বাফুফের সাবেক সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন কথায় কথায় বলতেন, বাংলাদেশের ফুটবল পরিচালিত হবে ইউরোপকে অনুসরণ করে। ম্যানসিটি, লিভারপুল, চেলসি, রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, বায়ার্ন মিউনিখের নাম উচ্চারণ করে বলতেন, ‘আমাদের ক্লাবগুলো যত দিন তাদের পথে না হাঁটবে তত দিন ফুটবলে উন্নয়ন ঘটবে না। বাফুফে হাজার চেষ্টা করলেও চেহারার বদল করতে পারবে না। এখানে ফেডারেশনের পাশাপাশি ক্লাবগুলোকেও বড় ভূমিকা রাখতে হবে।’ সালাউদ্দিনের কথাগুলো একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট তো চিন্তা করতে হবে। যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সেখানে এ আকাশকুসুম চিন্তা কি মানায়? সালাউদ্দিন তো নিজেও ফুটবলার ছিলেন। তাঁর মতো জনপ্রিয় ফুটবলারের দেখা মেলেনি। খেলাধুলায় বাংলাদেশের প্রথম সুপারস্টার তিনিই।
বাংলাদেশের ক্লাবগুলোর সামর্থ্যরে কথা তাঁর অজানা নয়। তাঁর ক্যারিয়ারে বড় সময়টা কেটেছে আবাহনীতে। দেশের অন্যতম ধনী ক্লাব হিসেবেই আবাহনীর পরিচয়। তারা কি কখনো পেরেছে ইউরোপের পথে হাঁটতে? সম্ভব নয়। এত অর্থ পাবে কোথায়? সেখানে দেশের ফুটবলে অভিভাবক হয়ে এমন হাস্যকর কথা বলতেন কীভাবে? তিনি এও বলতেন, ‘বাংলাদেশের ফুটবল পেশাদার যুগে প্রবেশ করেছে। আমাদের চিন্তাভাবনা হতে হবে প্রফেশনাল।’ তিনি বলেছেন, সবকিছু হবে প্রফেশনাল। ২০০৭ সালে পেশাদার লিগের মাধ্যমেই তো বাংলাদেশে পেশাদার ফুটবলের আবির্ভাব। দেখতে দেখতে দেড় যুগ হতে চলল পেশাদারির বয়স। আর এর মধ্যে টানা ১৬ বছরই ফুটবলে অভিভাবক ছিলেন সালাউদ্দিন। এত দিন থেকেও তিনি কি এমন কোনো পেশাদার কর্ম করেছেন যা প্রশংসা করার মতো? বড় কথা বলেই শুধু চেয়ারে বসে ছিলেন। কথায় কথায় বলা হয়, বাংলাদেশের ফুটবলাররা পেশাদারির প-ও বোঝেন না। কর্মকর্তারা কি সবই বোঝেন বা জানেন? পেশাদারে পোক্ত হয়ে গেছেন কি? তারা ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব করেই দেশের ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা বাফুফের নির্বাচিত কর্মকর্তা। এত দিনে কী যে শিখেছেন তার নমুনা তো পাওয়া যাচ্ছে।
জনপ্রিয় ক্লাব ব্রাদার্স ইউনিয়নের এক কাণ্ডই বলে দেয় পেশাদারিতে বাংলাদেশ কতটুকু এগিয়েছে। ফিফা এবার ঘোষণা দিয়ে নিয়ম করেছে, নতুন মৌসুমে রেজিস্ট্রেশন করার আগে তাদের কাছে খেলোয়াড়দের নাম পাঠাতে হবে এবং তা বাধ্যতামূলক। দেশিবিদেশি খেলোয়াড় মিলিয়ে ৩৫ জনকে অন্তর্ভুক্ত করেছে ব্রাদার্স। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, তারা ২৯ খেলোয়াড়ের নাম ফিফায় পাঠালেও ছয়জনের নাম পাঠায়নি। সে কারণে ছয় ফুটবলার খেলতে পারবেন না। সেকেন্ড উইন্ডো এলে তখন খেলার অনুমতি পেতে পারেন।
আরও বড় ঘটনা ঘটিয়েছে ব্রাদার্সই। এবার তারা প্যারাগুয়ের এক ফুটবলারকে খেলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। খেলতে তো সেই দেশের ফুটবল ফেডারেশনের ছাড়পত্র লাগে। ব্রাদার্স নাকি প্যারাগুয়ের বদলে উরুগুয়ে ফুটবল ফেডারেশনের কাছে চিঠি পাঠায়। খেলোয়াড় প্যারাগুয়ের অথচ উরুগুয়ে ফেডারেশনের কাছে চিঠি! কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলেছেন, দুই দেশের নাম তো কাছাকাছি তাই এমন ভুল হতেই পারে। জানি না এ ঘটনা সত্যি কি না। যদি হয়ে থাকে তা শুধু ব্রাদার্স নয়, দেশের ফুটবলের জন্যও বড় লজ্জার। পেশাদার বাদই দিলাম। এত বড় ভুল করেন কীভাবে? আর ফিফার আইনই বা জানবেন না কেন? আরেক দল এফসির লাইসেন্স পেতে কাগজপত্র তৈরি করতে পারে না।
আসা যাক ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা বাফুফের প্রসঙ্গে। জাতীয় দল সামান্য প্রীতি ম্যাচ খেলার জন্য কখন ক্লাবের কাছ থেকে খেলোয়াড় চাইতে হবে তা তাদের জানা নেই। অযথা হইচই করবে। সত্যি বলতে কি, দেড় যুগে পেশাদার ফুটবলের কোনো জ্ঞানই অর্জন করতে পারেননি কর্মকর্তারা। জানেন না আর শেখার আগ্রহও নেই। শুধু ভাব দেখাবেন পেশাদারির। কর্মকর্তাদেরই যখন এ ক্ষেত্রে অজ্ঞ বলা হয়, তাহলে এর চিত্র তো করুণ হবেই। সাবেক প্রখ্যাত ফুটবলার দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ফুটবলে যতটুকু সম্ভাবনা ছিল তা-ও শেষ হয়ে গেল পেশাদার পেশাদার করে। আর কিছু না হোক আমাদের দেশে পেশাদারি মানায় না। একে তো অর্থ নেই, তারপর আবার এক্সপার্ট কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফুটবল বাঁচাতে আবারও ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ফিরে যাওয়া উচিত।’
সাবেক তারকা ফুটবলার শেখ মো. আসলাম আবার টুটুলের কথার সঙ্গে একমত নন। তিনি বলেন, ‘চাপাবাজি আর কাজ এক নয়। ফুটবল এখন পেশাদারির বাইরে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। নিয়মকানুন যদি এত দিনেও না জানে তাহলে আর ফেডারেশনের চেয়ারে বসে লাভ হলো কী। তাহলে কি এখন ফেডারেশন চালাতে বিদেশি কর্মকর্তাও ভাড়া করতে হবে?’