৩ জানুয়ারি, ২০২২ ১৮:৫১

রাজনীতির অন্যতম শুদ্ধ পুরুষ সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম

এফ এম শাহীন

রাজনীতির অন্যতম শুদ্ধ পুরুষ সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম

১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি জন্মেছিলেন তিনি। চিরতরে চোখ বুজলেন সেই জানুয়ারির তৃতীয় দিনেই। ৬৭ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন এই কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ। চলন-বলন, মতাদর্শ-কার্যকলাপ, চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণায় আকাশছোঁয়া উচ্চতার ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও বোঝা যেত কেউ একজন গেছেন। অথচ সেটা দাম্ভিকতা নয়, বরং ঈর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব।

'সৈয়দ নজরুলের ছেলে মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ আইছে। বুঝছেন মামা, মন্ত্রী অইলে কিতা অইব, সহজ-সরল মানু! উঁকি মারলেই দেখবাইন লুঙ্গি পইরা বারিন্দাত বইয়া রইছে। সবার লগে গপ করতাছে।’ 

এইরকম কথাটি যেমন তাকে নিয়ে বলা যায়। আবার তিনিই সেই ব্যক্তি যার অসুস্থতার সময় কিশোরগঞ্জের আসনের প্রার্থিতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘যতক্ষণ আশরাফের নিঃশ্বাস আছে সেখানে অন্য কেউ প্রার্থী হতে পারবে না।' 

বাংলাদেশের রাজনীতির সংকটকালীন মুহূর্তে আওয়ামী লীগের হয়ে সংকট নিরসনে কাজ করে গেছেন একনিষ্ঠভাবে। আবার এই তিনিই মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার মতো বিনয়ী এবং উদার ছিলেন। 

বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চ সবসময়ই উত্থান-পতনের নাটকীয়তা আর স্বার্থোদ্ধারের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে টানটান উত্তেজনায় পরিপূর্ণ। এই মঞ্চে যেই এসে দাঁড়ায় রাজনৈতিক স্বার্থোদ্ধারের প্রচেষ্টায় তার প্রকৃত মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যায়। কেউ কেউ পদের গরিমায় ধরাকে সরা জ্ঞান করেন, কেউ নিজ স্বার্থ হাসিলের একাগ্রতায় ভুলে যায় বঙ্গবন্ধুর তিল তিল শ্রমে গড়া রাজনীতির অঙ্গনেই দাঁড়িয়ে আছে সবাই। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সেই জায়গায় ছিলেন ব্যতিক্রম এবং নিজস্ব মহিমায় অনবদ্য। নিজের কাজটি একনিষ্ঠভাবে করতেন। সৎ-নির্লোভ হিসেবে তার ছিল অগাধ সুনাম। আত্মপ্রচার বিমুখ ছিলেন। বিভিন্ন সময় দলীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেও অহমিকা কিংবা স্বেচ্ছাচারিতা তাকে স্পর্শ করেনি। 

সৈয়দ আশরাফ খুব জোর দিয়ে বলতেন, রাজনীতি করতে চাইলে দুর্নীতি ছাড়তে হবে। আর দুর্নীতি করলে রাজনীতি ছাড়তে হবে। অশুভ শক্তির চর, সন্ত্রাসী, মাদকসেবী, অসৎ ও বিতর্কিত ব্যক্তির যাতে দলে অনুপ্রবেশ না ঘটে, সে ব্যাপারে তিনি যেমন সচেষ্ট ছিলেন, তেমনি দলের অন্যদেরও সতর্ক করতেন। ২০১৬ সালের কথা, আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন চলছিল। মঞ্চে তার বক্তৃতা, নেতাকর্মীদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে তোলে, সবাই উচ্ছ্বাস নিয়ে সেই অধিবেশনে সক্রিয় হয়ে ওঠে। অন্য কারো ক্ষেত্রেই এমনটা দেখা যায়নি সেসময়। তিনিই বলতে পারেন ‘আওয়ামী লীগের আমি সন্তান। আওয়ামী লীগের ঘরেই আমার জন্ম। আওয়ামী লীগ যখন ব্যথা পায়, আমারও কিন্তু হৃদয়ে ব্যথা লাগে। আওয়ামী লীগের একটা কর্মী যদি ব্যথা পায় সেই ব্যথা আমিও পাই।’

আসলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম রাজনীতি মনস্ক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি অযাচিত অহেতুক আস্ফালনে বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি কর্ম দিয়ে জয় করে গেছেন বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চ। 

আশ্চর্যরকমভাবে গণমাধ্যমের প্রতি আকর্ষণহীন ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। কখনোই প্রচার প্রচারণার জন্য ব্যতিব্যস্ত ছিলেন না। দলের নেতা-কর্মীদের আস্থাভাজন ও বিশ্বাস-ভরসার স্থল ছিলেন তিনি, এমনকি গণমাধ্যমসহ সব শ্রেণি ও পেশার মানুষেরও। সবার সাথেই হাসিমুখে কথা বলতেন। পত্রিকা বা গণমাধ্যমে তার সমালোচনা থাকলেও তিনি নিজে সে বিষয়ে কারো প্রতি কখনো বিরূপ হননি। এমপি আর মন্ত্রী অনেকেই হতে পারেন; কিন্তু সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একজনই হয়।

দেশে ১/১১ এর সময় থেকে শুরু করে একটি কঠিন সময়ে সৈয়দ আশরাফ আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনে এই মানুষটিকে কঠিন হতে দেখেছি। দেখেছি ধর্মান্ধ অপশক্তির বিরুদ্ধে একজন রাজনীতিবিদের হুংকার। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি। রাজনীতির কঠিন সময়ে স্রোতের প্রতিকূলের যাত্রী ছিলেন সৈয়দ আশরাফ। যখন দেখি রাজনীতির মাঠে ময়দানে চারপাশে লোভ, মোহে ,ভোগ-উপভোগ-সম্ভোগে উন্মাদ হয়ে উঠছে তখন আপোষ, লোভ, অসততা-অনৈতিকতা থেকে বহুদূরে অবস্থান নিয়েছেন তিনি।   

সৈয়দ আশরাফ ছাত্র জীবনে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-প্রচার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এছাড়াও, সৈয়দ নজরুল ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্যতম সংগঠক। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের পর যুক্তরাজ্য চলে যান সৈয়দ আশরাফ। যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। 

বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের যে চিত্র সাধারণত তৈরি হয়েছে তাতে দেখা যায় আদর্শিক নেতাদের নিয়ে ভালো বা শ্রদ্ধা জাগানিয়া বোধ দিনে দিনে অনেক কমে যাচ্ছে। সেখানে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মৃত থেকেও জীবিত হয়ে উঠছেন। আর অনেকে জীবিত থেকেও মৃত মানুষের মত জীবন যাপন করছেন। 

২০১৭ সালে যখন তার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন, সামনে এলো উন্নত চিকিৎসার বিষয়টি, তখন দেশবাসী জানলেন আসলে তার সে পরিমাণ টাকা নেই, সম্পদ নেই। যারা নতুন জানলেন তারা ভীষণ অবাক হলেন, এও সম্ভব! সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হয়েও তিনি টাকার অভাবে প্রিয়তমা স্ত্রীর যথাযথ চিকিৎসা করাতে পারছেন না দুই বারের মন্ত্রী আর চার বারের এমপি!

সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের শারীরিক প্রস্থান হলেও তার আদর্শ বেঁচে থাকবে দীর্ঘদিন। বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শই ছিল সৈয়দ আশরাফের আদর্শ। অনেকে বলে বাঙালির শোকের মেয়াদ বড়জোর ১ বছর কিন্তু তার মত আদর্শিক নেতার হারিয়ে যাওয়ার শোক আরো বহুকাল আমাদের কাতর করে রাখবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে লড়ে যাওয়া প্রত্যেকে আপনাকে স্মরণ করবে, ভালোবেসে মনে রাখবে। 

রাজনীতির অন্যতম শুদ্ধ পুরুষ সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সামগ্রিক জীবনকে নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে দল, রাষ্ট্র ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগ নেয়া উচিৎ।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, গৌরব ‘৭১
সম্পাদক, ডেইলি জাগরণ ডট কম

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর