১১ অক্টোবর, ২০২১ ১০:৫৯

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূত ফিরিয়ে আনা হবে আত্মঘাতী

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূত ফিরিয়ে আনা হবে আত্মঘাতী

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর সাংবিধানিক শূন্যতা নিরসনকল্পে দেশের তিনটি রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল সে সময়ের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে প্রধান উপদেষ্টা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা হলে সেই সংকট কাটানো যাবে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাফল্যের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ঐকমত্য অনুযায়ী বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা শুধু এক টার্মের জন্য হওয়ার কথা ছিল, তাই ১৯৯০-এর নির্বাচনের পর সেই প্রথা বিলুপ্ত হয়। সেই নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বছর তিনেক ভালো চললেও ১৯৯৪ সালের মার্চে মাগুরায় উপনির্বাচনকালে অভূতপূর্ব ভোট ডাকাতির কারণে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুঙ্গে ওঠে। বিএনপি সরকার এ পদ্ধতিকে অসাংবিধানিক বলে প্রথমত প্রত্যাখ্যান করলেও ১৯৯৫ সালের ২৪ নভেম্বর পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি ভুয়া একপক্ষীয় নির্বাচন করলে জনমনে ক্ষোভ বেড়ে যায়। দেশের অর্থনীতিতে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় রাষ্ট্রপতির কাছে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাতিলের দাবি জানান। আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, সাংবাদিক এবং এনজিওরাও প্রতিবাদে অংশ নেয়। পরে ২৫ মার্চ দেশের আমলারা হরতালের ঘোষণা দিলে সমস্যা আরও ঘনীভূত হয় এবং সে পর্যায়ে খালেদা জিয়ার সরকার ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ সংবিধানে ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানে সন্নিভূত করে। ১৯৯৬ সালে প্রথম সেই পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়, যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান। সে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় এবং আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হয়। পরবর্তী নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের সরকার আর ১৯৯৬ সালের মতো সুনাম রক্ষা করতে পারেনি। ক্ষমতা গ্রহণের রাতেই অন্য উপদেষ্টাদের নিয়োগের আগে বিচারপতি লতিফুর রহমান হঠাৎ বেশ কয়েকজন সচিবকে বদলি করে প্রথম দিনটিই শুরু করেন বিতর্কিতভাবে। এটা ধরে নেওয়া হয় তিনি পদে যোগদানের আগেই সব নির্ধারণ করে রেখেছিলেন, যা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন ‘হোম ওয়ার্ক’ তথ্য দিয়ে। সে সব বদলি হওয়া সচিবদের জায়গায় তিনি বসালেন সুপরিচিত বিএনপি সমর্থকদের। তিনি একজন দীর্ঘ ছুটিতে থাকা অতি পরিচিত বিএনপি সমর্থক আমলাকে নজিরবিহীনভাবে ছুটি থেকে ফিরিয়ে এনে মুন্সীগঞ্জের ডিসির পদে বসালেন, যে ডিসি পদপ্রাপ্তির পর মুন্সীগঞ্জে সব আওয়ামী লীগ নেতাকে গণগ্রেফতার করে সে জেলায় আওয়ামী লীগের পরাজয় নিশ্চিত করা হয়। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সেই ডিসিকে পুরস্কার স্বরূপ ঢাকার ডিসি এবং পরে দ্রুততার সঙ্গে সচিব পদে বসান। মিজারুল কায়েস নামের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে কর্মকর্তা শ্রীলঙ্কায় ছিলেন তাকে আর শ্রীলঙ্কা থেকে ফিরতে দেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, বিএনপির শুভানুধ্যায়ী হিসেবে পরিচিত, জিয়াউর রহমানের সময়ে ঢাকার ডিসির পদপ্রাপ্ত, যে পদ শুধু অত্যন্ত আস্থাভাজন লোকদের দেওয়া হয়, আবদুল মুয়িদ চৌধুরী নামক সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক উপদেষ্টা রহস্যজনকভাবে হঠাৎ দীর্ঘ সময়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্র গমন করলে জল্পনা আরও প্রসারিত হয়। বিচারপতি লতিফুর রহমানের নিরপেক্ষতা এবং এমনকি সততাও ছিল মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এই মর্মে রব উঠেছিল যে বিচারপতি লতিফুর রহমান মোটা অঙ্কের উৎকোচ নিয়েছিলেন। যার বড় কারণ প্রমাণিতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার আত্মীয়দের নামে বাড়ি ক্রয়। তিনি প্রধান বিচারপতি থাকাকালেই যে বিএনপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বৈঠক করতেন, তা তার একান্ত সচিবই উল্লেখ করেছেন। সে নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয় কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, সে নির্বাচনের ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে, লতিফুর রহমানের সরকার থাকা অবস্থায়ই অমুসলিম সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর চরম তান্ডব চালায় বিএনপি। হাফিজুর রহমান নামক এক উপদেষ্টা তার পাবনার বাড়ি জামায়াতে ইসলামকে প্রদান করে, যা নিজামীর নির্বাচনী অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এভাবে তিনি তার জামায়াত প্রীতি প্রমাণ করেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন এবং হাবিবুর রহমান নিরপেক্ষতা এবং সততার যে সুনাম অর্জন করেছিলেন তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দৃশ্যত অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা এবং দুর্নীতির অভিযোগের কারণে। তখনই এই পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরের ঘটনা আরও ভয়াবহ। দেশের অষ্টম নির্বাচন ঘনিয়ে এলে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের স্থায়িত্ব দুই বছর বাড়িয়ে দিলে যৌক্তিকভাবে ধরে নেওয়া হয় যে প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান সাহেবকে, যিনি আগে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার জন্যই বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো হয়। এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে অতি ভদ্র বিচারপতি হাসান ঘোষণা দেন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের পদ নেবেন না। তার এই ঘোষণা ঘটনাকে আরও জটিল করে দেয়। কে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান হবেন সে বিতর্ক যখন রাজনীতির মাঠকে গরম করে তোলে, তখন সে বিষয়ে একটি রিট মামলার রায় প্রদানের পূর্বমুহুর্তে বিএনপি সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেলের অভূতপূর্ব মৌখিক আবেদনের মুখে জামায়াতপন্থি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মোদাসসের রিট শুনানি করা বেঞ্চটি, বিচার বিভাগের সমস্ত নজির ভঙ্গ করে, ঠিক রায় প্রদানের পূর্বমুহুর্তে ভেঙে দিলে নতুন আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। উল্লেখ্য, বিচারপতি মোদাসসের অবসরের পর থেকে জামায়াতের উপদেষ্টা পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। এসব ঘটনা চলাকালে সমস্যার সমাধানের পথ বের না করে, সে সময়ের বিএনপিপন্থি এবং তাদের দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আকস্মিকভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দেশকে ঠেলে দেন এক ভয়াবহ সংকটে। এতে নেপথ্যের নায়ক ছিলেন অধ্যাপক ইউনূস এবং ড. কামাল হোসেন যারা দুজনই কট্টর আওয়ামীবিরোধী। এ অবস্থা চলতে থাকে ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত। সেই জরুরি সরকারের বিরুদ্ধে পর্বত প্রমাণ দুর্নীতি, নৈরাজ্য, স্বেচ্ছাচারিতা এবং নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। নির্যাতন, হুমকি, জেল-জুলুমের মাধ্যমে কুশীলবরা প্রচুর টাকা বিভিন্নজন থেকে হাতিয়ে নেয়। সে সরকারের এক উপদেষ্টার ভাই বিএনপির টিকিটে নির্বাচন প্রত্যাশী ছিলেন। এ ধরনের নৈরাজ্যকর অবস্থায় জনমনে বিভীষিকার সৃষ্টি হলে অবশেষে ২০০৮ সালে নির্বাচন দিয়ে কুশীলবরা প্রচুর অর্থ পাচার করে বিদেশে পাড়ি জমায়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর মানুষ বীতশ্রদ্ধ হলে অবশেষে হাই কোর্টে এর বৈধতা নিয়ে একটি রিট মামলা হয়, যে মামলার রায়ে মহামান্য আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক বিধায় অবৈধ ঘোষণা করেন। রায়ে মহামান্য আপিল বিভাগ ব্যক্ত করেন যে সংবিধানের ১৩তম সংবিধানের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি দেশের প্রজাতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য, গণতন্ত্র, গণপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংবিধানের এসব মৌলিক স্তম্ভকে ধ্বংস করে দিয়েছে। মাননীয় বিচারপতিগণ আরও উল্লেখ করেছেন, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি ব্যতীত সংবিধান অনুযায়ী কেউ দেশ শাসনের যোগ্য নয় বলে এই অনির্বাচিত গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায় না।

