১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজন আধুনিক ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম দেয়- এটি ছিল অস্থিরতার এক যুগ, যেখানে ফ্যাশনকে বাহ্যিক চাকচিক্যপূর্ণ বলে মনে করা হতো। তাই কিছুটা প্রতিহত হলেও বিচ্ছিন্ন না হয়ে স্টাইলিং তার নিজস্ব পথ ধরেছিল। বাংলা দুই ভাগে বিভক্ত হলো- পূর্ববঙ্গ (পরে যা পূর্ব পাকিস্তান হয়) এবং পশ্চিমবঙ্গ। এই বিভাজন সত্ত্বেও ‘ফ্যাশনের উন্মাদনা’ কোনো কিছুতেই থেমে থাকেনি। এটি এ অঞ্চলের প্রতিটি ঘরে ঢুকে পড়েছিল। ১৯৭০-এর দশকে বাংলাদেশের উত্থান ঘটে। একটি দেশ যা তার রূপে নতুন কিন্তু সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে বেশ সমৃদ্ধ; বাকি গল্পটি বলছি ফিচার আকারে...
১৯৪০-এর দশক : বিভাজন ও কবিতার যুগ
৪০-এর দশকের শুরুর দিকে, ব্রিটিশ ভারতে ফ্যাশন মূলত পশ্চিমা বিশ্ব দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল; চুলের স্টাইলে ফিঙ্গার ওয়েভস এবং পিন রোলস বেশ জনপ্রিয় ছিল। পশম ছিল ফ্যাশনের উচ্চ শিখরে এবং ঠাকুরবাড়ি বা নবাব বংশের উচ্চ শ্রেণির নারীরা আধুনিক ফিউশন লুকে সাজতেন। তারপর এলো মুক্তির উন্মাদনা এবং জাতীয়তাবাদী অনুভূতি আকাশচুম্বী হলো। মহাত্মার মতো নেতারা দেশকে স্বাবলম্বী করার জন্য সব নাগরিককে হাতে কাটা খাদি পরতে উৎসাহিত করলেন। সুতির এই কাপড়টি ‘ট্রেন্ড’ হয়ে উঠল। পুরুষ এবং মহিলা উভয়েই খাদি পরতেন- যা দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জন্য অনন্য পোশাক হয়ে ওঠে। আধুনিক স্টাইলের শাড়ি পরা, যেখানে নাভিতে একাধিক কুঁচি এবং আঁচল বাম দিকে রাখা হতো, তা আরও উপযুক্ত এবং মার্জিত বলে বিবেচিত হয়েছিল।
১৯৫০-এর দশক : অভ্যুত্থান, স্মৃতি ও মুক্তি
৫০-এর দশক ছিল এমন এক যুগ যখন অনেক বাহ্যিক সংঘাত দেখা গিয়েছিল। বাংলাদেশ তখনো পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল। কিন্তু এর অনন্য সংস্কৃতি, ফ্যাশন ধারণা এবং ঐতিহ্য নিয়ে সরগরম ছিল। এ অঞ্চলের নারীরা বলিউড অভিনেত্রী নার্গিসের স্টাইল অনুসরণ করতেন (হাই-নেক সিল্ক ব্লাউজ এবং খাঁটি শিফন শাড়ির সঙ্গে)। যদিও নার্গিস একজন ভারতীয় অভিনেত্রী ছিলেন। তাঁর কাজ এবং স্টাইলিং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় স্থানেই বেশ জনপ্রিয় ছিল। অভিনেত্রী সমাজের উচ্চ শ্রেণি ভিক্টোরিয়ান এবং মোগল স্টাইলের সংমিশ্রণে লেহেঙ্গা, এমব্রয়ডারি করা গাউন, লম্বা ফ্রিল্ড স্কার্ট পরতে পছন্দ করতেন- যা অভিজাত অনুষ্ঠানে দেখা যেত।
১৯৬০-এর দশক : সতেজ লুক, সিনেমার উত্থানর্ এই দশকটি সম্ভবত হেয়ারস্টাইলের ভিন্নতার জন্য সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়। সাধারণ কোঁকড়া চুল এবং ঢেউ খেলানো স্টাইলগুলো ‘বুফ্যান্ট’ লুক (ফোলানো চুলের স্টাইল) এবং লম্বা বিনুনি দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। নারীরা সরু দাঁতের চিরুনি দিয়ে চুলকে পেঁচিয়ে উঁচু গিঁট তৈরি করতেন, যা পরে ব্রাশ করে একটি মৌচাকের মতো আকার দেওয়া হতো। যখন পশ্চিমা বিশ্ব প্রথমবারের মতো মিনিস্কার্ট পরছিল, তখন বাঙালি নারীরা শিফন শাড়ির সঙ্গে স্লিভলেস ব্লাউজ এবং শরীর আঁকড়ে থাকা সালোয়ার-কামিজ পরছিলেন। শাড়ি পরার ধরনও ঐতিহ্যবাহী ডান থেকে বাম আঁচল পরিবর্তন করে অভিনেত্রী মমতাজের কাছ থেকে অনুকরণ করছিল। বড় অনুষঙ্গগুলো পাতলা বেল্টের হাতঘড়ি, ছোট কানের দুল এবং লকেটযুক্ত নেকলেস প্রতিস্থাপিত হয়েছিল।
১৯৭০-এর দশক : স্বাধীনতা ও বেল-বটমস
