কাজের খোঁজে দুবাইয়ে আসা শ্রমিকদের দুই-তৃতীয়াংশেরই কোম্পানি প্রদত্ত আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে দুবাইয়ের 'মুহাইছেনা' নামক এলাকায়। এখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানি, নেপালিসহ শ্রমিকদের বড় একটি অংশই এশিয়ান। এসব শ্রমিকদের কোথায় থাকেন প্রশ্ন করলে প্রায় সবাই উত্তর দেন 'সোনাপুর'। কাগজে কলমে 'মুহাইছেনা' হলেও এলাকাটি 'সোনাপুর' নামেই এখন পরিচিত। 'মুহাইছেনা থেকে সোনাপুর' নাম পরিরর্তন সম্পর্কে কেউ সরাসরি জানাতে না পারলেও বিষয়টি সহজে আঁচ করা যায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের মুখে মুখে প্রচারণাই এ নামের প্রতিষ্ঠা। আয়তনের দিক থেকে মুহাইছেনা এলাকা চারটি ক্রমিক নম্বরে ভাগ করা। মুহাইছেনা ১নং ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া, মুহাইছেনা ২নং লেবার ক্যাম্প ও মুহাইছেনা ৩-৪নং সরকারি চাকুরে কর্মকর্তাদের কলোনি।
দুবাইয়ের লাইসেন্সধারী বিল্ডিং কন্সেক্ট্রাশন, সিকিউরিটি, ব্যবসায়ী, ক্লিনার, কার ওয়াশ কোম্পানিগুলো তাদের কর্মী শ্রমিকদের জন্য মুহাইছেনা ২নং লেবার ক্যাম্পে থাকার ব্যবস্থা করেন। মুহাইছেনা লেবার ক্যাম্প এরিয়াকে কেন্দ্র করে সরকারি ভাবে এখানে স্থাপন করা হয়েছে আমিরাত আইডি কার্ড অফিস, ইমেগ্রেসন অফিস, লেবার কোর্ট ও মেডিকেল ফিটনেস সেন্টার। এছাড়া শ্রমিকদের সুবিধার্থে ৫০টির মতো দোকান-পাট গড়ে তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশি মালিকানাধীন চারটি টাইপিং সেন্টার, বাংলাদেশি ও ভারতীয়দের খাবারের হোটেল-রেঁস্তোরা, সেলুন ও রয়েছে কয়েকটি সুপার মার্কেট। এছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যায় সোনাপুরে বসে একটি অস্থায়ী বাজার। নাম 'বাংলাবাজার'। বাংলাবাজারে বিকেল পাঁচটা থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত মাছ মাংস, ফলমুল, শাকসবজি, ঝাল-মুড়ি, দেশী দই, চানাচুর, আমলেট, ভাপাপিঠাসহ বাঙ্গালী খাবারের আয়োজনে অস্থায়ী দোকান সাজিয়ে বসেন বাংলাদেশিরা।
সোনাপুরে বসবাসকারী বাংলা পত্রিকা মুকুল সম্পাদক লুৎফুর রহমান জানান, 'এক শ্রেণীর নিম্ন আয়ের শ্রমিকরা দেশের মতো হাট-বাজার নিয়ে বসেন বাংলাবাজারে। আগে শুধুমাত্র বাংলাদেশি বিক্রেতারা আসলেও এখন পাকিস্তানী কিছু লোকও নানা পসরা সাজিয়ে বসেন। সেই সাথে সকল দেশের ক্রেতাদের আনাগোনা থাকে এ বাজারে। কমমূল্যে এখান থেকে দেশের অনেক খাবারের স্বাদ গ্রহণ করা যায়। কিন্তু এসব বাজারে দেশের মেলার মতো নানা অবৈধ কাজে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশিরা দেশের সুনাম নষ্ট করছে। আমিরাতের আইন অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ এ বাজার সম্পূর্ণ বেআইনি তাই সিআইডি ও পুলিশের তাড়াতে নিত্য ভোগান্তি পোহাতে হয় বাংলাদেশি দোকানীদের। অনেক সময় পুলিশ এলে দোকানীরা ভয়ে দোকান রেখে পালিয়ে যান। উপস্থিত লোকজনকে পুলিশ মালপত্র নিয়ে যাবার আদেশ দিলে সেসব দোকান পাট লুট করে নেন ওঁৎ পেতে থাকা এক শ্রেণীর লোক।'
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে ছোট বড় বিল্ডিং। কিছু দূর পরপর দোকানপাট। বিল্ডিং গুলোতে থাকেন শ্রমিকরা। এসব বিল্ডিংয়ের বারান্দায় ঝুলে আছে শ্রমিকদের ব্যবহৃত পোশাক। এগুলো দেখেই যে কেউ ধারণা করতে পারেন এখানকার শ্রমিকদের জীবনচিত্র। সকাল-সন্ধ্যা তাদের ব্যস্ত থাকতে হয় কাজের মাঝে। এদের বেশির ভাগেরই ভোর হয় গাড়িতে। রাত চারটা-পাঁচটা থেকে শুরু হয় ডিউটিতে যাবার প্রস্তুতি। সারাদিন কর্মস্থলে কাটিয়ে সন্ধ্যা সাতটা-আটটায় রুমে ফিরে আসতে হয় তাদের। শ্রমিকদের অনেকেই বললেন, 'সপ্তাহে একদিন ছুটি পাই। ওই দিনটি আনন্দের, দেশে ফোন করে আর ঘুমিয়ে সময় কাটাই। এয়ারপোর্ট থেকে সোনাপুর আবার সোনাপুর থেকেই এয়ারপোর্ট। এই করে কাটে প্রবাসের সময়। দুবাই এসেছি মনে হয়না, শুধু মনে হয় কাজ করতে এসেছি। তাই কাজ করি।'
মানিকগঞ্জের মোফাস্সেল বললেন, 'আমাদের কথা বলার মতো বা শোনার মতো কেউ নেই। নিজের সাথে নিজের কথা ভাগ করি। কোম্পানি কয়েক মাস বেতন না দিলেও কাজ করতে হয়। কারণ আমাদের হয়ে প্রতিবাদ করার মতো এখানে কেউ নেই। দেশে ফেলে আসা পরিবারের কথা ভেবে দিন পার করি। তাদের জন্য টাকা পাঠাই এতেই সুখের সীমাবদ্ধতা!'
বিডি-প্রতিদিন/২০ জানুয়ারি, ২০১৫/মাহবুব