মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অনাদরে পড়ে আছে সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

অনাদরে পড়ে আছে সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন

সিলেটের কানাইঘাটের মালিগ্রাম-বিষ্ণুপুরে ১৯ মুক্তিযোদ্ধার গণকবর। যাদের জীবন্ত মাটিচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশজুড়ে চালিয়েছে বীভৎস হত্যাযজ্ঞ। পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন সিলেটের অসংখ্য নারী-পুরুষ। গণহত্যার পর কোথাও লাশ মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, আবার কোথাও উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখা হয়েছে লাশের সারি। কোথাও কোথাও হত্যাকাণ্ডের পর স্থানীয় লোকজন লাশগুলোর সৎকার করেছেন। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর এই বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকতে থাকতে ইতিমধ্যে সিলেটের অনেক গণকবর ও বধ্যভূমি নিশ্চিহ্ন এবং দখল হয়ে গেছে। সিলেটের কয়েকটি গণকবর-

সালুটিকর : মুক্তিযুদ্ধকালীন সিলেটের সালুটিকর বিমানবন্দরের নিকটবর্তী মডেল স্কুলটিকে হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসররা বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্র  হিসেবে ব্যবহার করে। গোটা ৯ মাসই চলে এখানে তাদের নৃশংসতা। পাকিস্তানি পশুরা নারী-পুরুষের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালানোর পর তাদের হত্যা করত মডেল হাইস্কুল প্রাঙ্গণে। হত্যার পর এসব লাশ মাটিচাপা অথবা পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে ফেলে দিত। স্বাধীনতার পরপরই মডেল স্কুল ও তার আশপাশ বন-জঙ্গলে অসংখ্য কঙ্কাল পাওয়া গেছে। এ বধ্যভূমিটি সংরক্ষণে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

ইলাশকান্দি (সদর) : লাক্কাতুরা চা বাগানের অনতিদূরে ইলাশকান্দিতে ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল গণহত্যা চালানো হয়। এ বধ্যভূমিতে হত্যাযজ্ঞ চলে  দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত। দেশ স্বাধীনের পরও ইলাশকান্দি বধ্যভূমিতে ১৮ জন শহীদের লাশ গলে দীর্ঘদিন দুর্গন্ধ ছড়িয়েছিল। এখনো এ বধ্যভূমিতে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা শহীদ মিনার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

কালাগুল চা বাগান (লাক্কাতুরা) : ১৩ এপ্রিল সকালে পাকসেনারা আসে কালাগুল চা বাগানে। বস্তি থেকে শ্রমিকদের এনে দাঁড় করানো হয় দীর্ঘ লাইনে। তারপর ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষকে। শহীদ চা শ্রমিকদের লাশ পড়ে থাকে ওই স্থানেই। এ বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

মালনীছড়া চা বাগান : বাগানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক শওকত নাওয়াজ ও অন্য ৯ জনকে একই জায়গায় দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে পাকসেনারা। বাগানের স্টাফ কোয়ার্টারের কাছে রচিত হয় বধ্যভূমি।

খাদিমনগর শ্রমিক হত্যা : সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগর চা বাগানের শ্রমিকদের কাজ দেওয়ার কথা বলে এক স্থানে দাঁড় করিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাগান কর্তৃপক্ষ এই শহীদদের স্মরণে বাগানের প্রবেশপথে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। এখন অনেকটা অবহেলায় পড়ে আছে স্মৃতিসৌধটি।

স্টার চা বাগান : সিলেট শহর সংলগ্ন এই চা বাগানের মালিক ছিলেন রাজেন্দ্র লাল গুপ্ত। ’৭১ সালের ১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি মিলিটারিরা এ বাগানে প্রবেশ করে। তারা গুলি করে হত্যা করে রাজেন্দ্র লাল গুপ্তের পরিবারের লোকজন ও বাগানের শ্রমিকসহ ৩৮ জনকে। এই ৩৮ জন শহীদের স্মৃতিরক্ষার্থে স্বাধীনতার পর বাগান কর্তৃপক্ষ একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করলেও সরকারিভাবে শহীদদের স্মৃতিরক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

কাঁঠালতলা (বিয়ানীবাজার) : কাঁঠালতলায় শতাধিক কঙ্কাল আবিষ্কার করা হয় স্বাধীনতার পর। সেগুলো একটি গর্তে মাটিচাপা দিয়ে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানিয়েছিলেন জেনারেল ওসমানী। কিন্তু ৭৫-পরবর্তী সময়ে সেখানে নির্মিত হয়েছে বহুতল ভবন। আজ আর এই বধ্যভূমিটির কোনো চিহ্নও নেই।

সোনাতিকান্দি (দক্ষিণ সুরমা) : সোনাতিকান্দি বধ্যভূমি আজও রয়ে গেছে অজানা-অচেনা। মুক্তিযুদ্ধের ৪৪ বছর পরও ওই বধ্যভূমিটি সংরক্ষণে কোনো সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

তামাবিল (গোয়াইনঘাট) : গোয়াইনঘাট উপজেলার তামাবিলে পাকসেনাদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। ’৭১-এর মে মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এখানে অবস্থান করে পাকসেনারা। যুদ্ধ শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকঘাঁটিগুলো দখল করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হলেও সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের পর দেয়াল নির্মাণ করে গণকবরটি চিহ্নিত করা হলেও এখন এটি অনেকটা অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে।

সর্বশেষ খবর