প্রবাস প্রজন্মের বক্তব্য, আবৃত্তি আর একাত্তরের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় সেই ভাষণের অবিকল উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে ব্যতিক্রমী এক আমেজে নিউইয়র্কে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান করলো ‘যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম’।
৪৯তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ৩১ মার্চ রবিবার সন্ধ্যায় এ অনুষ্ঠান হয় জ্যাকসন হাইটসে জুইশ সেন্টার মিলনায়তনে। পুরো অনুষ্ঠানটি নিবেদিত হয় প্রবাস প্রজন্মের প্রতি এবং তাদের মুখেই একাত্তরের বীর বাঙালির ভূমিকা উচ্চারিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এমন আয়োজনের গুরুত্ব অপরিসীম বলে মন্তব্য করেছেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশের কন্সাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসা।
সাদিয়া বলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা হলেন জীবন্ত কিংবদন্তী। তাদের কাছ থেকে নতুন প্রজন্মের কৌতুহল মেটানোর মাধ্যমেই সত্যিকারের ইতিহাস ভবিষ্যতের কাছে রেখে যাওয়া সম্ভব। প্রবাসের মুক্তিযোদ্ধারা সহযোগিতা দিলে আমি কন্স্যুলেটে তাদের কাছে থেকে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী নতুন প্রজন্মকে শোনাতে চাই।’
এ সময় কন্সাল জেনারেল বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, ‘সামনের বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে নিউইয়র্কেও ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। সে সমাবেশে প্রবাস প্রজন্মের সম্পৃক্তি বাড়াতে চাই সকলের সহযোগিতা। একইভাবে ২০২১ সালে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উৎসবকে সামনে রেখেও সকলকে এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। এসব উৎসব-আয়োজনের মধ্য দিয়েই আমেরিকা তথা আন্তর্জাতিক মহলকে বাঙালির এগিয়ে চলার কাহিনী ছড়িয়ে দিতে হবে।’
এ অনুষ্ঠানে একাত্তরে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণ অবিকলভাবে উপস্থাপন করে তৃতীয় গ্রেডের ছাত্র শাহ শেখ আলফি সিয়াম। উপস্থিত সকলে অভিভূত হন সিয়ামের উপস্থাপনায়।
অভিভূত কন্সাল জেনারেল তাকে কাছে টেনে আদর করেন এবং অভিবাদন জানান।
এরপর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সেজুতি বাংলা তার বাবার একাত্তরের ভূমিকার আলোকে বক্তব্য দেয়। সুসজ্জিত একটি বাহিনীকে কীভাবে বাঙালিরা পর্যুদস্ত করেছিল তা বিবৃত হয় সেজুতির কন্ঠে।
ছোট্টমণি প্রিয়া নন্দি আবৃত্তি করে ‘আমাদের এই বাংলাদেশ’নামক একটি কবিতা। সেখানেই মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি স্থান পায়।
বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের আলোকে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন ৩ ছোট্টমণি প্রিণা, লিরা এবং সামিদা।
লাল-সবুজের ব্যাক গ্রাউন্ডে স্বাধীনতা দিবসের এ অনুষ্ঠান শুরু হয় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীতের পর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সকলে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালনের মধ্য দিয়ে।
স্বাগত বক্তব্যে ফোরামের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ আহমেদ অনুষ্ঠানের প্রেক্ষাপট উপস্থাপনকালেই বলেন, ‘আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী ও বড় হওয়া প্রজন্মকে আমাদের উত্তরাধিকার করতে চাই সর্বান্তকরণে। সেজন্যে আজকের অনুষ্ঠানটি তাদের প্রতিই নিবেদিত হয়েছে। শিশুরাই বলবে মুক্তিযুদ্ধের কথা, জাতিরজনকের অবিস্মরণীয় নেতৃত্বগুণের কথা।’
ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বারির সঞ্চালনায় এ অনুষ্ঠানে বক্তব্যকালে কবি ও কলামিস্ট ফকির ইলিয়াস, নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাকারিয়া চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের মিয়া বলেছেন, স্বাধীনতার চেতনার বিরুদ্ধে এই নিউইয়র্কেও সংঘবদ্ধ একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। তারা অত্যন্ত কৌশলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
ফকির ইলিয়াস ক্যটাগরিকেলি অভিযোগ করেছেন, শত কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে রাজধানী ঢাকা থেকে লন্ডন-নিউইয়র্ক পর্যন্ত একটি টিম মাঠে নেমেছে। সুশীল সমাজ, কবি-লেখকের ছদ্মাবরণে ওরা কাজ করছে মুক্তিযুদ্ধের নাম-নিশানা মুছে ফেলার মতলবে। এ ব্যাপারে সকলকে সজাগ থাকতে হবে।
কবি ফকির ইলিয়াস উল্লেখ করেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে আপস বা ব্যালেন্স করার কোনও অবকাশ থাকতে পারে না।’
জাকারিয়া চৌধুরী বলেছেন, ‘গণমাধ্যমের আড়ালে একটি অপশক্তি নিউইয়র্কে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে। বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন-অগ্রগতি সম্পর্কেও ওরা পাশ্চাত্যে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি (প্রেস) নূর এলাহি মিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ রচনায় অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মডেলে পরিণত হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত রাখতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আর এভাবেই স্বাধীনতার প্রত্যাশা পূরণ হবে। ’
অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আনোয়ার বাবলু একটি কবিতা পাঠ করেন।
প্রবাসের জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বহ্নিশিখা সঙ্গীত নিকেতন’র কর্মকর্তা উইলি নন্দির নেতৃত্বে একদল শিল্পী দেশের গান পরিবেশন করেন। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন চন্দনা ভট্টাচার্য।
গভীর রাতে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে কণ্ঠযোদ্ধা শহীদ হাসানের কণ্ঠে দেশের গানের মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠানে সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশার চুন্নু এবং হারুন ভূইয়া, যুগ্ম সম্পাদক কাদের মিয়া এবং আশরাব আলী খান লিটন, কোষাধ্যক্ষ মো. আলিম খান, প্রচার সম্পাদক শাহ জে চৌধুরী, সাংস্কৃতিক সম্পাদক উইলি নন্দি, নির্বাহী সদস্য মুক্তিযোদ্ধা লাবলু আনসার, মুক্তিযোদ্ধা এম এ আওয়াল, মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক, কমিউনিটি লিডার ফাহাদ সোলায়মান প্রমুখ।
বিডি প্রতিদিন/কালাম