নিউইয়র্ক টাইমসে বিশ্বকাপের মাঝামাঝি পর্যায়ে একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল ক্রিকেট নিয়ে। সেখানে প্রতিবেদকের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) প্রধান নির্বাহী ডেভিড রিচার্ডসন ক্রিকেটের মূলমন্ত্রটা খুব জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন- 'এ বিগার, বেটার, গ্লোবাল গেম।' কিন্তু ক্রিকেট তার এগারতম বিশ্বকাপ শেষ করেও বৃহৎ পরিসরের ভালো কোনো বৈশ্বিক খেলা হয়ে উঠতে পারল কই!
বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলল একটা নতুন দল- নিউজিল্যান্ড। বেশ কিছু চমক জাগানিয়া পারফরম্যান্স পুলকিত করেছে ভক্তদের। যেমন মার্টিন গাপটিলের ২৩৭, ক্রিস গেইলের ২১৫ আর স্টিভেন ফিন এবং জেপি ডুমিনির হ্যাটট্রিক। আছে কুমার সাঙ্গাকারার টানা চারটি আর মাহমুদুল্লাহর টানা দুটি সেঞ্চুরি। ৪০০-ঊর্ধ্ব ইনিংস খেলে দর্শকদের মন ভরিয়েছে অস্ট্রেলিয়া (৪১৭/৬) এবং দক্ষিণ আফ্রিকা (৪১১/৪ ও ৪০৮/৫)। খুঁজলে হয়ত আরও কিছু পারফরম্যান্স পাওয়া যাবে যেগুলো ক্রিকেটকে বিনোদনদাতা হিসেবে স্বীকার করতে কিছুটা সহায়ক হবে। কিন্তু বিশ্বকাপের এমন আলোকিত মুহূর্তগুলোতেও যখন বিতর্কের ঝড় উঠে সংগঠকদের দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে, প্রশ্ন উঠে বিচারকদের 'বিচার' নিয়ে তখন 'ক্রিকেট' একটা খেলা হিসেবে তার পরিসরকে সংকুচিতই করে। এবারের বিশ্বকাপে অসংখ্য সফলতার প্রতিমূর্তিতে কলঙ্ক তিলক লাগিয়েছে এই আম্পায়ারিংই। যেমন বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ। পাকিস্তানের আলিম দার এবং ইংল্যান্ডের ইয়ান গোল্ড ও স্টিভ ডেভিস ক্রিকেটের গায়ে একটা স্পষ্ট ভেদ রেখা টেনেছিলেন সেদিন ; ১৯ মার্চ মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। তিন তিনটে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বিপক্ষে দিয়ে আম্পায়াররা মূলত ম্যাচটাকে 'ইলেভেন ভার্সেস ইলেভেনে'র পরিবর্তে 'ইলেভেন ভার্সেস ফরটিনে' পরিণত করেছিলেন। মাশরাফিদের প্রতি এ হেন আচরণ মেনে নিতে পারেনি বাংলাদেশ। মানতে পারেননি আইসিসি সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামাল। মাঠেই উন্মুক্ত মঞ্চে প্রতিবাদ জানালেন তিনি। এ অন্যায়, এ অবিচার। আমরা এ মানবো কেন! তার বিক্ষুব্ধ অভিমানী এ ভাষাটাকেই ব্যক্তিগত আঘাত হিসেবে নিলেন আইসিসি চেয়ারম্যান শ্রীনিবাসন। ভারতীয় আদালতে বেশ কয়েকদিন আগেই তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এখন তিনি খোদ ভারতীয়দের কাছেই উপেক্ষিত। শ্রীনিবাসন চাইলেন, আইসিসি সভাপতি মুস্তফা কামালকে আম্পায়ারিংয়ের (ভারতীয়দের!) বিপক্ষে প্রতিবাদ জানানোর দৃষ্টতার জন্য কিছুটা পর্যুদস্ত করে ভারতীয়দের কাছে হিরো হতে। কিন্তু হিতে বিপরীতই হলো। নিয়ম ভেঙে বিশ্বকাপের পুরস্কার দিতে গিয়ে তাকে দর্শকদের 'নিন্দা ঝড়ে'র মুখোমুখি হতে হলো। ভক্তরা খেলার প্রাণ। সমালোচকরা পথ প্রদর্শক। আর সংগঠকরা! ওরা যদি প্রদর্শকদের কথা না শোনে কারও কিচ্ছু করার নেই। দিন কয়েক আগে আইসিসিকে ফেসবুকে 'ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল' বলে বেশ প্রচারণা চালিয়েছে ভক্তরা। এর সত্য-মিথ্যাটা এবার খোলাসা করলেন শ্রীনিবাসন। তিনি নিজের ক্ষমতাবলে রাতারাতি একটা সাংবিধানিক নীতিকে বদলে দিলেন। কারও অনুমোদনের তোয়াক্কাও করলেন না। বিশ্বকাপ শিরোপা প্রেসিডেন্টের দেওয়ার চিরায়ত ধারাটাকে রুখে দিয়ে করলেন চরম স্বেচ্ছাচার। ক্রিকেট অনেক কিছুই দিয়েছে ভক্তদের। কখনো উৎসবমুখর করেছে। কখনো কাঁদিয়েছে। আবেগের উচ্ছ্বাসে কখনো কখনো পুরো একটা জাতিকে ভাসিয়েছে। এ খেলা হয়ত এক সময় ফুটবলের মতোই বৈশ্বিক খেলা হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু 'তিন মোড়ল' (মূলত এক মোড়ল) যেভাবে ক্রিকেটের স্বত্ব কিনে নিয়েছে, তাতে ক্রিকেটের ব্যাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা এখন আর দোষের কিছু নয়।
স্বার্থ চিন্তা আর রাজনীতির ভিড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো ক্রিকেট আর ক্রিকেটীয় আচরণ। ক্রিকেট মাঠে ক্রিকেটকে ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হলে সেদিন হয়ত দূরে নয় যেদিন 'ক্রিকেট' দর্শকদের মন থেকে নির্বাসনে যাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য!