২১ নভেম্বর, ২০২১ ১৮:০০

পটচিত্রকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তী

নমিতা চক্রবর্তী

পটচিত্রকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তী

রঘুনাথ চক্রবর্তী

২২ নভেম্বর, ২০১৫ শিল্পীকে যখন শেষবারের মত চারুকলা প্রাঙ্গণে আনা হয়েছিল, তখনো কুয়াশার চাদরে ঢাকেনি ঢাকা শহর। শীতের আমেজে জবুথবু হয়নি শহরের মানুষ। অগ্রহায়ণের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে ছিল চারুকলার আঙ্গিনা জুড়ে। তবুও নবান্নের উৎসবকে বরণ করে নিতে প্রস্তুুত বকুলতলা শোকে যেন মুষড়ে পড়েছিল। সবার চোখে জল। পটশিল্পী রঘুদা আর কখনো আসবেন না চারুকলায়। অথচ তিনি চারুকলার ছাত্র বা শিক্ষক নন। ছবি আঁকায় তার নেই কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। মায়ের সাথে আল্পনা আঁকা থেকেই তার তার শিল্পী জীবনের হাতেখড়ি। তার শেষযাত্রায় সঙ্গী হলেন সবাই। শ্রদ্ধা জানালেন তৎকালিন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর। ছাত্র শিক্ষক সবার ভালবাসায় সিক্ত হলেন বাংলার অন্যতম বিশিষ্ট পটশিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তী। 

পটচিত্রকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তী। ১৯৬৯ সালের ১ নভেম্বর গাইবান্ধার শনিমন্দির রোডে জন্ম গ্রহণ করেন রঘুনাথ চক্রবর্তী। বাবা বাসুদেব চক্রবর্তী ও মা অঞ্জলী চক্রবর্তী। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। 
মায়ের সাথে বিভিন্ন পূজার আল্পনা আঁকা থেকেই তার ছবি আঁকা ও প্রতিমা তৈরীর আগ্রহের শুরু। গ্রাম বাংলার সৌন্দর্য, পারিপার্শ্বিক জীবন ও প্রকৃতির খুঁটিনাটি ছিল তার পটচিত্রের বিষয়। মোটা কাপড় বা কাগজের খন্ডে তুলির সাহায্যে রং লাগিয়ে এক অসাধারণ সহজী ভঙ্গীতে তিনি এঁকে গেছেন মানুষ, মাছ, পশু-পাখি, বৃক্ষ, লতাগুল্ম, ফুল-ফল ইত্যাদি নিজস্ব ঢঙে। বাংলার অপরূপ রূপ তার ভেতরের অনবদ্য প্রতিভা ও শিল্পী সত্তার বিকাশ ঘটিয়েছিল। হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যের বাহক এই পটচিত্র। পৌরণিক, সমসাময়িক বা লোকজ বিষয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠতো বিভিন্ন সঙ্গীত, মঙ্গল কাব্য অথবা পটচিত্র। মনসা মঙ্গল, আনন্দ মঙ্গল, কৃষ্ণ লীলা ইত্যাদি গল্প-গাঁথার গল্প ধারাবাহিক চিত্রায়ন এই পটচিত্র। পটচিত্র ছিল এ উপমহাদেশের জন-জীবনের আনন্দ, বিনোদন ও শিক্ষার অন্যন্য এক মাধ্যম।

কলেজ শেষের পরপরই ঢাকায় চলে আসেন পটশিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ও শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট প্রাঙ্গণ হয়ে উঠে তার সবসময়ের বিচরণ ক্ষেত্রে। পটচিত্রই হয়ে উঠে তার জীবন ও জীবিকা। দৃক, ছায়ানটসহ প্রবাসেও শিল্পীর ১০টির বেশি একক চিত্র প্রদশর্নী হয়েছিল। স্বচ্ছলতার মুখ তিনি দেখেননি। তবে বয়ে গেছে দিন। ২০১৫ সালে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। অমূল্য কিছু পটচিত্র রেখে স্বর্গলোকে প্রবেশ করেন নিঃসন্তান এই শিল্পী। চারুকলা, সোনারগাঁয়ের শিল্পাচর্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে  রক্ষিত আছে পটশিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তীর অনবদ্য শিল্পকর্ম। 

রঘুনাথ চক্রবর্তীর অনন্তলোকে যাত্রার ছয় বছর পূর্ণ হলো আজ। তার আঁকা ছবি, রং-তুলি আর যাপিত জীবনের স্মৃতিটুকুকে সম্বল করে শহরের এক কোনায় এখনো বেঁচে আছেন তার স্ত্রী নমিতা চক্রবর্তী। শহরটা তার ছাড়তে ইচ্ছা করে না। সারা শহরে পটশিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তীর পদচিহ্নকে তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন। অগ্রহায়ণে চারুকলায় এখনো উৎসব হয়। আঙ্গিনায় ছেলে মেয়েরা রং তুলি দিয়ে জীবনের প্রতিচ্ছবি আঁকে। ওদের পাশে বসে, ওদের আনন্দিত মুখের মধ্যে তিনি রঘুনাথ চক্রবর্তীর মুখ খুঁজে বেড়ান। উত্তরাধিকার বলতে যে শুধু ওইটুকুই সম্বল তার।
[email protected]

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

সর্বশেষ খবর