মাননীয় বিচারপতিবৃন্দ বলেছেন যে, গণতন্ত্রকে এক মুহুর্তের জন্যও পরিত্যাগ করা যায় না, কারণ এটি সংবিধানের একটি মৌলিক স্তম্ভ। তারা আরও বলেছেন, বাংলাদেশ একটি প্রজাতন্ত্র, এর রাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্য গণতান্ত্রিক, জনগণই এই প্রজাতন্ত্রের মালিক। এগুলো সবই সংবিধানের মৌলিক স্তম্ভ। আরও এক মৌলিক স্তম্ভ হচ্ছে স্বাধীন বিচার বিভাগ। যেই মৌলিক স্তম্ভ গুঁড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কারোরই নেই। উক্ত রায়ের মূল চেতনায় ছিল গণতন্ত্র এবং জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার কথা। তারা উল্লেখ করেন প্রতিনিধিত্ব এবং দায়বদ্ধতা হচ্ছে ক্ষমতার মৌলিক তত্ত্ব।

মাননীয় বিচারপতিগণ দেশ শাসনে সামরিক হস্তক্ষেপের কঠোর নিন্দা করেছেন এবং অতীতে যে সব বিচারপতি সামরিক শাসনের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন তাদের নিন্দা করেছেন। মাননীয় বিচারপতিবৃন্দ যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন তুলেছেন যেখানে ১৯৭২-এর আদি সংবিধানে সব রাষ্ট্রযন্ত্রের ঠিকমতো চলার বিধান সন্নিবিষ্ট করা ছিল, সেখানে কেন ১৯৯১ সালে এসে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা দিল। তারা উল্লেখ করেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য একটি মুক্ত এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের কোনো বিকল্প নেই এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার সে স্থান দখল করতে পারে না। মাননীয় বিচারপতিবৃন্দ আরও উল্লেখ করেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এক ধরনের গোষ্ঠীবাদের সরকার ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে যা গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী। তারা আরও উল্লেখ করেন যে, যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আয়ুষ্কাল ৯০ দিন বলে নির্ধারিত, সেখানে সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন ভঙ্গ করে দুই বছর ক্ষমতায় ছিল।
মাননীয় বিচারপতিবৃন্দ উল্লেখ করেছেন, জনগণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিক, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস, জনগণই সার্বভৌম, বাংলাদেশ সরকার মানুষের সরকার নয়, আইনের সরকার, জাতীয় সংসদ সংবিধানের সংশোধন করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলেও রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি ও সংবিধানের মূল স্তম্ভগুলো খর্ব বা সংশোধন তারা করতে পারেন না এবং ১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন সংবিধানের মূল স্তম্ভ খর্ব করেছে বিধায় এটি অসাংবিধানিক, অবৈধ, সুতরাং বাতিল।

কোনো অজুহাতে সংসদ প্রজাতন্ত্র এবং গণতন্ত্র ক্ষুণ্ণ করে গোষ্ঠীতন্ত্র আনয়ন করতে পারে না। যে কোনো সংশোধন সংবিধানের সীমার মধ্যেই থাকতে হবে, অন্যথায় এটা হবে সংবিধানের আত্মহত্যার শামিল।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভয়াবহতার উল্লেখ করে মাননীয় বিচারপতিবৃন্দ বলেন, ১৯৯৬ সালের ২০ মে অষ্টম সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই, এমনকি তার উপদেষ্টা পরিষদের শপথ নেওয়ার আগেই বিচারপতি লতিফুর রহমান কয়েকজন সচিবকে বদলির আদেশ প্রদান করেন। পরে বহু কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। ফলে একটি রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর অনাস্থা জ্ঞাপন করতে থাকে। ২০০৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স ৬৫ থেকে ৬৭ করা হলে বিরোধী দল আপত্তি উত্থাপন করে বলেন, এক বিশেষ প্রধান বিচারপতিকে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান উপদেষ্টা করার উদ্দেশেই এই পরিবর্তন। ২০০৬ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়োগের প্রাক্কালে রাষ্ট্রপতি নিজেই প্রধান উপদেষ্টার পদ দখল করে নিলে প্রবল উত্তেজনা ও আন্দোলন শুরু হয়, দেশে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়, এমনকি সেনাবাহিনীও মোতায়েন করা হয়। সে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দিয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং পরে নিজেই প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন যা দুই বছর ক্ষমতায় ছিল যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থায়িত্ব ৯০ দিনের বেশি হওয়ার কথা নয়। তারা বলেন, ‘ইহাই হইল বহুল প্রচারিত এবং অতি প্রশংসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাফল্যে সরকারি ভাষ্য। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।’ আরও উল্লেখ করেন প্রকৃতপক্ষে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, যা প্রয়োজন তা হলো কারচুপিহীন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যার জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী, স্বায়ত্তশাসিত ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনের আগে এবং পরে নানান ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে, যা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ও কৃতিত্বের সাক্ষ্য বহন করে না। ‘ইহা আর যাই হোক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সাফল্যের পরিচয় বহন করে না।’ “বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জের সমাজে এই ঘটনা আমাদের সম্মান বৃদ্ধি করেই না, বরঞ্চ ইহা চরম অপমানজনক। আশ্চর্য সেই অপমান উপলব্ধি করিবার ক্ষমতাও যেন আমরা হারাইয়া ফেলিয়াছি। উপরন্তু সেই ব্যবস্থা পাঁচ বছরব্যাপী জনপ্রতিনিধিদের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বকে নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করিয়া তোলে। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ধারণা আমরা সৃষ্টি করিয়াছি বলিয়া গর্ব করিয়া বোকার স্বর্গে বাস করি।”

রায়ের সারমর্মে উল্লেখ করা হয়, “সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন ১৯৯৬ অসাংবিধানিক ও অবৈধ হইলেও জাতীয় সংসদ ইহার বিবেচনায় (ফরংবৎবঃরড়হ) ও সিদ্ধান্ত অনুসারে উপরে বর্ণিত নির্দেশাবলি সাপেক্ষে দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনকালীন প্রয়োজনমত নতুনভাবে ও আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।”

মাননীয় বিচারপতিদের এই উক্তিকে বহুজন ভুল বুঝে মনে করেছেন যে অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো সরকারই দুই দফা চালানো যাবে। যারা এটা ভাবেন তারা সেই সম্পর্কীয় ভাষাগুলো ঠিক করে উপলব্ধি করতে পারেননি। মাননীয় বিচারপতিগণ বলেছেন, ‘উপরে বর্ণিত নির্দেশাবলি সাপেক্ষে দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনকালীন প্রয়োজনমত নতুনভাবে ও আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।’

এর থেকে যা পরিষ্কার তা হলো এই যে নতুন আঙ্গিকে তেমন সরকার ব্যবস্থা গঠন করা যাবে যা হবে আপিল বিভাগের রায়ে ঘোষিত নির্দেশনাবলি সাপেক্ষে, অর্থাৎ সে সরকারকে হতে হবে গণতান্ত্রিক এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে, কেননা সেটিই গোটা রায়ের মূল ভাষ্য। সোজা কথায় নতুন আঙ্গিকে সৃষ্ট সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত সরকার, অনির্বাচিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সমন্বয়ে নয়। আরও সোজা ভাষায় বলতে গেলে যে সরকার ক্ষমতায় রয়েছে তাদেরই একটি ছোট অংশ দ্বারা গঠিত হতে হবে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

