সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের একটি বড় অংশ কাজ করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে। এদের দেখা যায় বিভিন্ন শপিং মল, বাজার, অফিস-আদালত, স্কুল, হাসপাতাল ও রাস্তাঘাটে। প্রখর রোদে ঘামে ভিজে যাওয়া গায়েও বন্ধ থাকে না কাজ, এমনকি গভীর রাতেও দেখা যায় এদের কাজ করতে। সমগ্র আমিরাতে এদের বিচরণ। এরাই উত্তপ্ত মরুর বুকে ছিড়িয়ে ছড়িয়ে থাকা ময়লা আবর্জনা যেমন পরিষ্কার করে তেমনি ঝকঝকে তকতকে রাখে পুরো আমিরাত। আবার এরাই আমিরাতে সবচেয়ে কম মজুরীপ্রাপ্ত বাংলাদেশি শ্রমিক।
নরসিংদীর হাবিব বাংলাদেশি মালিকানাধীন একটি ক্লিনার কোম্পানিতে কাজ করছেন। প্রতি দুই বছরে করতে হয় ভিসা নবায়ন। একটি ভিসা শেষ করে হাবিব আরেক ভিসা নবায়ন করেছেন। কাজ করেন সাত'শ দিরহাম বেতনে। দুবাইয়ে আল বারাহা হাসপাতাল তার বর্তমান কর্মস্থল। নিজের খাওয়া, নিজের সব খরচ। এমনকি ছুটিতে দেশে যাওয়ার সময় পান না বিমান টিকিট কিংবা লিভ সেলারি। নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখা কষ্ট আর ক্ষোভমুক্তির জন্য বললেন, 'এহানে থাইক্কা টেহাও গেলো, জীবনও গেলো। নিজেরও তো বিবি বাচ্চা আছে, মনতো চায় দেশে যাই! এই অল্প টেহা সেলারি। নিজে খাইয়াম, না ইন্টারনেট বিল দিয়াম, না দেশে দিয়াম! কেমনে কি! তার উপর কোম্পানি টিকিট দেয় না। কয়, নিজের টেহা আছে ত দেশে যাও, টেহা নাই যাইওনা। এহন চিন্তা ভাবনা করতাছি, ভিসা শেষ হইলে এরপর যাইয়াম। '
মানিকগঞ্জের শাহিনুল ইসলাম। বয়স চব্বিশ পঁচিশ। কাজ করেন ক্লিনার কোম্পানিতে। চার বছর আগে দুবাই এসেছেন, এরমধ্যে একবার গিয়েছিলেন দেশে। ভাবছেন এবার দেশে গিয়ে বিয়ে করবেন। অথচ নয়শ' দিরহাম বেতনে নিজেকে গুছিয়ে নিতেই হিমশিম খেতে হয় শাহিনকে। বর্তমান কর্মস্থল মিরডিপ সিটি সেন্টার। তার দায়িত্ব পড়েছে ওয়াশ রুমে। ডিউটি দুপুর বারটা থেকে রাত বারটা, কখনও আবার রাত বারটা থেকে দুপুর বারটা। কোম্পানি প্রদত্ত রুমে থাকলেও খেতে হয় নিজের টাকায়। খাওয়া ও ব্যক্তিগত খরচ শেষে যা অবশিষ্ট থাকে সেটাই পাঠিয়ে দেয় পরিবার পরিজনের কাছে। একই বেতনে গুনতে হয় ভিসা নবায়নের পঁচিশ শ' দিরহাম। নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টারত শাহিন বললেন, 'এসে ফেঁসে গেছি! পরিবারের কথা ভেবে চলে যেতে চাইলেও পারি না। এখন আত্মীয় স্বজনদের কেউ বিদেশ আসতে চাইলে সোজা 'না ' করে দেই। এখানে কি আছে সাফ-সাফাই করে দিন কাটে। নিজের মতো স্বপ্নটাও দেখতে পারি না। '
বরিশালের আহমেদ মিয়াকে দেখলে যে কেউ বললে 'অনেক হয়েছে, এবার দেশে যান '। কিন্তু সেই কথাটি ফিরিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, 'ছেলেটা স্কুলে যায়। মেয়েটাও বিয়ে দিতে হবে। ছেলে বড় হলে চলে যাবো।' আহমেদ মিয়াও ক্লিনার কোম্পানির শ্রমিক। কাজ করতে হয় রাস্তায়। কখন দিনে, কখনও বা রাতে ডিউটি। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা কাগজ, বোতল আর ছোট ছোট ময়লা পরিস্কার করতে দেখা যায় তাকে। বেতন মাত্র ছয়শ' দিরহাম। কখনো কখনো চলতি পথে অ্যারাবিয়ানরা পাঁচ দশ দিরহাম বকশিশ দেয়। সেটা দিয়ে তার খাবার ও মোবাইল বিল হয়ে যায়।
এ তিনজনের মতো এমন হাজারও বাংলাদেশি শ্রমিক ভাগ্য বদলাতে আমিরাতে এলেও কাঙ্ক্ষিত সোনার হরিণ তাদের অধরাই রয়ে যায়।
বিডি-প্রতিদিন/ ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫/ রশিদা