শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ সন্তান আরাফাত রহমান কোকো একজন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে সরাসরি রাজনীতির মাঠকে কর্মক্ষেত্র না করে ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হিসেবে তিনি প্রায় প্রকাশ্যে না এসে অনেকটা নিভৃতে নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন।
দুই.
আরাফাত রহমান কোকোর জন্ম আগস্ট ১২, ১৯৬৯, কুমিল্লায় বাবা জিয়াউর রহমানের কর্মক্ষেত্রে। যখন এই শিশুটির বয়স এক বছর সাত মাস তখন বাবা জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। আবার দোসরা জুলাই ১৯৭১-এ এই শিশুটির বয়স যখন মাত্র এক বছর দশ মাস বিশ দিন তখন মা বেগম খালেদা জিয়া এবং বড় ভাই তারেক রহমান পিনোর সঙ্গে পাক-হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে যখন মুক্তি পান তখন এই শিশুটির বয়স মাত্র দুই বছর চার মাস চার দিন!
১৯৭৫ সালের নভেম্বর বিপ্লবের সময় বাবা জিয়াউর রহমান বন্দি হন আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তখনো শিশুটি মাত্র ছয় বছরের! বাবা জিয়াউর রহমান ১৯৮১-তে যখন শহীদ হন তখন আরাফাত রহমান কোকো মাত্র এগারো বছরের কিশোর! জীবনের প্রথম ১০টি বছরেই শিশুটি কিছু বুঝে উঠবার আগেই স্বাধীনতার যুদ্ধে বন্দি হয়েছিলেন আবার পিতৃহারাও হয়েছেন! এরকম বিস্ময়কর শৈশব কৈশোর পেরিয়ে কোকো পরিণত হয়েছিলেন। অবুঝ শৈশবেই ১৯৭১-এ পাক-হানাদার বন্দিশালায় আটক হওয়ার পর দ্বিতীয় বার ২০০৭ সালে অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বন্দি হন। ২০০৮ সালের ১৭ জুলাই মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়াতে মাত্র ৪৫ বছর বয়সেই তার জীবনাবসান হয়।
তিন.
আরাফাত রহমান কোকো ব্যক্তিগত জীবনে খুবই সাধারণ ও অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন। একজন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ঐতিহাসিক অবদান রাখলেও প্রচারের আলো থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতেন। কোকো ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে থাকাকালীন সময়ে ক্রিকেট রাজনীতিমুক্তকরণ যেমন করেছেন, তেমনি বিরোধীদলীয় নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করে বাংলাদেশে অনন্য নজির স্থাপন করেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের অধিকাংশই ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলেন না কিন্তু ডিওএইচএস ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে ক্রিকেট খেলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হিসেবে দ্বিতীয় বিভাগে খেলাটা পারিবারিক শক্তি না দেখানোর মত বিনয়! এ ধরনের বিনয় তার পুরো ক্রীড়া সংগঠক জীবনে লক্ষ্য করা যায়। যেমন: ক্রিকেট বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী সরকার যাকে ইচ্ছা তাকেই বোর্ড সভাপতি করতে পারতো। কাজেই ক্ষমতার চূড়ান্ত ব্যবহার করলে বোর্ড সভাপতি হতে পারতেন, তা না হয়ে বোর্ডের অধীনে ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আমুলে বদলে ফেলেছেন বয়সভিত্তিক ক্রিকেটকে। এমন কথা কেউ বলতে পারবে না তার বলয়ের বাইরে বাড়তি কোনো হস্তক্ষেপ কখনো করেছেন।
ডেভলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে High-performance ইউনিটের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ ক্রিকেটার তৈরি পাইপলাইনের সূচনা তার হাত দিয়ে। একথা সর্বজন বিদিত যে সাকিব, তামিম, মুশফিক, শুভ, এনামুল জুনিয়র প্রমুখ ক্রিকেটার হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের মাধ্যমেই প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায়। মোদ্দাকথা, খেলোয়াড় তৈরির ধারাবাহিক পাইপ লাইন তৈরি হয়েছিল ডেভেলপমেন্ট কমিটির মাধ্যমে। তার মূল কারিগর ছিলেন কোকো।
ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে ক্রিকেট খেলা হতো না। ক্রিকেট খেলোয়াড়রা এসময় বসে থাকতেন। কোকো এই সমস্যা দূর করতে ২০০৪ সালে মিরপুর শেরে-বাংলা স্টেডিয়ামকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছ থেকে ক্রিকেটের জন্য নিয়ে নেন। এটিকে পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে রূপান্তর করতে ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ সিস্টেম তৈরির মাধ্যমে মিরপুর স্টেডিয়ামকে আধুনিকায়ন করেন কোকো। মিরপুর স্টেডিয়ামকে হোম অব ক্রিকেট দেখিয়েই ২০১১ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বাগতিক দেশের মর্যাদা লাভ করে বাংলাদেশ।
দেশের ক্রিকেটকে বিকেন্দ্রীকরণে ভূমিকা রাখেন কোকো। দেশের ক্রিকেটকে মিরপুর ও চট্টগ্রামে কেন্দ্রীভূত না করে সিলেট, খুলনা, বগুড়া ও রাজশাহীতে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা করেন তিনি। দলীয় ক্ষমতা হাতে থাকার পরও বগুড়ার একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নামে না করে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ চান্দুর নামে নামকরণ করে অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন তিনি।
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে অস্ট্রেলিয়ান কোচ, ট্রেনার, ফিজিও আনার ট্রেন্ড চালু করেন কোকো। বোর্ডের প্রফেশনাল কাজেও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাপোর্ট পাওয়া যেতো। ক্রিকেট বোর্ডকে করেছিলেন রাজনীতিমুক্ত। কাজটি করতে গিয়ে জনপ্রিয়তা বা বাহবা কুড়াতে যাননি কোকো। প্রেসকে ডেকে কাভারেজের আয়োজন করেননি। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সব মতের সংগঠকেরাই ছিলেন তৎকালীন ক্রিকেট বোর্ডে।
২০০৪ সালে প্রথম অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের আয়োজনের দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ কোকোর ক্যারিশম্যাতেই। সে সময় বর্তমান ক্ষমতাসীন দল এত বড় আয়োজনের উৎসবে পানি ঢেলে দেওয়ার জন্য সারাদেশে হরতাল ডেকেছিল। সেই প্রতিকূল অবস্থাতেও একদিনে পনেরটি প্র্যাকটিস ম্যাচ আয়োজন করে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয় বাংলাদেশ। সফল এই আয়োজনের নেপথ্য কারিগর ছিলেন কোকো।
চার.
এরকম একজন নির্লোভ, নির্মোহ, অরাজনৈতিক ক্রীড়া সংগঠককে আওয়ামী মিডিয়া দুর্নীতিবাজ, মাদকসেবী- কত কী বানিয়েছে! এই কোকোর নামে গাড়ি পোড়ানোর মিথ্যা মামলা দিয়ে আবার তার মৃত্যুর পর বেগম জিয়াকে সমবেদনা জানানোর নাটক দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। শেখ হাসিনাকে জানানো হয়েছিল যে বেগম জিয়াকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে, উনি উঠলে আপনাকে জানানো হবে। তারপরও তিনি তড়িঘড়ি করে বেগম জিয়ার বাসায় এসে গেট থেকে ফিরে যাওয়ার জঘন্য নাটক করেছিল। আওয়ামী মিডিয়াও এই ন্যাক্কারজনক প্রচারণায় অংশ নিল। তাতে কি খুব ক্ষতি হয়েছে?
২৪ জানুয়ারি ২০১৫ তে মালয়েশিয়াতে কোকোর মৃত্যু হয়। অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলাগুলো মাথায় নিয়ে বিদেশের মাটিতেই তার মৃত্যু হয়েছে। মাত্র এক বছর দশ মাস বয়সে পাক হানাদার বাহিনীর কাছে বন্দি হওয়া এই শিশুটি পরিণত বয়সে দেশে মৃত্যুর গৌরব অর্জন করতে পারেনি কায়েমী স্বার্থবাদী মহল এর কারণে।
মহৎ মানুষদের মৃত্যুও মহিমান্বিত! শহীদ জিয়ার মৃত্যুতে গোটা দেশ ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল! শহীদ জিয়ার জানাজায় শোকার্ত মানুষের অভূতপূর্ব উপস্থিতি ঐতিহাসিক নজির স্থাপন করেছিল। এমন জানাজা অতীতে হয়নি ভবিষ্যতেও হবে কীনা সন্দেহ! তবে ২৭ জানুয়ারি সরকারবিরোধী কর্মসূচির সময় দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রায়-কারফিউ অবস্থার মধ্যেও যে জানাজা হয়েছিল সেটি অবিশ্বাস্য! একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে জনগণের উপস্থিতি সম্পর্কে বলা হয়েছিল - “কোকোর জানাজায় অংশ নিতে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট থেকে মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম, মহানগর নাট্যমঞ্চ, গোলাপ শাহর মাজার থেকে জিপিও মোড় পর্যন্ত সড়কে অবস্থান নেয় মানুষ।
অন্যদিকে, বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড় ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এলাকায় লাখো মানুষ সমবেত হয়। ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর থেকে অসংখ্য মানুষ জানাজায় অংশ নেন।
কোকোর জানাজায় অংশ নেওয়া মানুষের সংখ্যা কত ছিল বিভিন্ন দৈনিক বিভিন্ন তথ্য দেয়, কেউ বলে দশ লাখ, কেউ বলে পনের লাখ, আবার কেউবা বলে বিশ লাখেরও বেশি! অতি বিস্ময়কর! অবিশ্বাস্য! আমরা উত্তরা থেকে জানাজায় অংশ নিয়েছিলাম। রাস্তায় এয়ারপোর্ট ও রামপুরা ব্রিজে আমাদের সিএনজি চেক করা হয়েছিল। আমাদের পরিচিত অনেকেরই এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। তারপরও প্রায় কারফিউ অবস্থার মধ্যে কোকোর জানাজায় জনগণের বিপুল উপস্থিতি এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে তিনি মহৎদের কাতারে, তার মৃত্যুও মহিমান্বিত। এমন মহিমান্বিত মৃত্যু অনেক বড় নেতারও ভাগ্যে জোটেনি!
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত