১৮ জুন, ২০২২ ২০:৩৩

মেডিটেশন সেবায় স্থায়ীভাবে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হোক

আব্দুল্লাহ আল মামুন

মেডিটেশন সেবায় স্থায়ীভাবে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হোক

মেডিটেশনের প্রতীকী ছবি

ধ্যান বা মেডিটেশন হলো মনের ব্যায়াম। মেডিটেশনের আদি ইতিহাস এবং বর্তমান অবস্থা দেখলে সাদা চোখে একটি গুণগত পার্থ্যক্য লক্ষ্যণীয়, শুরুর দিকে এশীয় অঞ্চলে যেখানে ধ্যানে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য পাওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে; সেখানে বর্তমান পশ্চিমা বিশ্বে ধ্যানের মাধ্যমে শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্যগত উপকারিতা এবং বৈষয়িক সাফল্য পাওয়ার বিষয়টিই মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মেডিটেশনের মূল চারণক্ষেত্র প্রায় ৫,০০০ বছর আগে থেকেই। যে দেশ মেডিটেশনের অন্যতম উৎসভূমি সেই দেশেই আজ ধ্যানের ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু কেন? এ পর্যায়ে মেডিটেশনের ওপর সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো জনমানুষের জানা প্রয়োজন-মেডিটেশন আসলে কতটুকু উপকার করতে পারে? 

উপমহাদেশে ধ্যান মূলত গুরুমুখী বিদ্যা। পাশ্চাত্যে যারা এখন ধ্যান শেখাচ্ছেন; তাদের প্রত্যেকের জীবনের শুরুর দিকে তাকান, কোনো না কোনোভাবে তারা এই প্রাচ্য থেকেই ধ্যান শিখেছেন। ড. ডিন অরনিশ, অ্যানোডা জুডিথ; যারা এখন ধ্যানের ব্যবহার নিয়ে সোচ্চার এবং সমানতালে শিখিয়ে যাচ্ছেন- তারা শিখেছেন কোথায়? এই প্রাচ্যে। মূল মেডিটেশন ঠিক রেখে তারা শুধু বিজ্ঞানের কিছু টার্মিনোলজি প্রয়োগ করেছেন এবং তাদের ক্ষেত্রে ‘গুরু’ শব্দ বাদ হয়ে তা হয়েছে ‘সাইকোএনালিস্ট’ বা মনোবিশ্লেষক।

সফল উদ্যোক্তা জেফ ওয়েইনার (লিংকডইন এর সিইও) থেকে শুরু করে সেলিব্রিটি অপরাহ উইনফ্রেসহ মুখচেনা কর্মযোগী মানুষদের সিংহভাগই এখন কোনো না কোনো ধরনের ধ্যানের অনুশীলনের সাথে জড়িত। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন মেডিটেশন মূল চিকিৎসার অংশ হিসেবে স্বীকৃত এবং তা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়টা অন্তত শেষ। 

২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন একটি গবেষণাপত্র নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। এর শিরোনামে বলা হয়, ধ্যান বা মেডিটেশন আপনার স্বাস্থ্যখরচ প্রতিবছর ২৫ হাজার ডলার কমিয়ে দেবে। বেনসন-হেনরি ইন্সটিটিউটের রিলাক্সেশন রেসপন্স রেজিলিয়েন্সি প্রোগ্রামের আওতায় এই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন ডার্টমাউথ হিচকক মেডিক্যাল সেন্টারের ইন্টারনাল মেডিসিনের চিফ ড. জেমস স্টাহ্ল। তার দল চার বছর ধরে ৪ হাজার ৪০০ মানুষের তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন মেডিক্যাল থেকে এবং তাদের ৮ সপ্তাহের একটি রিলাক্সেশন মেডিটেশন, ইয়োগা অনুশীলনের আওতায় আনা হয়। এর ফলে তাদের প্রত্যেকের মেডিক্যাল খরচ আগের বছরের তুলনায় ৪৩% কমে যায়। 

ড. জেমস স্টাহ্ল দ্বিতীয় আরেকটি গবেষণা করেন, এই গ্রুপের ভেতর যাদের সরাসরি কোনো না কোনো রোগের জন্যে সারাবছর ক্লিনিক্যাল সেবা প্রয়োজন ছিল। তাদের এই ক্ষেত্রে খরচ কমে ২৫%। তিনি ডলারে এই বিষয়টি আরও ভেঙে বলেছেন। উন্নত বিশ্বে যেখানে মেডিটেশনের একটি কোর্সে ন্যূনতম খরচ হয় ৫০০ ডলার (বাংলাদেশি ৪৫,০০০ টাকা), সেখানে একবার মেডিক্যাল ইমারজেন্সির ন্যূনতম খরচ ৪,০০০ ডলার (বাংলাদেশি ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা)। ছোটখাটো রোগ থেকে দীর্ঘমেয়াদি ক্রনিক রোগের হিসাব থেকে দেখা যায়, একেকজন রোগী বছরে ৬৪০ ডলার থেকে ২৫,৫০০ ডলার পর্যন্ত প্রতি বছর মেডিক্যাল খরচ কমাতে পারে শুধু মেডিটেশন প্র্যাকটিসের মাধ্যমে। 

ড. ডিন অরনিশ কীভাবে বিল ক্লিনটনের বাইপাস সার্জারিকে বাইপাস করিয়েছেন তা গুগল করলেই বিস্তারিত পাওয়া যায়। তার খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং ইয়োগা মেডিটেশনের মাধ্যমে জীবনযাপন চিত্রই পাল্টে দিয়েছিলেন ড. অরনিশ। হালে বারাক ওবামা এখন যাওয়া আসা শুরু করেছেন ডিনের কাছে। 

ড. জন হ্যাজলিনের বিভিন্ন গবেষণা উল্লেখ আছে; যিনি একাধারে একজন কোয়ান্টাম ফিজিসিস্ট, মেডিটেশন প্র্যাকটিশনার এবং মেডিটেশন গবেষক। তিনি দলবদ্ধ ধ্যান কীভাবে সমাজের চিত্র বদলে দিতে পারে তার একটি পরিসংখ্যানগত গবেষণা করে দেখিয়েছেন, ১৯৯৩ সালে আমেরিকার ওয়াশিংটনে সামগ্রিক অপরাধপ্রবণতা ২৬% কমে যায়, একই সময়ে লেবানন যুদ্ধে অস্ত্রের ব্যবহার কমে যায়। হ্যাজলিন বলেন, গ্রুপ মেডিটেশনের মাধ্যমে সমাজে সুস্থ চিন্তার বিকাশের ফলেই সমষ্টিগত চেতনার এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে।
 
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত মেডিটেশন ইয়োগা মূল চিকিৎসার অংশ করে নিয়ে কর অব্যাহতি দিয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে একটি সংস্কার আনার প্রয়াসে দিল্লি সরকার রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়গুলোতে একটি ‘সুখী পাঠ্যক্রম’ চালু করেছে। পাঠ্যক্রমটিতে প্রতিটি শ্রেণির আগে ৪৫ মিনিট এবং পাঁচ মিনিটের ধ্যানের একটি সুখের সময় জড়িত। ৪০ জন বিশেষজ্ঞের একটি দল পাঠ্যক্রম তৈরি করেছে, যার মধ্যে ধ্যান, নৈতিক মূল্যবোধ এবং মানসিক অনুশীলন রয়েছে। অপরাধীদের ধ্যান প্রশিক্ষণেও জোর দিয়েছে আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড। সম্প্রতি বৃটেনও পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেছে অপরাধীদের ধ্যান প্রশিক্ষণ। ধ্যান নিয়ে বিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রায় ভ্যাটের অজুহাতে বাংলাদেশও পিছিয়ে থাকতে রাজি নয় আর।

অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সক্ষমতা এই সময়ে প্রশ্নাতীত। প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তে আজ আমরা পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে করতে পেরেছি। অর্থনৈতিকভাবে সফল একটি দেশকে তার অর্থের সুফল পেতে হলে নৈতিকভাবে একটি সুস্থির জায়গায় যাওয়া প্রয়োজন। তাই প্রিয় অর্থমন্ত্রীর কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ, মেডিটেশনের ওপর স্থায়ীভাবে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হোক। সুস্থ চিন্তার বিকাশের মাধ্যমে আমরা যেন এক মানবিক মহাসমাজ গড়ে তুলতে পারি। 

লেখক : প্রযোজক, ডিবিসি নিউজ

বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ

 


 

সর্বশেষ খবর