কল সেন্টারের ভবিষ্যৎ
গ্রাহক পরিষেবা শিল্পে এআই কি মানুষের জায়গা নেবে? এ প্রশ্নটি যদি আপনি চ্যাটজিপিটি-কে করেন, তবে এটি একটি কূটনৈতিক উত্তর দেবে, যার সারাংশ হলো- ‘তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে।’ তবে মানুষ এতে মোটেও আশাবাদী নয়...
গ্রাহক পরিষেবা শিল্পে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই) বিপ্লবের ঢেউ তুলেছে। একদিকে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো দাবি করছে- এআই গ্রাহক অভিজ্ঞতা আরও উন্নত করবে, অন্যদিকে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এটি লাখো কল সেন্টার কর্মীর চাকরির জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। গত বছর টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (TCS)-এর প্রধান নির্বাহী কে কৃষ্ণনবাসন সতর্ক করে বলেন, ‘খুব শিগগিরই এআই এশিয়ার কল সেন্টারগুলোর জন্য ন্যূনতম প্রয়োজন তৈরি করবে।’ অন্যদিকে- গার্টনারের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টও বলছে, ২০২৯ সালের মধ্যে এআই ৮০% সাধারণ গ্রাহক পরিষেবা সমস্যার সমাধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে করতে সক্ষম হবে।
এআই এজেন্টদের উত্থান
বর্তমানে ‘এআই এজেন্ট’ নিয়ে প্রযুক্তি দুনিয়ায় তীব্র উত্তেজনা। এই নতুন প্রজন্মের সিস্টেম কেবল নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দেয় না, বরং স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিদ্ধান্তও নিতে পারে। তবে এখনো বাস্তব অভিজ্ঞতা মিশ্র। যেমন, যুক্তরাজ্যের পার্সেল ডেলিভারি কোম্পানি এভরির (Evri) চ্যাটবট এক গ্রাহকের ভুল দরজায় ডেলিভারির ছবি পাঠানোর পর কথোপকথনই বন্ধ করে দেয়। অপরদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী ডিপিডির (DPD) এআই চ্যাটবটকে বন্ধ করতে হয় কারণ সেটি ব্যবহারকারীদের গালাগাল শুরু করেছিল। এ ঘটনাগুলো ইঙ্গিত দেয়- এআইনির্ভর গ্রাহক পরিষেবার পথে ব্র্যান্ড-নিয়ন্ত্রণ ও সহানুভূতিশীল প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে পাওয়া এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রত্যাশা বনাম বাস্তবতা
গার্টনারের তথ্যমতে, বিশ্বের ৮৫% গ্রাহক পরিষেবা প্রতিষ্ঠান ইতমধ্যেই এআই চ্যাটবট নিয়ে কাজ করছে, তবে মাত্র ২০% প্রকল্পই প্রত্যাশা পূরণ করছে। বিশ্লেষক এমিলি পোটোস্কির মতে, ‘এআই কথোপকথনকে স্বাভাবিক করে তোলে, কিন্তু কখনো কখনো ভুল, বিভ্রান্তিকর বা সেকেলে তথ্য দেয়।’ তার মতে, সবক্ষেত্রে এআই উপযুক্ত নয়- বিশেষ করে প্যাকেজ ট্র্যাকিংয়ের মতো সীমিত প্রশ্নে রুল-বেসড সিস্টেমই কার্যকর।
ব্যয় ও মানব প্রতিস্থাপনের সমীকরণ
এআই মানুষের বিকল্প হতে পারবে কি না, তার কেন্দ্রে রয়েছে খরচের হিসাব। যদিও অনেকেই মনে করেন এআই খরচ কমাবে, পোটোস্কি বলেন, ‘এটি এক ব্যয়বহুল প্রযুক্তি।’ কার্যকরভাবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন প্রচুর প্রশিক্ষণ ডেটা এবং শক্তিশালী জ্ঞান ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা। সেলসফোর্সের ডিজিটাল অফিসার জো ইনজেরিলো জানান, এশিয়ার কল সেন্টারগুলোর সমৃদ্ধ ডকুমেন্টেশনই এখন এআই প্রশিক্ষণের জন্য মূল্যবান সম্পদ। তাদের এআই প্ল্যাটফর্ম ‘এজেন্টফোর্স’ ফর্মুলা ১, প্রুডেন্সিয়াল ও ওপেনটেবলের মতো ব্র্যান্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এআই-কে সহানুভূতি শেখানো
মানবীয় যোগাযোগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- সহানুভূতি। ইনজেরিলো বলেন, ‘একজন মানুষ হয়তো বলবে ‘শুনে খারাপ লাগল’, কিন্তু এআই কেবল একটি টিকিট খুলে দিত।’ ফলে সেলসফোর্স তাদের এআই এজেন্টকে আবেগ প্রকাশে প্রশিক্ষণ দেয়। এখন তাদের রিপোর্ট বলছে, ৯৪% গ্রাহক সুযোগ পেলে এআই এজেন্টের সঙ্গে কথোপকথন বেছে নিচ্ছেন, এবং এতে গ্রাহক সন্তুষ্টির হার বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে, তারা এআইর মাধ্যমে ১০০ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করেছে- যদিও কিছু কর্মীকে পুনর্বিন্যাস করতে হয়েছে। ফলাফল এটা ইঙ্গিত দেয় যে, এর কারণে ৪,০০০ কর্মসংস্থান কমে গেছে। তিনি বলেন, ‘সেই কর্মীদের বিশাল অংশ গ্রাহক পরিষেবার অন্যান্য ক্ষেত্রে পুনরায় নিয়োজিত হয়েছেন।’
ভবিষ্যৎ : মানুষের অধিকার
তবুও সবাই আশাবাদী নন। কিউস্টোরি (QStory)-এর প্রধান ফিওনা কোলম্যান বলেন, ‘কখনো কখনো আমি ডিজিটাল ইন্টারঅ্যাকশন চাই না, আমি একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ এই অনুভূতিই হয়তো ভবিষ্যতে আইন হয়ে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্রে ইতোমধ্যেই এআই ব্যবহারের স্বচ্ছতা ও মানব এজেন্টে স্থানান্তরের অধিকার সংক্রান্ত আইন প্রস্তাবিত হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও ২০২৮ সালের মধ্যে ‘একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলার অধিকার’ বাধ্যতামূলক করতে পারে। তা ছাড়া এআই যতই উন্নত হোক, মানুষের সহানুভূতি ও বোঝাপড়ার জায়গাটি এখনো প্রযুক্তি পুরোপুরি দখল করতে পারেনি। ফলে কল সেন্টারের ‘সমাপ্তি’ নয়- সম্ভবত এক নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে, যেখানে মানুষ ও মেশিন একসঙ্গে কাজ করবে, একে অপরকে সম্পূর্ণ করবে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি