শনিবার, ২৯ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

আমেরিকায় আইটি নিরাপত্তায় বাংলাদেশি নাবিল

সাইফ ইমন

আমেরিকায় আইটি নিরাপত্তায় বাংলাদেশি নাবিল

ছবি : রাফিয়া আহমেদ

হ্যাকিং একটা আর্ট আর ‘হ্যাকার’ শব্দটার মাঝে রয়েছে অনেক দাপট। হ্যাকিং শিখতে প্রচুর সময় আর সাধনা দরকার। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং দুর্বলতা বের করে বিনা অনুমতিতে অন্যের কম্পিউটারে বা সিস্টেমে প্রবেশ করাকেই আমরা সাধারণত হ্যাকিং বলে থাকি। কোনো কিছু বা অনলাইনে ডাটা বা তথ্য অনুমতিহীন প্রবেশ, চুরি, ধ্বংস বা ক্ষতি করাকেই বলা হয় হ্যাকিং। আমরা হ্যাকিং শুনলেই প্রথমে ভাবি যে, কিছু অসাধু বুদ্ধির অধিকারী লোক কোনো কিছু চুরি করেছে। এটা একটা ভুল ধারণা, সব হ্যাকার অসাধু বুদ্ধির অধিকারী নন। কিছু হ্যাকার তার মানুষের পক্ষে প্রাণপণ করে যান। যাতে আমাদের কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন না হয়। এদের বলা হয় হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার। হ্যাকিং যে কোনো খারাপ কিছু না তা প্রমাণ করেন হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার। তাদের অন্য নাম ‘ইথিক্যাল হ্যাকার’। তেমনই একজন ইথিক্যাল হ্যাকার বাংলাদেশি নাবিল হান্নান। বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। একজন হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার কোনো সিস্টেমের ত্রুটিগুলো বের করে এবং সিস্টেমের সিকিউরিটি মালিককে তা সম্পর্কে অবহিত করে। যার ফলে আপনার কম্পিউটার ও নেটওয়ার্কিং সিস্টেম আক্রমণে ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যায়। নাবিল                                      

 

হান্নানের কাজটিও ঠিক তাই। কাজ করছেন বর্তমানে বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিনোপ্সিসে। তিনি সিনোপ্সিসের হয়ে বিশ্বের বড় বড় ১৮টি ব্যাংকের সিস্টেমের সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করেন। এ ছাড়াও আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের সিস্টেমের সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করছেন তিনি। বিশ্বের সব নামি-দামি পত্রিকায় নাবিল হান্নান বিশেষজ্ঞ হিসেবে সাক্ষাৎকারও দিচ্ছেন। একজন বাংলাদেশি হিসেবে এই অর্জন নিঃসন্দেহে অনন্য। নাবিল হান্নানের বাবা মো. আব্দুল হান্নান এবং মা ডক্টর সেলিনা আফরোজা। বাবা লন্ডনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে অবসর নেন লন্ডন থেকে আর মা সেক্রেটারি থেকে অবসর নেন ঢাকায়। পরিবারে রয়েছে এক ছোট ভাই সার্জিল হান্নান। এই ছোট ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে সম্প্রতি দেশে এসেছিলেন নাবিল হান্নান। সময় দিয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের অফিসেও। তার সঙ্গে কথা হয়েছে জীবনের নানা দিক নিয়ে। কীভাবে তিনি একজন হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার হয়ে উঠলেন বলেছেন বিস্তারিত। জীবনের প্রথম বারো বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ১২টি স্কুলে পড়েছেন নাবিল। আজিমপুর লিটল এঞ্জেল্স স্কুল থেকে শুরু হয়ে তার শিক্ষাজীবন। 

 

পাঁচ বছর বয়সে প্রথম কম্পিউটার

নাবিল হান্নানের বাবা-মা দুজনই বাংলাদেশের কূটনৈতিক হিসেবে ফরেন সার্ভিসে কাজ করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তারা তখন কাজ করছেন রাশিয়ার মস্কোতে। তখন কোনো বন্ধু ছাড়া একা একা সময় কাটাতেন শিশু নাবিল। একদিন নাবিলের বাবা মা তার জন্য বাসায় কম্পিউটার নিয়ে এলেন। সেটাই ছিল নাবিলের প্রথম কম্পিউটারে হাতেখরি। শুরুটা হয়েছিল বিভিন্ন কম্পিউটার গেমসের মাধ্যমে। এদিকে নাবিলের বাবা মা ছিলেন খুব সচেতন। নাবিল বলেন, বাবা মা চাইতেন আমি যেন বাংলা ভাষাটা না ভুলে যাই। তখন অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি ছাত্র থাকতেন সেখানে। তারা বাংলাদেশি খাওয়া খুব মিস করতেন। একজন ছিল যে মস্কোতে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করছেন তখন। আম্মু তাকে বলছিল যে তিনি যেন আমাদের বাসায় যে কোনো সময় আসেন এবং খাওয়া-দাওয়া করেন। কিন্তু একটাই শর্ত ছিল আমাদের দুই ভাইয়ের সঙ্গে তাকে বাংলায় কথা বলতে হবে গল্প করতে হবে। তিনি কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করছিলেন তাই তিনি আমাকে একটা বই এনে দিয়েছিলেন। এটি ছিল কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের ওপর একটি বই।

 

৭ বছর বয়সে প্রথম প্রোগ্রামিং

নাবিলের বয়স যথন মাত্র ৭ বছর তখনই তিনি প্রথম প্রোগ্রামিং শুরু করেন। প্রোগ্রামিংয়ের সেই বই পড়ে চেষ্টা করতেন নিজে নিজে প্রোগ্রামিং করতে। এভাবেই শুরু হলো কম্পিউটারের প্রোগ্রামিং জগতে নাবিলের প্রথম প্রবেশ। শুরুতে বই থেকে কোট কপি করে প্রোগ্রামিং লিখতে শুরু করেন। এভাবে একসময় নিজেই নানা প্রোগ্রাম মোডিফাই করতে শুরু করেন। একসময় ছোটখাটো গেম বানাতে শুরু করেন নাবিল। হঠাৎ সফটওয়্যার থেকে হার্ড ওয়্যারের দিকে নজর যায় তার। জানতে হবে কম্পিউটার আসলে কীভাবে কাজ করে। স্ক্রু দিয়ে খুলে ফেলেছিলেন কম্পিটার। তিনি বলেন, আমার কোনো আইডিয়া ছিল না আমি কী করছি। আল্টিমেটলি আমি কম্পিউটারটি নষ্ট করে ফেলেছিলাম। আমি নিজেই বসে খুলে ফেলেছিলাম। সময়টা ছিল ১৯৯২। আমি তখন আব্বু আম্মুর অনেক বকা খেয়েছি কম্পিউটার নষ্ট করে ফেলার জন্য। কয়েক মাস আমাকে কম্পিউটারের কাছে যেতে দেওয়া হয় নাই। তখন কিন্তু কারও বাসায় কম্পিউটার থাকা সারপ্রাইজিং। রাশিয়ায় তখনো কম্পিউটার অ্যাভয়েলেবল হয়নি। এরপর অনেক দিন প্রোগ্রামিং করা হয়নি। আমার যখন ১০ বছর বয়স তখন আবার আমি প্রোগ্রামিং শুরু করি।

 

হ্যাকিংয়ের শুরু ১০ বছর বয়সে

বাবা মার পোস্টিং তখন ভারতে। প্রোগ্রামিং আবার শুরুটা হয় বিভিন্ন কম্পিটার গেমের চিট কোড বের করার মাধ্যমে। কিন্তু সবসময় বন্ধুদের থেকে এগিয়ে ছিলেন নাবিল। কারণ চিট কোড বের করার সময়ে তিনি গেমটাই চেঞ্জ করে ফেলতে পারতেন। ফলে বন্ধুরা অবাক হয়ে যেত নাবিলের কর্মকান্ডে। নাবিল বলেন, আমি যে এ বয়সে বসে কম্পিউটার প্রোগ্রাম চেঞ্জ করে করে খেলতাম বন্ধুরা বুঝত না। কিন্তু আমি তাদের বলতাম না আমি আসলে কী করছি। আমি আসলে জানতাম না যে আমি নিজের অজান্তেই হ্যাকিং করছি। আমি এটা ঠিকই করতাম। আমার অন্য কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না। এ সময় আমি নিজে নিজে আরও কিছু কম্পিউটার ল্যাঙ্গুয়েজ শিখে ফেলি।

 

১২ বছর বয়সে কানাডার হাই স্কুলের শিক্ষক

একসময় নাবিলদের সপরিবারে চলে যেতে হয় কানাডায়। তখন ১২/১৩ বছর বয়স নাবিলের। সে সময়ই কানাডার হাই স্কুলে ক্লাস নিতে শুরু করেন নাবিল। কম্পিউটার সায়েন্স ক্লাসের নাইন গ্রেডের সিলেবাস মাত্র তিন ঘণ্টায় শেষ করে ফেলেন নাবিল হান্নান। একটা অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করতে সময় লাগত কয়েক মিনিট মাত্র। শিক্ষক তখন পরবর্তী এসাইনমেন্ট দিতেন তাও দ্রুত শেষ করে ফেলেন নাবিল। এরপর শিক্ষক তাকে পুরো সিলেবাস বুঝিয়ে দিয়ে বলেন শেষ করতে। ছোট্র নাবিল সেই ক্লাসে বসেই পুরো সিলেবাস শেষ করে ফেলেন। গ্রেড নাইনের সিলেবাস শেষ হয়ে যাওয়ায় তাকে তখনই গ্রেড টেনের সিলেবাস দেন শিক্ষক। একসময় নাবিলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে নাবলিকেই বলেন সহপাঠীদের ক্লাস নিতে। নাবিল বলেন, আমি তখন বুঝতে পারি আমার একটা ন্যাচারাল ক্যাপাবিলিটি আছে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে। তখন আমার ইন্টারেস্টটা বেড়ে যায়। আমি আরও উদ্যম নিয়ে কাজ করতে শুরু করি।

 

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটার লু

কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলু তে ২০০৩ সালে অ্যাডমিশন নেন নাবিল হান্নান কম্পিউটার সায়েন্সে। অনার্স শেষ করেন ২০০৭ সালে। এর মধ্যে তিনি দক্ষ প্রোগ্রামার হয়ে উঠতে থাকেন। সে সময় তার সহপাঠীরা তার কাছে যেতেন পড়াশোনা করতে। তিনিও ধৈর্য নিয়ে সবাইকে হেল্প করতেন। নাবিল বলেন, আমি যখন গ্রেড নাইনে ছিলাম তখনই আমাকে শিক্ষকরা গ্রেড ইলেভেন/টুয়েলভের প্রোগ্রামিং কনটেস্টে ঢুকিয়ে দেন স্কুলের পক্ষ থেকে। মজার বিষয় হলো সেই কনটেস্ট ছিল এই ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলুতেই।

 

কখনো প্রথম হননি

স্কুল লাইফে কখনো প্রথম হননি নাবিল। কিন্তু তার সহপাঠীরা যখন ইউভার্সিটি শুরু করে তখন নাবিল  ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলু তে ফোর্থ ইয়ারে পড়ে। সহপাঠীরা তখন তার কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করত। কারণ তারা পড়াশোনা পারত না। স্কুলে যারা এক সময় নাবিলকে নিয়ে মজা করেছে পড়াশোনা পারত না বলে। সেই নাবিলের কাছেই তারা পড়তে যেত ইউনিভার্সিটি লাইফে। নাবিল বলেন, একবার হয়েছে কি আমার এক স্কুল ফ্রেন্ড আমার বাসায় এসে বলে দোস্ত আমাকে শিখিয়ে দাও। আমি পারছি না। আমি বললাম কেন কী হয়েছে? ও বলল আমরা ভুল করেছি তোমাকে বুঝি নাই। তুমি যেভাবে বুঝতা আমরা সেভাবে কখনো বুঝি নাই। আসলে ওরা প্রাইভেট টিউটরের কাছে যেত। তারা মুখস্থ করিয়ে দিত। আরেকটা ইন্টারেস্টিং জিনিস হচ্ছে আমার বন্ধু খুব কম। বন্ধু লাইফে খুবই ইম্পর্টেন্ট। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে অনেক বন্ধুর সঙ্গে আবার যোগাযোগ হচ্ছে। ভারতের বন্ধু, কানাডার বন্ধু, রাশিয়ার বন্ধু এমনকি খুব ছোটবেলার ঢাকার বন্ধুর সঙ্গেও যোগাযোগ হচ্ছে।

 

সংগীতপ্রেমী

সংগীতের প্রতি এক রকম ভালোবাসা রয়েছে নাবিলের। গিটার পিয়ানো থেকে শুরু করে নানা রকম বাদ্য যন্ত্র বাজাতে পারেন নাবিল। চমৎকার গানও করেন। গানের ক্ষেত্রে বাংলা ইংলিশ হিন্দি যখন যেটা মন চায় গেয়ে ফেলেন তিনি। সাউন্ড ক্লউডে রয়েছে তার চমৎকার কিছু গাওয়া গান। যেখানে তার অনেক গানের ভক্তও জুটে গেছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের কনফারেন্স রুমে তিনি গিটার হাতে চমৎকার একটি গানও পরিবেশন করেন। অনুরোধের ঢেঁকি থেকে শুরু করে রাইস মিলও মাঝে মাঝে গিলতে হয় তাকে নানান জায়গায় তার অসাধারণ গায়কীর জন্য।

কাজের সুবাদে বিশ্বের নানা প্রান্তের নানা লোকের সঙ্গে নাবিলের ওঠাবসা। মনে বাংলাদেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকে নাবিল সব সময় চেষ্টা করেন একজন বাংলাদেশি হিসেবে তার সর্বোচ্চটা দিতে। বাংলাদেশের একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো কিন্তু তাকে পছন্দ হয় নাই এমনটা যেন না হয় সেই দিকে সূক্ষ্ম নজর তার। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের পতাকা চির উন্নত মম শির নাবিলদের হাত ধরেই।

সর্বশেষ খবর