২০ নভেম্বর, ২০২১ ১৯:৪০

জাহাঙ্গীরের শাস্তি : মাইম্যানদের জন্য কঠিন বার্তা

বাণী ইয়াসমিন হাসি

জাহাঙ্গীরের শাস্তি : মাইম্যানদের জন্য কঠিন বার্তা

বাণী ইয়াসমিন হাসি

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। শুক্রবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ ওঠে। গত ২২ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। চার মিনিটের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, মহান মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলকে কটূক্তি করেন। এমনকি রাষ্ট্রীয় দুটি সংস্থা নিয়েও নানা আপত্তিকর মন্তব্য করেন তিনি। জাহাঙ্গীর মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর দেশ স্বাধীন করার উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।

এ ঘটনায় গাজীপুরে মেয়রের শাস্তির দাবিতে মশাল মিছিল বের হয়। রাজনীতির অঙ্গনে জাহাঙ্গীরের বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। গাজীপুরের পরিস্থিতি শান্ত করতে আওয়ামী লীগ উদ্যোগ নেয়। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ অক্টোবর দল থেকে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। তাকে ১৮ অক্টোবরের মধ্যেই এর জবাব দিতে বলা হয়। জাহাঙ্গীর ১৭ অক্টোবরের মধ্যেই তার জবাব দেন। শোকজের জবাব দিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চান জাহাঙ্গীর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমা পেলেন না তিনি।

জাহাঙ্গীর আলমের উত্থান বিস্ময়কর। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে তিনি ছিলেন গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য, সহ-সম্পাদক। এরপর অদ্ভুতভাবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সহ-সভাপতিও হয়েছিলেন। এরপর হলেন গাজীপুর সদর ও টঙ্গী উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বহিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত ছিলেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। গাজীপুরকে 'দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ' বলা হয়। প্রয়াত ময়েজউদ্দীন, রহমত আলী, আহসান উল্লাহ মাস্টার এবং এখনকার মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, আজমত উল্লা খান, আখতারুজ্জামান-সবাই এ জেলার আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক পাহারা দিয়েছেন। প্রবীণ এই নেতাদের সাইড করে এক অদৃশ্য সিন্ডিকেটের হাত ধরে উঠে আসেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি নিজস্ব বলয় গড়েন। ঝুটের ব্যবসা করে বিপুল অর্থের মালিক বনে যান জাহাঙ্গীর। তিনি নিজের নামে একটি ফাউন্ডেশন করে সমান্তরাল একটি শক্তি সৃষ্টি করেন। এরপর ক্রমশ গাজীপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন।

নিজ দল আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর জাহাঙ্গীর আলম কি গাজীপুর সিটির মেয়র থাকতে পারবেন? এ প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন ওঠার একটি কারণ, তিনি দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই দল যখন তাকে বহিষ্কার করলো, তখন তার মেয়র পদে বহাল থাকা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

দলীয় সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার হলে ব্যক্তি মেয়র পদে থাকতে পারবেন কি না, সে ব্যাপারে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। যেমনটা আছে সংসদ সদস্য পদে থাকার বিষয়ে। আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে সাংসদ হওয়ার এবং সংসদ সদস্য পদে থাকার যোগ্যতা-অযোগ্যতা একই। অর্থাৎ একজন ব্যক্তির সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া ও সাংসদ হওয়ার যে যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে, সাংসদ পদ হারানোর ক্ষেত্রে ওই সব যোগ্যতার কোনো একটি বা একাধিকের ব্যত্যয় হলে ব্যক্তি সাংসদ থাকতে পারবেন না বলে বলা হয়েছে। অর্থাৎ দলীয় পদ হারালে ব্যক্তি নির্বাচিত হওয়ার পরও সংসদ সদস্য পদ হারাবেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার আইনে কেবল নির্বাচনে কোনো দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে ব্যক্তির দলীয় মনোনয়নের প্রয়োজন আছে। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর ব্যক্তি যদি দলে না থাকেন, তাহলে কী হবে সেটি বলা নেই।

তবে যারা মেয়র জাহাঙ্গীরকে ভোট দিয়েছেন, তাদের অনেকেই বলতে পারেন তারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। ব্যক্তি জাহাঙ্গীরকে নয়। সেখানে একটা মীমাংসার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। এর সমাধান আইনিভাবে হওয়াটাই ভালো।

২০১৫ সালে সিটি কর্পোরেশন আইন সংশোধন করা হয় এবং দলীয় প্রতীকে মেয়র পদে নির্বাচনের বিষয়টি তাতে সংযুক্ত হয়। আইনের ৩২ ধারায় নতুন ৩২ক ধারা সন্নিবেশিত করা হয়। সেখানে বলা আছে, ‘কোনো সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য কোনো ব্যক্তিকে কোনো রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনীত বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হইবে।’ নতুন আইনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংজ্ঞাও নির্ধারণ করা হয়। বলা হয়, ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী এইরূপ কোনো প্রার্থী, যিনি রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনয়নপ্রাপ্ত নহেন।’

বিপত্তিটা এখানেই। কারণ, সংসদীয় পদ্ধতিতে দলীয় পদ চলে যাওয়ার পর প্রার্থী থাকার উপায় থাকে না। কিন্তু সিটি করপোরেশন আইনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে বিজয়ী ব্যক্তি দল থেকে বহিষ্কৃত হলে তার পরিণতি কী হবে, সে বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলা নেই। আইনের এই অস্পষ্টতা একটি ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৫৭ ধারায় প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার বিষয়ে বলা আছে। সেখানে বলা আছে, যেকোনো সদস্য আওয়ামী লীগের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নিয়মাবলি, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পরিপন্থী কাজে অংশ নিলে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ তার বিরুদ্ধে যে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে।

দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত কোনো সিটি মেয়রের দল থেকে বহিষ্কারের ঘটনা বাংলাদেশে এই প্রথম। স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন আইন)-এর ১২ ধারায় সিটি মেয়র বা কাউন্সিলরদের অপসারণের বিষয়টির কথা বলা আছে। সেখানে নৈতিক নানা স্খলনের কথা বলা আছে, যাতে মেয়রকে অপসারণ করা যায়। আর তা করা হলে তিন দিনের মধ্যে সিটি মেয়র, মেয়র প্যানেলের জ্যেষ্ঠ সদস্যের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবেন। স্থানীয় সরকার আইনের এত ফাঁক ফোকর আছে যে সরকার চাইলে তাকে যে কোনো মুহূর্তে অপসারণ করতে পারে।

৩য় ধাপের মনোনয়ন বোর্ডের শেষদিন সভাশেষে জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে জোরালো সুপারিশ করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং দুই প্রেসিডিয়াম মেম্বার। তাদের সুপারিশ ছিল- জাহাঙ্গীরকে ডেকে সতর্ক করা হোক, তিরস্কার করা হোক। কিন্তু কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হোক। এটাও বলা হয় জাহাঙ্গীর আলমের বিরূদ্ধে সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করছে। নেত্রী সেদিন মুখ বন্ধ করে রেখেছিলেন। গতকাল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে পুরো হাউজ জাহাঙ্গীর আলমের বিরূদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা জাহাঙ্গীর আলমের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান দলের সভানেত্রীর কাছে। হাউজের পালস বুঝে জাহাঙ্গীর আলমের ৩ সুহৃদ গতকাল জাহাঙ্গীরের পক্ষে মুখ খোলার সাহস করেন নি। 
অধিকাংশ জেলায় মাইম্যান তৈরি করতে যেয়ে এবং অনৈতিক সুযোগ সুবিধার মাধ্যমে অসংখ্য জাহাঙ্গীর আলম তৈরি হয়েছে। যাদের কাছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, জননেত্রী শেখ হাসিনার কমিটমেন্ট মূল্যহীন। 

জাহাঙ্গীর আলমের শাস্তি নিঃসন্দেহে একটি কঠিন বার্তা দিল। অনেকেই ধারণা করেছিলেন জাহাঙ্গীরের টাকা আর গডফাদার জাহাঙ্গীরকে শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে দেবে। না, শেষ রক্ষা হলো না। বঙ্গবন্ধুর রক্ত বঙ্গবন্ধুর মতনই আপোষহীন। আদর্শের সাথে বেঈমানী করলে কোনো লিডার, বস্তা বস্তা টাকা- কোন কিছু দিয়েই বাঁচা যাবে না।

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট

বিডি প্রতিদিন/আরাফাত

সর্বশেষ খবর