রায়ে মাননীয় বিচারপতিগণ শক্তিশালী এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে যে বিতর্ক চলছে সেদিকটা দেখা প্রয়োজন। সংবিধানে ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ এখানে যেহেতু বলা আছে ‘প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে’, তাই এ ধরনের কোনো আইন প্রণীত হয়েছে কিনা তা দেখা দরকার। এটা ঠিক যে পার্লামেন্ট এ ধরনের কোনো আইন প্রণয়ন করেনি। কিন্তু সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে আইনের যে ব্যাখ্যা রয়েছে তাতে শুধু পার্লামেন্ট প্রণীত আইন বা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের কথাই উল্লেখ করা হয়নি, এতে বলা আছে “আইন অর্থ কোনো আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপআইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যে কোনো প্রথা বা রীতি।” সে অর্থে ‘আদেশ’ ‘বিধি’ ‘বিজ্ঞপ্তি’ এবং ‘আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যে কোনো প্রথা বা রীতি’ ও আইনের সংজ্ঞাধীন। যারা বলেন আইন করা প্রয়োজন তারা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন যে, বর্তমানে ‘সার্চ কমিটির’ যে নিয়ম রয়েছে সেটিও মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশ, বিজ্ঞপ্তি বলেই করা হয়েছে বিধায় সেটিও আইনবহিভর্‚ত নয়। তদুপরি সার্চ কমিটি পদ্ধতির প্রচলন করা হয়েছিল সবকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের সম্মতিক্রমে। সার্চ কমিটিতে থাকেন আপিল বিভাগ, হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি এবং সরকারি কর্মকমিশনের প্রধান। এরা কেউই সরকারের সদস্য বা কর্মকর্তা নন, বরং সাংবিধানিক পদের ধারক। তাদের কেউই সরকারি নিয়ন্ত্রণে না থাকায় এই সার্চ কমিটিই নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারে।

অন্যদিকে পার্লামেন্ট যদি আইন প্রণয়ন করে তাহলে সেই আইনে সরকার কর্তৃক নিজ পছন্দের লোক বাছাইয়ের ক্ষমতা থাকার সম্ভাবনা থাকতে পারে, ফলে বাছাই প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষতা লঙ্ঘনের সম্ভাবনা থাকবে। আগে বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি বহু বছর ক্ষমতায় ছিল, তারা কেন এটি চিন্তায় আনেনি?

মহামান্য আপিল বিভাগ আইনের বিশ্লেষণের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিকে যথাযথভাবে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। তাছাড়াও এটি যে ২০০৬ সালে দেশে ত্রাস এবং নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে অসাংবিধানিক শাসনের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, সে কথাও উপলব্ধি করা প্রয়োজন। ৯০ দিনের সীমাবদ্ধতাকে বেআইনিভাবে লঙ্ঘন করে দুই বছর লুটপাট এবং অরাজকতার রাজত্ব চালানো সম্ভব হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির সিঁড়ি বেয়ে। সেই অবৈধ সরকারের উদ্দেশ্য ছিল দেশকে রাজনীতি শূন্য করা, তাদের ইচ্ছা ছিল আরও অনেক সময় সামরিক সহায়তায় স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে ক্ষমতায় থাকা। কিন্তু প্রবল গণদাবির মুখে সেটি তারা করতে পারেনি। তারা দুর্নীতির সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করে, অর্থ পাচার করে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। পূর্বে বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা এবং অসততার কথা মনে হলেও এই পদ্ধতির প্রতি মানুষের কোনো শ্রদ্ধাবোধ থাকতে পারে না। ভবিষ্যতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলে যে অতীতের অরাজকতার পুনরাবৃত্তি হবে না, স্বৈরাচারী সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? সুতরাং সর্ব অর্থেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে ত্যাজ্য করতে হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থে, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের স্বার্থে, নৈরাজ্য এবং একনায়কতন্ত্র থেকে দেশকে রক্ষার জন্য এই পদ্ধতিকে বিদায় জানানোর কোনো বিকল্প নেই। আজ যে সব রাজনৈতিক দল একে ফিরিয়ে আনার পক্ষে কথা বলছে, ফিরিয়ে আনা হলে তারাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের জনগণ, ধ্বংস হবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।


বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর