২৬ জানুয়ারি, ২০২৩ ১০:০২

ভারতীয় অর্থনীতির অমৃতকাল

ড. বিবেক দেবরয়

ভারতীয় অর্থনীতির অমৃতকাল

ড. বিবেক দেবরয়

সম্প্রতি ভারত স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন করেছে। অমৃতকালের ধারণাটি পরবর্তী ২৫ বছর, অর্থাৎ ২০৪৭ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত, যখন ভারত স্বাধীনতার ১০০ বছর উদযাপন করবে। ২০২৩ সালের ভারত ১৯৪৭ সালের ভারত থেকে আলাদা এবং ২০৪৭ সালের ভারত ২০২৩ সালের ভারত থেকে এমনভাবেই আলাদা হবে যা আজ খুব কম লোকই আশা বা ধারণা করতে পারে। অতীতের দিকে ফিরে তাকালে, কেউ কি গত ২৫ বছরে ভারতে কত পরিবর্তন হয়েছে তা অনুমান করতে পারে? পৃথিবী অনিশ্চিত এবং দীর্ঘমেয়াদে তা আরও বেশি। যদিও ভবিষ্যৎ সব সময় অনিশ্চিত, বিশ্বের বর্তমান অবস্থায় অনিশ্চয়তার বাড়তি মাত্রা হিসেবে পরিবেষ্টিত হয়েছে-কভিড, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার পতন ও আঞ্চলিকতা, বিশ্বায়ন থেকে উন্নত দেশগুলোর পশ্চাদপসরণ এবং কয়েকটি দেশে ‘মন্দা’-র ভয়ঙ্কর অভিব্যক্তি। এগুলো হলো বাহ্যিক অভিঘাত যা ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে, যেমনটা করেছে অনেক উদীয়মান বাজার অর্থনীতির ওপর, বিশ্বব্যাপী পাবলিক পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের পতনকে নির্দেশ করেছে, যার মাঝে ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানসমূহও অন্তর্ভুক্ত। 

কথা প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা এখনো ভারতের মতো অর্থনীতির উত্থানকে মেনে নিতে পারেনি। বর্তমান ও দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যতের অনেক কিছুই অনিশ্চিত। কিন্তু অনেক কিছুই রয়েছে যেগুলো সুনিশ্চিত। নিশ্চয়তার সেই বেষ্টনীর মধ্যে, ভারতের অদম্য অর্থনৈতিক উত্থানকে বিতর্কিত করা অসম্ভব। এক পর্যায়ে, বিআরআইসিএস ও ২০৫০-এর পথের স্বপ্ন দেখার বিষয়ে ২০০৩ সালে রচিত গোল্ডম্যান শ্যাক্সের প্রতিবেদনের ওপর অনেক কিছু করা হয়।  ১. সেই রিপোর্টে, ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির গড় প্রকৃত হার ছিল প্রায় ৫.৫%, ২০৫০ সালের মধ্যে মোট জিডিপি ও মাথাপিছু জিডিপিতে বিস্ফোরণের প্রকৃতি সূচকীয় ফাংশনের প্রকৃতি ব্যবহার করে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ২. সেই রিপোর্টে ২০৪৭ সালের জন্য কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও ২০৪৫ সালের জন্য একটি ছিল। ২০৪৫ সালে, ভারতের মোট জিডিপি ১৮.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ও মাথাপিছু জিডিপি ১২,০০০ মার্কিন ডলারের বেশি হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল। ৩. এ সব আশাবাদী অনুমানসমূহের পেছনের এই কারণসমূহ বর্তমান অনিশ্চয়তার মাঝেও অকার্যকর হয়ে যায়নি─জনতাত্তি¡ক উত্তরণ ও আয় বৃদ্ধির ফলে সঞ্চয়/বিনিয়োগের হার বৃদ্ধি, আরও দক্ষতার সঙ্গে কৃষিজমি, শ্রম ও পুঁজিবাজার পরিচালনা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। 

অর্থনীতিবিদদের অভিব্যক্তিতে, ভারত এখনো উৎপাদন সম্ভাবনা সীমানার মধ্যে রয়েছে, এর ওপরে নয়। এটিকে ভিন্নভাবে বলতে গেলে, ভারতের জন্য সামগ্রিক বৃদ্ধি বলতে বোঝায় রাজ্যগুলোর বৃদ্ধির সমষ্টি এবং রাজ্যগুলো তাদের নিজ নিজ সীমানার মধ্যে রয়েছে, যা বৃদ্ধির জন্য প্রচুর পরিমাণে অভ্যন্তরীণ শিথিলতা প্রদান করে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি আরও শান্ত হলে ভারত হয়তো ৯% হারে বৃদ্ধি পেত। সাধারণত, সবাই চেষ্টা করে বর্তমানের অন্ধকারকে ভবিষ্যতের দিকে তুলে ধরার। এটা কোনোভাবেই সুস্পষ্ট নয় যে, আগামী ২৫ বছর ধরে বাহ্যিক জগৎ কঠিন হতে থাকবে। কিন্তু তেমনটা হলেও, ভারত হয়তো ৯% হারে বৃদ্ধি পাবে না। প্রকৃত বৃদ্ধির হার কত হলে তা যুক্তিসংগত বলে মনে হয়?

এটার উত্তরনির্ভর করে অভিক্ষেপ ও অনুমান করা ব্যক্তির ওপর। মূল্যস্ফীতিবিষয়ক অনুমান একটি সংখ্যা মাত্র, যে কারণে প্রায়শই এই অনুমানসমূহ হালনাগাদ ডলারের মান অনুযায়ী করা হয়। একটি ডলারের পরিসংখ্যান ডলার/রুপির বিনিময় হার সম্পর্কে করা অনুমানের ওপরও নির্ভর করে, এই কারণেই অনুমান প্রায়ই বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী করা হয়। (গোল্ডম্যান শ্যাক্স ডলারের তুলনায় রুপির মূল্যবৃদ্ধি ধরে নিয়েছেন।) একটি পিপিপি (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি-ক্রয় ক্ষমতার সমতা) অনুশীলন স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন। মুদ্রাস্ফীতি এবং বিনিময় হারের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তব প্রবৃদ্ধির কোন্ গতিপথ যুক্তিসংগত বলে মনে হচ্ছে? 

হতাশাবাদী পূর্বাভাস প্রদানকারী বহির্বিশ্বের অবস্থা ও দেশীয় অদক্ষতাকে দায়ী করবে এবং ৫.৫% বেছে নেবে। আশাবাদী পূর্বাভাস প্রদানকারী জীবনযাত্রার সহজীকরণ ও মৌলিক চাহিদাসমূহের সংস্থান, ব্যবসা করার সহজসাধ্যতা, সরবরাহ-সংস্কার ও কেন্দ্রীয় সরকারের মূলধন ব্যয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায়নের মতো বিষয়গুলোকে নির্দেশ করে ৭.৫% বেছে নেবে। এটি একটি মোটামুটি পরিসর যা এই স্বীকৃতি দেয় যে বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধির হার ধীর হয়। উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময়, দ্রæত বৃদ্ধি পাওয়াটা আরও কঠিন হয়ে উঠছে, কারণ বিভিন্ন রাজ্য উন্নয়নের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে এবং প্রচুর শিথিলতা রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে, কেউ প্রকৃত বৃদ্ধি সম্পর্কে নিজের অনুমানকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে, ৫.৫% ও ৭.৫% এই দুটি চরমসীমার মাঝামাঝি ৬.৫%-এর মতো কিছু বলতে পারেন। ২০৪৭ সালে, ভারতের মাথাপিছু আয় ১০,০০০ মার্কিন ডলারের মতো হবে। অর্থনীতির মোট আকার ২০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি হবে। মোটামুটিভাবে এই সংখ্যাগুলো গোল্ডম্যান শ্যাক্সের উল্লেখ করা পরিসরের মাঝেই রয়েছে। গোল্ডম্যান শ্যাক্সের রিপোর্টে, বিনিময় হারের মূল্যায়নের ভ‚মিকা তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। এ ধরনের অনুমানের ক্ষেত্রে, প্রকৃত বৃদ্ধির ভ‚মিকা তুলনামূলকভাবে বেশি।

যদি সংস্কারসমূহ ভারতীয় প্রবৃদ্ধির গতিপথকে ৬.৫%-এর ওপরে নিয়ে যায় এবং সেই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তাহলে সংশ্লিষ্ট সংখ্যা আরও বেশি হবে। এমনকি তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল এসব সংখ্যার ক্ষেত্রেও, এটার অর্থ দাঁড়ায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পরে ভারত হবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং এটি স্বাভাবিকভাবেই ভারতের বৈশ্বিক প্রভাবে প্রতিফলিত হবে। পিপিপি র‌্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে, চীনের পরে ভারত হবে দ্বিতীয় বৃহত্তম। জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হার কমেছে ও এখন তা ১%-এরও কম। তা সত্তে¡ও, ২০৪৭ সালে, ভারত হবে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ, যার জনসংখ্যা হবে ১.৬ বিলিয়নের কাছাকাছি। ‘উন্নত দেশ’-এর মতো অভিব্যক্তি আজকাল খুব কমই ব্যবহৃত হয়। শব্দটির কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞাও আর নেই। বিশ্বব্যাংক ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে থাকে। আজ, ভারত নিম্ন মধ্যম আয়ের অর্থনীতি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ। ২০৪৭ সালে, ভারত উচ্চ মধ্যম আয়ের কাতারে চলে যাবে। মাথাপিছু আয় ১৩,০০০ মার্কিন ডলারে পৌঁছলে, কোনো দেশের মর্যাদা ‘উচ্চ-আয়’-এর হয়ে যায়। শুধু তখনই ভারতকে ‘উন্নত’ বলা যেতে পারে। ২০৪৭ সালে ভারত সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলেও দারিদ্র্যের প্রকৃতি সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হবে।

দারিদ্র্যের পরিমাপ দারিদ্র্যসীমার ধারণার ওপর ভিত্তি করে ও একটি বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক ব্যবহার করে করা হয়ে থাকে, ইউএনডিপি স¤প্রতি ভারতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যায় তীব্র হ্রাস নথিভুক্ত করেছে। অর্থনীতি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে, দারিদ্র্যসীমার ধারণাও বৃদ্ধি পেয়েছে যা খরচের একটি নির্বাহের স্তরের বাইরে রয়েছে। যা হোক, সরকারিভাবে ব্যবহৃত দারিদ্র্যরেখা এখনো টেন্ডুলকার দারিদ্র্যরেখা। দুর্ভাগ্যবশত, দারিদ্র্য পরিমাপ করতে ব্যবহৃত খরচের তথ্য-উপাত্ত ২০১১-১২ এর পরে বিদ্যমান নেই। তাই আজ দারিদ্র্য পরিমাপের জন্য বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন অনুমান ব্যবহার করছেন। পিএলএফএস (পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে) ডেটা ও টেন্ডুলকার দারিদ্র্যরেখা ব্যবহার করলে, দারিদ্র্যের অনুপাত (দারিদ্র্যসীমার নিচে জনসংখ্যার শতকরা পরিমাণ) এখন প্রায় ১৭%। ২০৪৭ সালের মধ্যে, এই অনুপাত প্রায় হ্রাস পেয়ে প্রায় ৫% হবে। অন্যান্য রিপোর্টের মাঝে, এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) রিপোর্ট সরকার কর্তৃক উচ্চাকাক্সক্ষী জেলা কর্মসূচির মাধ্যমে নির্ধারিত কিছু নির্বাচিত ভৌগোলিক অঞ্চলে বঞ্চনার গহŸর (পকেট) নথিভুক্ত করেছে। নানা উপাদানে গঠিত ভারতে মৌলিক প্রয়োজনীয়তা (ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, বাজারে প্রবেশাধিকার, প্রযুক্তি, ডিজিটাল অ্যাক্সেস) ও ক্ষমতায়নের সামগ্রিক বার্তা থাকা সত্তে¡ও, ২০৪৭ সালেও দারিদ্র্যের গহ্বর (পকেট) বিদ্যমান থাকবে। কিন্তু সেই দারিদ্র্যের প্রকৃতি হবে খুবই ভিন্নধর্মী। ভারত সর্বজনীন সাক্ষরতা অর্জন করবে অথবা এর খুব কাছাকাছি পৌঁছবে। ইউএনডিপি দারিদ্র্যের অনুপাত অতিক্রম করে মানব উন্নয়ন পরিমাপ করতে এইচডিআই (মানব উন্নয়ন সূচক), একটি সামগ্রিক পরিমাপ পদ্ধতি ব্যবহার করে। এইচডিআই অনুযায়ী, ভারত আজ মানব উন্নয়নের মাঝারি পর্যায়ে রয়েছে। ২০৪৭ সালে, ভারত মানব উন্নয়নের উচ্চ পর্যায়ে চলে যাবে।

পাঁচটি রূপান্তর চলমান রয়েছে যেগুলো ২০৪৭ সালে আরও বেশি করে লক্ষণীয় হবে। প্রথমত, গ্রামীণ ব্যবস্থা থেকে শহুরে ববস্থায় পরিবর্তন চলমান রয়েছে এবং নগরায়ণ উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। ২০৪৭ সালের মধ্যে, ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ৬০%-এর নগরায়ণ ঘটবে। দিল্লি ও কলকাতার জনসংখ্যা প্রায় ৩৫ মিলিয়ন, মুম্বাইতে সেটা ৪০ মিলিয়নেরও বেশি। নগরায়ণ যাতে আরও ভালোভাবে পরিচালিত হয় তা নিশ্চিত করাই সরকারের কর্মসূচির উদ্দেশ্য। দ্বিতীয়ত, অর্থনীতির ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হবে। আবারও, প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ব্যাপারটিও বৃদ্ধি ও উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ব্যক্তিপর্যায়ে আনুষ্ঠানিক কর্মচুক্তি সম্পাদিত হবে। এমএসএমই আইনত নিবন্ধিত পর্যায়ে পৌঁছবে। ভারতীয় কোম্পানিগুলো গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনে যুক্ত হয়ে আরও বড় ও দক্ষ হয়ে উঠবে। তৃতীয়ত, কৃষি থেকে জীবিকা নির্বাহকারী জনসংখ্যার শতকরা পরিমাণ হ্রাস পাবে। জিডিপিতে কৃষির অংশ হ্রাস পেয়ে ৫%-এর মতো হবে এবং কৃষিখাত থেকে জীবিকা অর্জনকারী জনসংখ্যা ২০%-এর বেশি হবে না। চতুর্থত, কৃষিখাত বাণিজ্যিকীকরণ ও বৈচিত্র্য এবং বৃহত্তর খামারের দিকে ধাবিত হবে। পঞ্চমত, ‘সাবকা প্রয়াস’ মূলসুর সঙ্গে নিয়ে প্রশাসনে নাগরিকগণের বৃহত্তর অংশগ্রহণ থাকবে। বছরের পর বছর ধরে, কাঁধে একটি ঔপনিবেশিক জোয়াল ছিল। কিন্তু বর্তমান ভারত হলো গর্বিত ভারত, স্থিতিস্থাপক ভারত, উচ্চাশী ভারত। তা নিয়েই এই অমৃতকাল এবং দেশটি আরও বেশি আত্মবিশ্বাস ও উদ্যোক্তার সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্দান্ত অগ্রগতি করছে।

লেখক : ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান।


বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর