১৮ অক্টোবর, ২০২১ ১১:৩৬

রাসেল আমাদের অনুভূতি

ড. কাজী এরতেজা হাসান

রাসেল আমাদের অনুভূতি

শেখ রাসেল। ফাইল ছবি

বাঙালি জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য যে নেতার জন্ম, যিনি পরাধীনতা থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করেছিল, যার নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ছিনিয়ে এনেছিল লাল সবুজের পতাকা, অর্জন করেছিল স্বাধীনতা; তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ রাসেলের পিতা। ১৮ অক্টোবর ১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিল শেখ রাসেল। রাসেল নামটি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই। বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বার্ট্রান্ড রাসেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তানের নাম রাখলেন শেখ রাসেল। বাবাকে খুব বেশিদিন কাছে পাননি রাসেল। বাবাকে দেখতে না পেয়ে মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে আব্বা বলে সম্বোধন করতেন রাসেল। এই চাপা কষ্ট যেমন অনুভব করতেন ছোট্ট শিশু রাসেল, ঠিক তেমনি তার বাবা শেখ মুজিবও। যা ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর লেখা আত্মজীবনীতেও। 

‘কারাগারের রোজনামচা’য় শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। কি উত্তর ওকে আমি দিব? ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মা’র বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’ আজ হয়ত শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধুর মতই বাঙালি জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতেন, বিশ্বের শোষিত মানুষের নেতা হতেন। হয়তো শেখ রাসেল কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর মত নেতৃত্ব দিতেন বাবার উত্তরসূরি হিসেবে। অথবা বাবার দেওয়া নামের স্বাক্ষর রাখতেন নিজ তেজি জ্ঞান দিয়ে গবেষণা ও লেখায়। আমি যখন রাসেলের কোনো ছবি দেখি, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। কি সুন্দর মায়াবী চেহারা, বুকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসতে ইচ্ছা করে। খুনিরা কি করে পারল শেখ রাসেল কে হত্যা করতে? খুনিরা কিভাবে গুলি করেছিল শেখ রাসেল কে? ছোট্ট রাসেলের কান্নায় একবার মায়া হয়নি তাদের? খুনিরা তো এই সমাজেরই লোক ছিল। তাদেরও তো পরিবার ছিল, সন্তান ছিল। রাসেলের মত সন্তান তাদের ঘরেও ছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মম ভাবে হত্যা করার পরেও কেন শিশু রাসেলকে হত্যা করলো? বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে, এদেশের মানুষকে ভালোবেসে বঙ্গবন্ধু যে অপরাধ (!) করেছিল এই অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু কি অপরাধ করেছিল রাসেল? কেন রাসেলকে হত্যা করা হলো? সেদিন রাতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত চিরতর ধরনী থেকে মুছে ফেলতে রাসেলকে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ খুনিরা জানতো, বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরিরা একদিন লাল সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অশুভ শক্তি বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করবে। যার জ্বলন্ত উদাহরণ বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরি তার সুযোগ্যা কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময় বিদেশে থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। আর এ গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হত্যা করলে বিচার হবে, এটিই মানুষের কাছে সরকারের দায়বব্ধতা। কিন্তু সেদিন বাংলাদেশে খুন করার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সাংবিধানিকভাবে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে একটি জঘন্যতম আইন পাশ করা হয়েছিল, ১৫ আগস্ট এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না, যার নাম ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’। ১৯৭৫ সালে ২৬ সেপ্টেম্বর ‘ইনডেমনিটি’ (দায়মুক্তি) বিলটি অধ্যাদেশ আকারে জারি করে খন্দকার মোশতাক আহমেদ। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ আইনে পরিণত করে। ১৯৭৯ সালে ৯ জুলাই কুখ্যাত রাজাকার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শাহ্ আজিজুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র সংসদের ৫ম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বিলটি সংসদে পেশ করেন। ৫ম সংশোধনী সংসদে পাশ হলে বিলটি আইনে পরিণত হয়। কোনো সভ্য দেশে হত্যার বিচার হতে পারবে না এমন জঘন্যতম আইন পাশ হতে পারে না। কিন্তু কি অদ্ভুত, এই আইনটি সেদিন বাংলাদেশে পাশ হয়েছিল! যারা এই আইনটি পাশ করেছিল তারা বাংলাদেশেরই মানুষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা। পৃথিবীর কোন সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে এমন আইন পাশ হলে তাদের রাজনীতি করার অধিকার থাকতো না। আইনের আওতায় এনে তাদের বিচার করা হতো। জার্মানিতে ৭৪ বছর পরেও নাৎসি এবং তাদের সহযোগী ও সমর্থকদের খুঁজে খুঁজে বিচার করা হচ্ছে। গত বছর ডিসেম্বর মাসে হামবূর্গ শহরে ব্রুনো নামের ৯৩ বছর বয়স্ক এক বৃদ্ধকেও দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় জার্মান আদালত।

বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি শেখ হাসিনা বেঁচে ছিলেন বলেই আমরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিচার পেয়েছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। শেখ রাসেলের জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের প্রত্যাশা পবিত্র সংসদে যারা ‘ইনডেমনিটি’ আইন পাশ করেছিল, যারা এই আইনকে সমর্থন করেছিল এবং যারা ইতিহাস বিকৃত করেছিল তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের চিহ্নিত শত্রু। তাদের বিচারের ব্যবস্থা করে আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। জন্মদিনে শেখ রাসেলকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ থাকবে, ততদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাথে শেখ রাসেলও বেঁচে থাকবে অনির্বাণ ভালোবাসা হয়ে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা, সদস্য, কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও পরিচালক, এফবিসিসিআই।


বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর