শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ফুটবল কখনো ভুলবে না পেলেকে

রাশেদুর রহমান

ফুটবল কখনো ভুলবে না পেলেকে
দিয়েগো ম্যারাডোনা আর পেলেকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই ভক্তদের মধ্যে। তবে দুজনেই ছিলেন দুজনের খুব প্রিয়। পেলে যেমন ম্যারাডোনার প্রশংসা করেছেন, তেমনি ম্যারাডোনাও পেলের প্রশংসা করেছেন। ২০১২ সালে ম্যারাডোনা একবার বলেছিলেন, ‘আমার কাছে শিল্পী হলো সেই যে অন্ধকার কক্ষ আলোকিত করে দেয়। আমি কখনই ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে কার্লোস আলবার্তোকে দেওয়া পেলের পাস এবং তরুণ কবি রিমবুডের কবিতার মধ্যে পার্থক্য করতে পারিনি।’

ফুটবল একটা খেলা। বল নিয়ে এগারো দুগুণে বাইশ জন মানুষ একটা নির্দিষ্ট মাঠে লড়াই করে। পরস্পরের দিকে এগিয়ে গিয়ে গোল দেওয়ার চেষ্টা করে। এই খেলাটা সম্পর্কে মানুষের ধারণা এমনই ছিল। পেলের আগে। ব্রাজিলের হলুদ জার্সিতে ১৯৫৮ সালে প্রথমবার খেলাটার মধ্যে বাড়তি বিশেষণ যোগ করেন পেলে। তাকে বল নিয়ে কারিকুরি করতে দেখে ইংরেজ ধারাভাষ্যকার স্টুয়ার্ট হল খেলাটার নাম দিলেন ‘দ্য বিউটিফুল গেম’। পর্তুগিজ ভাষায় বলা হলো ‘জোগো বোনিতো’।

পেলের আগে ফুটবল কেবলই একটা খেলা ছিল। তিনিই এর মধ্যে যোগ করেন শিল্প। কথাটা ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমারের। পেলের রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছেন নেইমার। হয়তো ছাড়িয়েও যাবেন। ব্রাজিলের জার্সিতে ৭৭ গোল করেছিলেন পেলে। দীর্ঘদিন এটা ছিল ব্রাজিলের জার্সিতে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড। নেইমারের নামের পাশেও এখন ৭৭ গোল। হলুদ জার্সিতে তিনি স্পর্শ করেছেন পেলের গোলের রেকর্ড। কিন্তু পেলের নামের পাশে আরও বহু কিছু আছে। তিনটা বিশ্বকাপ ট্রফি আছে। ১৯৫৮ সালে গারিঞ্চ-ভাভা-জাগালো-ডিডিদের সঙ্গে মিলে বিশ্বকাপ জয় করেন তরুণ পেলে। ১৯৬২ সালেও জয় করেন বিশ্বকাপ। সেবার অবশ্য খুব বেশি ম্যাচে খেলতে পারেননি তিনি। ইনজুরির কারণে মাঠের বাইরে ছিটকে গিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে ফের পেলে বিশ্বকাপ জয় করেন। তিনটা বিশ্বকাপজয়ী একমাত্র ফুটবলার তিনি।

বাবা-মা বেশ সখ করে নাম রেখেছিলেন এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। কিন্তু তিনি কীভাবে পেলে হয়ে উঠলেন? ছেলেবেলায় গোলরক্ষক হিসেবে খেলতে নামতেন পেলে। সে সময় স্থানীয় জনপ্রিয় ফুটবলার বিলের নামে তার ডাকনাম হয়ে উঠে বিলে। কিন্তু বিলে নামটা মোটেও পছন্দের ছিল না পেলের। তিনি প্রতিবাদ করতেন এই নামে ডাকলে। পরবর্তীতে বিলে নামটাও আর ঠিক থাকেনি। তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন পেলে নামে। ছেলে-মেয়েরা বিলে নামটাকে ভেঙে পেলে নামে ডাকতে শুরু করেছিল। এই নাম বাবা-মায়ের দেওয়া নয়। ফুটবলের দেওয়া। তিনি তো ফুটবলেরই। ফুটবলও তার।

পেলের অসংখ্য রেকর্ড আছে। এর মধ্যে একটা হলো দুটি বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করে দুটিই জয় করার অনন্য রেকর্ড। এই রেকর্ডটা অবশ্য ব্রাজিলের আরেক কিংবদন্তি ভাভারও আছে। দুটি ফাইনালে গোল করার রেকর্ড আছে পশ্চিম জার্মানির পল ব্রেইটনার এবং ফ্রান্সের জিনেদিন জিদান ও কিলিয়ান এমবাপ্পেরও। কিন্তু এদের কেউই দুটি বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। পল ব্রেইটনার ১৯৭২ সালে চ্যাম্পিয়ন হলেও ১৯৮২ সালে রানার্সআপ হন। জিনেদিন জিদান ১৯৯৮ সালে চ্যাম্পিয়ন হলেও ২০০৬ সালে রানার্সআপ হন। কিলিয়ান এমবাপ্পে ২০১৮ সালে চ্যাম্পিয়ন হলেও ২০২২ সালে রানার্সআপ হন। পেলে ১৯৫৮ ও ১৯৭০ সালের ফাইনালে গোল করে ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন করিয়েছেন। ভাভা ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে এই কীর্তি গড়েছেন।

পেলের সতীর্থ ছিলেন মারিও জাগালো। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে জাগালো একটা গোলও করেন। এরপর ১৯৭০ সালে পেলেদের গুরুর দায়িত্ব পালন করেন জাগালো। কোচ হিসেবে ব্রাজিলকে উপহার দেন বিশ্বকাপের ট্রফি। জাগালো পেলেকে নিয়ে বলেছেন, ‘পেলেকে বলা হয় ফুটবলের বিটোফেন।’ দিয়েগো ম্যারাডোনা আর পেলেকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই ভক্তদের মধ্যে। তবে দুজনেই ছিলেন দুজনের খুব প্রিয়। পেলে যেমন ম্যারাডোনার প্রশংসা করেছেন। তেমনি ম্যারাডোনাও পেলের প্রশংসা করেছেন। ২০১২ সালে ম্যারাডোনা একবার বলেছিলেন, ‘আমার কাছে শিল্পী হলো সেই যে অন্ধকার কক্ষ আলোকিত করে দেয়। আমি কখনোই ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে কার্লোস আলবার্তোকে দেওয়া পেলের পাস এবং তরুণ কবি রিমবুডের কবিতার মধ্যে পার্থক্য করতে পারিনি।’ পেলে এমনই ছিলেন। তার ফুটবল কারও কাছে ছিল সংগীতের মতো। কারও কাছে ছিল কবিতার মতো ছন্দময়।

পেলে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। দীর্ঘদিন তিনি কোলন ক্যান্সারে ভুগেছেন। কাতার বিশ্বকাপের সময়টাতেই বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বিশ্বকাপ চলকালেই ব্রাজিল দল পেলের জন্য ছিল বেশ চিন্তিত। বিশ্বকাপের সময়টা হাসপাতালেই কেটে যায় পেলের। মাঝখানে তার সুস্থতার খবরও বেরিয়েছিল। তবে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য ওপারে চলে গেলেন ফুটবলের রাজা পেলে।

 

পেলের যত কীর্তি

বিশ্বকাপের সেরা

১৯৫৮ সালে একজন তরুণ হিসেবে বিশ্বকাপ খেলতে যান পেলে। গিয়েই বাজিমাত করেন তিনি। ৬টা গোল করেন। ব্রাজিলকে উপহার দেন বিশ্বকাপের ট্রফি। টুর্নামেন্টে সেরা তরুণ ফুটবলারের পুরস্কার জেতেন। ১৯৬২ সালেও চ্যাম্পিয়ন হন ব্রাজিলের জার্সিতে। সেবার একটা গোল করেন। ইনজুরির জন্য শেষদিকের ম্যাচগুলো খেলতে পারেননি। তবে ১৯৭০ সালে দারুণ খেলেন পেলে। সেবার চারটা গোল করেন তিনি।

 

গোলের খতিয়ান

অফিশিয়াল হিসাব বলছে, পেলে মোট ৭৫৭ গোল করেছেন ব্রাজিল ও ক্লাবের জার্সিতে। তবে আন-অফিশিয়াল হিসাবে সংখ্যাটা অনেক। ১৩৬৩ ম্যাচে ১২৭৯ গোল। এদিক দিয়ে পেলে সবার ওপরে। অবশ্য ফিফার কাছ থেকে এ সংখ্যাটা স্বীকৃতিও পায়নি। তবে গোল করার জন্য পেলেকে কখনো ভুলতে পারবে না ফুটবল দুনিয়া। মেসি (৭৯৩) এবং রোনালদো (৮১৯) দুজনেই পেলেকে ছাড়িয়ে গেছেন।

 

ক্লাব ফুটবলেও রাজা

ক্লাব ফুটবলে ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন ব্রাজিলের ক্লাব সান্তোসে। এই ক্লাবের জার্সিতে ২৫টা ট্রফি জিতেছেন তিনি। লিগ জিতেছেন কয়েকবার। কোপা লিবারতেদরস ট্রফি জিতেছেন দুবার। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত টানা খেলেছেন সান্তোসে। এরপর পাড়ি জমান নিউইয়র্ক কসমসে। সেখানে খেলেন ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত। এরপরই অবসরে যান ফুটবলের রাজা। নিউইয়র্কেও জয় করেন দুটি ট্রফি।

সর্বশেষ খবর