেটি সমধিক পরিচিত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে নিকৃষ্ট অন্তরায় হিসেবে আবর্তিত হওয়া জগদ্দল পাথর। একটি স্বাধীন দেশে জাতির পিতার নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচারের পথ বন্ধ করে দেওয়া পঙ্কিল অধ্যায়। একের পর সংবিধান লঙ্ঘনের কলঙ্কিত দলিল। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এমন কালো আইন নেই।  ‘প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজিব গান্ধী, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো, শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট বন্দর নায়েকসহ বিশ্বের অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিকে হত্যার পর সেসব হত্যার বিচার বন্ধ করে দেওয়ার জন্য এমন অধ্যাদেশ কোনো দেশেই জারি হয়নি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সংবিধান লঙ্ঘন করে স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি বনে যান খন্দকার মোশতাক আহমেদ। সামরিক আইন জারি করা হলেও সে সময় সংবিধান ছিল বলবৎ, যা ছিল এক অদ্ভুত ব্যবস্থা। সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে তদস্থলে উপ-রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপতিরূপে কাজ করবেন। একইভাবে রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে স্পিকার রাষ্ট্রপতিরূপে কাজ করবেন। সংবিধানের এ বিধান বলবৎ থাকা সত্ত্বেও উপ-রাষ্ট্রপতি এবং স্পিকার দুজনকেই বাদ দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাত্র ১ মাস ১০ দিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, এক্সট্রা অর্ডিনারি পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে স্বাক্ষর করেন খোন্দকার মোশতাক। এ অধ্যাদেশে ছিল দুটি ভাগ। প্রথম অংশে বলা হয়েছে- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে- রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন, তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর খুনিদের যাতে বিচার করা না যায়, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের আইনগত কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করা না যায় এবং হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্র ও নেপথ্যে জড়িতদের যাতে সুরক্ষা দেওয়া যায়, তার জন্যই এ অধ্যাদেশ জারি করা হয়।

অবৈধ রাষ্ট্রপতি মোশতাক কর্তৃক খুনিদের বাঁচানোর জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি ছিল দেশের সর্বোচ্চ আইন, সংবিধান পরিপন্থী। সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- ‘সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়া অবস্থায় অথবা উহার অধিবেশনকাল ব্যতীত, কোন সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট আশু ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রহিয়াছে বলিয়া সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে তিনি উক্ত পরিস্থিতিতে যেইরূপ প্রয়োজনীয় বলিয়া মনে করিবেন, সেইরূপ অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করিতে পারিবেন এবং জারি হইবার সময় হইতে অনুরূপভাবে প্রণীত অধ্যাদেশ সংসদের আইনের ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন হইবে’।

তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার অধীন কোনো অধ্যাদেশে এমন কোনো বিধান করা হইবে না, (ক) যাহা এই সংবিধানের অধীন সংসদের আইন-দ্বারা আইনসংগতভাবে করা যায় না। আইনানুগভাবে কী করা যাবে বা যাবে না, তা সংবিধানের ৭ ও ২৬ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। ৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে। এ ছাড়া ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্য আইন বাতিল হবে। ২৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- রাষ্ট্র সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্য কোনো আইন প্রণয়ন করবেন না এবং অনুরূপ কোনো আইন প্রণীত হলে তা মৌলিক অধিকারের কোনো বিধানের সঙ্গে যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক আইন জারি হলেও সংবিধানকে বাতিল করা হয়নি, বিধায় সংবিধানের বিধানাবলি বলবৎ ছিল। সংগত কারণে সংবিধানের উল্লিখিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধান অনুসারে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা একদিকে ছিল সংবিধান পরিপন্থী, অন্যদিকে যিনি জারি করেছিলেন তিনিও ছিলেন অবৈধ রাষ্ট্রপতি।

সংবিধানের মৌলিক অধিকার হিসেবে ৩১ নং অনুচ্ছেদে আইনের আশ্রয় লাভ এবং ৩২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না মর্মে বলা হয়েছে। একইভাবে ২৭ অনুচ্ছেদে আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারের কথা এবং ২৬ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্য আইন বাতিল বলে গণ্য হবে মর্মে উল্লেখ রয়েছে। উল্লিখিত বিধানের আলোকে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশে দুই ভাগে যেসব বিষয় উল্লেখ করে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা কোনোভাবেই রাষ্ট্রপতিকে অধ্যাদেশ জারির যে ক্ষমতা ৯৩ অনুচ্ছেদ দেওয়া হয়েছে, সেখানে ওই সুযোগ ছিল না। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী হওয়ায় তা সম্পূর্ণ বেআইনি। অপরদিকে সংবিধানের প্রস্তাবনায়, রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হিসেবে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার এবং সুবিচার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানে বর্ণিত আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার ও সুবিচার লাভের নিশ্চয়তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক ছিল, বিধায় সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শুরু থেকে (অধ্যাদেশ জারির মুহূর্ত থেকেই) অসাংবিধানিক ও বেআইনি ছিল। অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করায় মোশতাক ছিল আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ রাষ্ট্রপতি। একজন অবৈধ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারিকৃত সংবিধানবিরোধী অধ্যাদেশ আইনের পরিভাষায় ছিল অবৈধ।

খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষর থাকলেও এ অধ্যাদেশ জারির নেপথ্যের কারিগর ও মাস্টারমাইন্ড ছিলেন জেনারেল জিয়া, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার ৯ দিনের মাথায় তৎকালীন সেনাপ্রধানকে হটিয়ে নিজেই সেনাপ্রধান বনে যান। সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির পদ জবর-দখলকারী মোশতাকের প্রতি স্বঘোষিত সেনাপ্রধান জিয়ার আনুগত্য প্রকাশ, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির সঙ্গে জিয়ার সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পষ্ট করে। সেনাপ্রধান হিসেবে সংবিধান সমুন্নত রাখা, রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্যতা দেখানো তার সাংবিধানিক ও গৃহীত শপথের কর্তব্য ছিল। কিন্তু তিনি অবৈধ রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্যতা এবং অবৈধ রাষ্ট্রপতির বেআইনি অধ্যাদেশ প্রণয়নে ভূমিকা ও সমর্থনের দ্বারা অসাংবিধানিক কাজ করেন। খন্দকার মোশতাককে ৮২ দিন পুতুল রাষ্ট্রপতি রেখে নতুন অধ্যায়ের অবতারণা করে বিচারপতি আবু সাদাত মো. সায়েমকে বেআইনিভাবে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করেন। আইন অনুযায়ী অসাংবিধানিক সরকারের রাষ্ট্রপতি হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না বিচারপতি সায়েমের। ৮ নভেম্বর তাকে রাষ্ট্রপতি এবং সঙ্গে চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর করা হয়। যদিও বাংলাদেশে এরূপ কোনো পদের আইনগত অস্তিত্ব নেই। জিয়া হয়ে যান উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। বাংলাদেশের সংবিধানে বা অন্য কোনো আইনে এরূপ কোনো পদের অস্তিত্ব নেই। উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে বিচারপতি সায়েমকে দিয়ে কিছুদিন নিজের ইচ্ছা ও খেয়াল খুশিমতো সব কিছু করাতে থাকেন। একপর্যায়ে বিচারপতি সায়েম সাধারণ নির্বাচন দেওয়ার উদ্যোগ নিলে তা ভ-ুল করে রাষ্ট্রপতি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর অতি উচ্চাভিলাষী জিয়া ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি সায়েমকে অস্ত্রের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করে নিজেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে যান। এ অবৈধ অধ্যাদেশকে জোর করে বলবৎ রাখা হলেও ১৯৭৯ সালে সামরিক আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই অধ্যাদেশটি কার্যকারিতা হারায়। ফলে সে সময়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চাইলেই ১৫ আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু, বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। বঙ্গবন্ধু খুনের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের মাস্টারমাইন্ড জিয়া সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হিসেবে খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে পুরস্কৃত করেন। এবং স্থায়ীভাবে তাদের সুরক্ষা দিতে এবং অবৈধ ক্ষমতা দখলকে কেউ যাতে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে তা পাকাপোক্ত করতে অবৈধ অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করেন নিজ অনুগত সংসদে ১৯৭৯ সালে ৯ এপ্রিল। তখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি নিজেই অবৈধ আইনে স্বাক্ষর করেন। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করার মধ্য দিয়ে সংবিধান পরিপন্থী কর্মকান্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইতিহাসের অমোঘ সত্যের মুখোমুখি একদিন হতেই হবে, এ চিরন্তন বাস্তবতাকে ক্ষমতালোভে অন্ধ জিয়া ভুলে গিয়েছিলেন। সেনা কর্মকর্তা হিসেবে জিয়া শপথ নিয়েছিলেন জীবনের বিনিময়ে হলেও রাষ্ট্রপতি ও সংবিধানকে রক্ষা করবেন, একইরূপে সংবিধানকে সমুন্নত রাখার শপথ নিয়েছিলেন বিচারপতি সায়েম। কিন্তু করেছেন তার বিপরীত। সেনাপ্রধান অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী/সার্ভেন্ট জিয়া কখনই রাষ্ট্রপতি হতে পারেন না আইনের দৃষ্টিতে। কিন্তু চাকরিরত অবস্থায়ই নিজেকে রাষ্ট্রপতি দাবি করে ‘হ্যাঁ-না’ ভোট নামক প্রহসন করেছিলেন। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট জেনারেল জিয়া, মোশতাক ও সায়েমের রাষ্ট্রপতি পদ দখলকে অবৈধভাবে জবরদখল, সম্পূর্ণরূপে বেআইনি, অবৈধ, বাতিল ও অস্তিত্বহীন মর্মে ঘোষণা করে। এ ছাড়া জিয়া, মোশতাক ও সায়েমকে রাষ্ট্রদ্রোহী, সংবিধান ধ্বংসকারী হিসেবে ঘোষণা করেন।  রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ বৈধ জনপ্রতিনিধি দ্বারা শাসিত হয়নি। ফলে এ সময় যারা ক্ষমতা দখল করেছিলেন তারা অবৈধ। সংগত কারণে তাদের কৃত সব কর্মও ছিল অবৈধ।  আদালতের এ রায়, সংবিধানের বিধান অনুসারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এবং অমান্য তথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।

লেখক : মন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

 

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর