বিজয়ের মাসে ওমান, দুবাই হয়ে জ্যামাইকায় লাল-সবুজ পতাকা উড়ছে পতপত করে। ‘মরুরাজ্য’ ওমানে অনূর্ধ্ব-২১ হকি দল প্রথমবারের মতো যুব বিশ্বকাপ নিশ্চিত করেছে। ‘মরুশহর’ দুবাইয়ে যুব এশিয়া কাপে দাপুটে ক্রিকেট খেলছে টাইগার যুবারা। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ জয় করল দীর্ঘ ১৫ বছর পর। সর্বশেষ ২০০৯ সালে সেন্ট ভিনসেন্টের কিংসটাউন ও গ্রেনাডায় আনন্দোৎসব করেছিল টাইগাররা। দীর্ঘ ১৫ বছর পর জ্যামাইকার কিংস্টনের সাবিনা পার্কে ফের জয়োৎসব করল বাংলাদেশ।
ইনিংসের ৫০তম ওভারে বলটির উজ্জ্বলতা কমে গিয়েছিল। এমন বলে রিভার্স সুইং খুবই কার্যকর। ‘বাংলাদেশ এক্সপ্রেস’ নাহিদ রানা পুরনো বলটিকে সুইং কিংবা খাটো লেন্থের করেননি। ইয়র্কারে বোল্ড করেন শামার জোশেপকে। বোল্ড করে মুচকি হাসেন নাহিদ। এরপর আকাশপানে দুই হাত তুলে উচ্ছ্বাস করেন। ম্যাচ সেরা তাইজুল ইসলাম দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে আনন্দে মাতোয়ারা হন। আকাশসমান চাপে থাকা অধিনায়ক মেহেদি হাসান মিরাজ জয়ানন্দে শূন্যে লাফান। ড্রেসিংরুমে হেড কোচ ফিল সিমন্সসহ সবাই একে অপরকে অভিনন্দন জানান ঐতিহাসিক জয়ের আনন্দে। উসাইন বোল্ট, ইয়োহান ব্ল্যাক, শেলি অ্যান ফ্রেজারের অনিন্দ্যসুন্দর জ্যামাইকার রাজধানী কিংস্টনের স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ১০১ রানের অবিস্মরণীয় জয়ে সিরিজে সমতা আনে বাংলাদেশ। জয়েই ২০২৪ সাল শেষ করেছে টাইগাররা। ঐতিহাসিক জয়ের টেস্টে আবার বেশ কিছু রেকর্ডও গড়েছে।
২০০৯ সালে সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে জয়োৎসব করেছিল। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২২ সালে আরও তিনবার টেস্ট সিরিজ খেলেছে টাইগাররা। কিন্তু ড্রয়ের স্বাদ পায়নি। এবার নর্থ সাউন্ডে ২০১ রানের পাহাড়সমান হারে শুরু করেছিল সফর। গতকাল নাহিদের গতি, তাইজুল ইসলামের ঘূর্ণি এবং তাসকিন ও হাসান মাহমুদের বিধ্বংসী বোলিং ১০১ রানের অবিশ্বাস্য জয় উপহার দেয়। ১৫ বছর আগে ২০০৯ সালে কিংসটাউনে প্রথম এবং গ্রেনাডার সেন্ট জর্জেস পার্কে লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়েছিলেন সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মোহাম্মদ আশরাফুল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদরা। এদের কেউই নেই এবারের ঐতিহাসিক জয়ে। ইনজুরি না থাকলে মুশফিকের সম্ভাবনা থাকত। নিয়মিত অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তও নেই। দলকে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথমবার নেতৃত্ব দেন মেহেদি হাসান মিরাজ। প্রথম টেস্টে হারলেও জ্যামাইকায় দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি দারুণ নেতৃত্ব দেন মিরাজ।
জ্যামাইকায় বেশ কিছু রেকর্ড গড়েছে। টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে বাংলাদেশ এই প্রথম দেশের বাইরে ৩টি টেস্ট জিতল। আগস্টে পাকিস্তান ২-০ এবং এবার জিতল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে ৩টি টেস্ট জিতেছে এই বছর এবং সবই দেশের বাইরে। এর আগে ৩টি করে টেস্ট জিতেছিল ২০১৪, ২০১৮, ২০২৩ সালে। দেশের বাইরে ২০০৯ সালে ২টি টেস্ট জিতেছিল। চলতি বছর ৫টি সিরিজ খেলে একটিতে জিতেছে, একটি ড্র করেছে এবং বাকি ৩টি হেরেছে শ্রীলঙ্কা, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে।
সিরিজে সমতা ফেরাতে মরিয়া মিরাজ বাহিনী একাদশে দুই পরিবর্তন নিয়ে খেলে। প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং ব্যর্থতায় ১৬৪ রানে গুটিয়ে যায়। বিপরীতে নাহিদের গতিতে স্বাগতিকরা প্রথম ইনিংসে ১৪৬ রান করে। ১৮ রানে এগিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ২৬৮ রান করে বাংলাদেশ। টাইগাররা এই রান করে জাকেরের দৃঢ়তায়। জাকের বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ব্যাটার অভিষেক থেকে টানা তিন টেস্টে হাফ সেঞ্চুরি করেন। গতকাল ৯১ রানের ইনিংস খেলেন ১০৬ বলে ৮ চার ও ৫ ছক্কায়। প্রথম ৫০ রান করেন ৮০ বলে ৫ চার ও ৩ ছক্কায়। পরের ৪১ রান করেন মাত্র ২৬ বলে। যাতে ছিল ৩টি চার ও ৪টি ছক্কা।
স্বাগতিকদের ২৮৭ রানের টার্গেট দেয় বাংলাদেশ। জ্যামাইকার কিংস্টনের সাবিনা পার্কের ৯৪ বছরের ইতিহাসে ৫৫ টেস্টে এত রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড নেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২০০৩ সালে শ্রীলঙ্কার ২১২ রান টপকেছিল ৪২.৪ ওভারে রামনারেশ সারওয়ানের অপরাজিত ৮২ ও ব্রায়ান লারার অপরাজিত ৮০ রানে। সেখানে ২৮৭ রান! অবিশ্বাস্য। সেটাই হয়েছে। তাইজুলের ঘূর্ণির মায়াবী জাদুতে ৫০ ওভারে ১৮৫ রানে অলআউট হয়। তাইজুলের স্পেল ১৭-৫-৫০-৫। সব মিলিয়ে বাঁ-হাতি স্পিনার ৫১ টেস্ট ক্যারিয়ারে ১৫ বার ৫ বা ততোধিক উইকেট নেন। দেশের বাইরে চতুর্থ এবং ১০ বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ফের ৫ উইকেট পান তাইজুল। ম্যাচ জেতানো বোলিং করে ম্যাচ সেরা হন তাইজুল। প্রথম ইনিংসে ৬১ রানের খরচে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন নাহিদ রানা। ১১ উইকেট নিয়ে সিরিজ সেরা হয়েছেন তাসকিন আহমেদ। টেস্ট সিরিজ শেষ। এখন অপেক্ষা ওয়ানডে সিরিজের। ৮, ১০ ও ১২ ডিসেম্বর ওয়ানডে তিনটি অনুষ্ঠিত হবে সেন্ট কিটসে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
বাংলাদেশ : প্রথম ইনিংস, ১৬৪/১০ (সাদমান ইসলাম ৬৪, মেহেদি হাসান মিরাজ ৩৬) ও দ্বিতীয় ইনিংস, ২৬৮/১০, ৪১.৪ ওভার (সাদমান ইসলাম ৪৬, শাহাদাত হোসেন দীপু ২৮, মেহেদি হাসান মিরাজ ৪২, লিটন দাস ২৫, জাকের আলি ৯১, তাইজুল ইসলাম ১৪, মুমিনুল হক ০, হাসান মাহমুদ ৩, তাসকিন আহমেদ ০, নাহিদ রানা ১*। জায়দান সিলস ১৫.১-৩-৪৬-১, আলজারি জোসেফ ১৫.৫-১-৭৭-৩, শামার জোসেফ ১২-০-৮০-২, গ্রিভস ৮-১-২০-১, কাভেন হজ ১-০-৪-০, কেমার রোচ ১০-০-৩৬-৩)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ : প্রথম ইনিংস, ১৪৬/০ ও দ্বিতীয় ইনিংস, ১৮৫/১০, ৫০ ওভার ১৮৫ (ক্রেইগ ব্রেথওয়েইট ৪৩, মিকলি লুইস ৬, কার্টি ১৪, হজ ৫৫, আথানেজ ৫, গ্রিভস ২০, জশুয়া সিলভা ১২, আলজারি জোসেফ কেমার ৫, রোচ ৮, সিলস ১*, শামার জোসেফ ৮। হাসান মাহমুদ ৬-০-২০-২, তাসকিন আহমেদ ১০-০-৪৫-২, তাইজুল ইসলাম ১৭-৫-৫০-৫, নাহিদ রানা ৯-২-৩২-১, মেহেদি মিরাজ ৮-০-৩১-০)।
ফল : বাংলাদেশ ১০১ রানে জয়ী।
সিরিজ : দুই টেস্ট ম্যাচ সিরিজ ১-১ ড্র।
ম্যাচ সেরা : তাইজুল ইসলাম।