স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ সৃষ্টির পরেও, ৭০-এর দশক ছিল সদ্য স্বাধীন দেশটির ফ্যাশনের জন্য রঙিন দশক। রুনা লায়লা গায়িকা ও ববিতার মতো অভিনেত্রীরা সমাজের প্রধান ফ্যাশন আইকন ছিলেন। সমগ্র দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের তরুণীরা তাদের প্রতিভা এবং তার স্টাইলিং সেন্স অনুসরণ করতেন। রুনা লায়লার পাতলা ভ্রু এবং ববিতার উঁচু-বাঁধা চুল তখন থেকে একটি কাল্ট ফ্যাশন হয়ে ওঠে। ৭০-এর দশকে বৈশ্বিক ফ্যাশন সাইকেডেলিক প্রিন্ট, উজ্জ্বল রং, নেট, সাহসী ডিজাইনসহ চকচকে উপকরণগুলোর দিকে ঝুঁকেছিল এবং বাংলাদেশও এর প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল না। লম্বা অগোছালো চুল, পাতলা ভ্রু, বেল-বটম প্যান্ট, লুপ কানের দুল জনপ্রিয় ছিল এবং বাংলাদেশি নারীরা ট্রেন্ডিং স্টাইলগুলো পরছিলেন।
১৯৮০-এর দশক : স্বাধীনতা ও ফ্যাশন
এই দশকে বাংলাদেশি নারীরা নতুন অর্জিত স্বাধীনতাকে তার প্রকৃত অর্থে আলিঙ্গন করতে শুরু করেন এবং নিজেদের চেহারায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে শুরু করেন। যখন হলিউড এবং বলিউড উভয়ই মানুষকে ফ্যাশন সম্পর্কে সচেতন করছিল, তখন নারীরা কিছু গবেষণা করেন। বিভিন্ন রং, আকার এবং আকৃতির পোলকা ডটসের প্রতি ঝোঁক ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। হাল্টার নেক ব্লাউজ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং সামনের দিকে ফ্লিক করা পাফড-আপ ঢেউ খেলানো চুল হেয়ারস্টাইলিংয়ে একটি ‘নতুন জিনিস’ হয়ে দাঁড়ায়। কিছু নারী ভেলভেট জ্যাকেট এবং ঢিলেঢালা সালোয়ারের সঙ্গে কামিজও পরতেন- অনেকটা হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের মতো। বড় লুপ কানের দুল তখনো জনপ্রিয় ছিল। তবে এবার সেগুলো রূপা ও সোনার পরিবর্তে আরও উজ্জ্বল রঙে পরা হতো। এই দশকে ছেলে বেল বটম-এ অভ্যস্ত হয়। লম্বা চুল, মাঝে ফাটা বা পাশ ফাটা স্টাইল করে।
১৯৯০-এর দশক : মোগল প্রভাব ও বুটিক শপ
এই দশকে ফ্যাশনের দৃশ্যে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। নারীরা মোগল যুগের দিকে ফিরে যান এবং আনারকলি ও অত্যন্ত লম্বা কামিজ রাস্তায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাঙালি নারীরা তাদের চুলকে শক্ত করে বেঁধে রাখতেন এবং এক্সটেনশন ব্যবহার করে সেটিকে আরও সাজাতেন। এই দশকে বুটিক শপের উত্থান দেখা যায়, যা স্থানীয় বাজারে জায়গা করে নেয়।
২০০০-এর দশক : মিলেনিয়াল ও পরীক্ষা
এটি ছিল নতুন সহস্রাব্দের শুরু এবং ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে বিশ্ব একটি একক বৈশ্বিক সত্তায় রূপান্তরিত হচ্ছিল। মিলিনিয়াল দশকে ভোগবাদিতার ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটে এবং বাংলাদেশিরা পশ্চিমা লুক আরও বেশি করে গ্রহণ করতে থাকেন। জিন্স, স্লাকস, টপস, শার্ট দৈনন্দিন পোশাকের প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে নারীদের জন্য, যেখানে শাড়ি উৎসবের পোশাক হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। হেয়ারস্টাইলিং উন্মুক্ত ও অবাধ হয়ে ওঠে, কোনো নির্দিষ্ট রূপ নেয়নি। চুলের রং করা, পার্মানেন্ট স্ট্রেটেনিং বা কার্লিং এবং হাইলাইটস ব্যাপক জনপ্রিয় হয়।
২০১০ সাল থেকে : ফিউশনাল পোশাক
বিশুদ্ধ পশ্চিমা প্রভাবে- বাংলাদেশিরা ফিউশন-এর প্রতি আরও আগ্রহী হয়ে ওঠে; যা ছিল পূর্ব ও পশ্চিমের এক নিখুঁত মিশ্রণ। ক্যাজুয়াল কুর্তি, প্যান্ট, ধুতি ইত্যাদি ছিল মৌলিক পোশাক সামগ্রী। শাড়ি আবারও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে এবার ব্লাউজগুলো বিভিন্ন উপায়ে পরিবর্তিত হয়ে ফিউশন তৈরি করে। জ্যাকেট ব্লাউজ, নেট ব্লাউজ, হাল্টার নেক শাড়ির মূল আকর্ষণ হয়ে ওঠে। হেয়ারস্টাইলে বড় পরিবর্তন আসেনি। তবে হাইলাইটস আরও পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠে; চুল স্ট্রেটেনিং-কার্লিং পদ্ধতিগুলো অস্থায়ী এবং সুস্থতা-কেন্দ্রিক হয়। ছেলেদের ফ্যাশনে স্ট্রিট-ওয়্যার, জগার প্যান্ট, ওভারসাইজ টি-শার্ট, কার্গো প্যান্ট, কুর্তা-পাজামা লুক ফিরে আসে।