রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বিশ্বকাপে আলোচিত পেনাল্টি মিস

বিশ্বকাপে আলোচিত পেনাল্টি মিস

গোলের খেলা ফুটবল। উত্তেজনার এই খেলায় বুকে কাঁপুনি বাড়ায় পেনাল্টি-টাইব্রেকার। পেনাল্টি-টাইব্রেকার শুটআউটে কপাল পুড়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়েছে বহু দল। সেরা তারকারাও পেনাল্টি মিস করেছেন, ডুবিয়েছেন দলকে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে আলোচিত পেনাল্টি মিস নিয়ে আজকের রকমারি-

 

১৯৯৪

রবার্তো ব্যাজিওর সেই মিস কেউ ভুলবে না

বিশ্বজুড়ে বিশ্বকাপ আসর শুরুর পর থেকে তিনটি বিশ্বকাপ (১৯৩৪, ১৯৩৮, ১৯৮২) জয়ের পর ফুটবলের মহামঞ্চে অন্যতম ফেবারিটের তালিকায় চলে আসে ইতালি। এরপর কত আসর গেল! আরও একটি বিশ্বকাপের পিপাসায় ধুঁকতে থাকা ইতালি ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ আসরে পৌঁছে যায় ফাইনালে। সেবার তাদের প্রতিপক্ষ ছিল বর্তমানের পাঁচবারের বিশ্বকাপ জয়ী ব্রাজিল। আর ইতালির জয়ের অন্যতম কান্ডারি ছিলেন রবার্তো ব্যাজিও। সেবার ইতালিকে তিনিই টেনে নিয়ে এসেছিলেন ফাইনালে। গ্রুপ পর্বে গোল পাননি, সেবার ইতালি তৃতীয় হয়ে কোনোক্রমে দ্বিতীয় পর্বে উঠল। তবে নকআউট পর্বে ব্যাজিও-ম্যাজিকেই ফাইনালের দেখা পায় ইতালি। অতিরিক্ত সাবধানী খেলায় ফাইনালে নির্ধারিত এবং অতিরিক্ত সময়ে ০-০ গোলে ড্র করে ইতালি-ব্রাজিল। এর পরই ম্যাচটা চলে গেল টাইব্রেকারে। কিন্তু সেবার ভাগ্য সহায় হয়নি ইতালির। বারেসি আর মাসারো পেনাল্টি মিস করার পর ব্যাজিওর সামনে সমীকরণ কঠিন হয়ে যায়। ফলে এমন ম্যাচে টিকে থাকতে ব্যাজিওকে গোল করতেই হবে। অন্যদিকে ব্রাজিলকেও শেষ পেনাল্টিটা মিস করতে হবে। কিন্তু বারেসি আর মাসারোর মতো ব্যাজিও বলটা বাইরে পাঠিয়ে দেন। মিস হয়ে যায় পেনাল্টি। আর ব্রাজিলের শেষ পেনাল্টি শট মারার প্রয়োজনই হয়নি। আগের বছরের ব্যালন ডি অর জয়ী এবং সেই বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড়ের কাছ থেকে এরকম মুহূর্তে এমন মিস হয়তো কেউই আশা করেনি। ১৯৯০ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে এবং ১৯৯৮ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে টাইব্রেকারে গোল করার পরও ইতালি হেরেছিল।

 

২০২২

ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া

কাতার বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। মুখোমুখি ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া। এর মধ্য দিয়ে আরও একবার ব্রাজিলের বিরুদ্ধে পাহাড় হয়ে দাঁড়ালেন ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক লিভাকোভিচ। ১২০ মিনিটের খেলায় তাকে একবারই মাত্র পরাস্ত করতে পারলেন নেইমাররা। আর তাতে কোয়ার্টার ফাইনালে নির্ধারিত এবং অতিরিক্ত সময় মিলিয়ে ব্রাজিলের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে ক্রোয়েশিয়া। ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ গড়ায় পেনাল্টি শুটআউটে। এরপর টাইব্রেকারে ৪-২ গোলের জয়ে ব্রাজিলকে বিদায় করে সেমিফাইনালে উঠেছে ক্রোয়েশিয়া। কোয়ার্টার ফাইনালে ওই ম্যাচে ১১টি সেভ করেন ক্রোয়েশিয়ার ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার  এই গোলকিপার। নির্ধারিত এবং অতিরিক্ত সময় শেষে ব্রাজিলের বিপক্ষে টাইব্রেকারে রদ্রিগোর শট ঠেকান লিভাকোভিচ। তারপর একে একে শট নিলেন কাসেমিরো, পেদ্রো, মার্কিনিওস। ওদিকে ক্রোয়েশিয়ার চারজনই গোল করলেন। কিন্তু রদ্রিগোর পর মার্কিনিওসের মিস সর্বনাশ করে দেয় ব্রাজিলের। ৪-২ ব্যবধানে টাইব্রেকারে জিতে ক্রোয়েশিয়া উঠে যায় বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে।  এর আগেও শেষ ষোলোর খেলায় জাপানের বিপক্ষে টাইব্রেকারে তিনটি শট আটকে দিয়েছিলেন। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে সুবাসিচ থাকায় রিজার্ভ বেঞ্চে ছিলেন লিভাকোভিচ। বিশ্বকাপের পর সুবাসিচ জাতীয় দল ছেড়ে দেওয়ায় পোস্টের নিচে নিয়মিত হন লিভাকোভিচ।

 

২০০৬

ল্যাম্পার্ড, জেরার্ড গোল করতে পারেননি

২০০৬ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ জার্মানি। সেবারের কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় ইউরোপের দুই দল পর্তুগাল ও ইংল্যান্ড। নির্ধারিত এবং অতিরিক্ত সময়ে দুই দলই গোল করতে ব্যর্থ হয়। এরপর ম্যাচ গড়ায় পেনাল্টি শুটআউটে। একঝাঁক তারকা সমৃদ্ধ দল ইংল্যান্ড পেনাল্টিতে ভালো ফলাফল করবে বলেই আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু আশার গুড়ে বালি। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ল্যাম্পার্ড ও জেরার্ডের মতো তারকারা গোল করতে ব্যর্থ হওয়ার প্রথম চারটি পেনাল্টির তিনটিই মিস করে বসে ইংল্যান্ড। অন্যদিকে তরুণ তারকা সমৃদ্ধ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল পাঁচটি পেনাল্টির দুটি মিস করলেও ৩-১ এ জয় পায়।

 

২০১৪

পাঁচটির মধ্যে তিনটি পেনাল্টি মিস চিলির

২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপ। ঘরের মাঠে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে হেরে সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে পড়ে স্বাগতিক ব্রাজিল। সেবার বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় ব্রাজিল মুখোমুখি হয় চিলির। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে খেলাটি ১-১ গোলে ড্র হলে ম্যাচ গড়ায় পেনাল্টি শুটআউটে। পেনাল্টিতে ব্রাজিলের নেইমার, লুইজ ও মার্সেলো গোল করতে পারলেও গোল করতে ব্যর্থ হন উইলিয়ান ও হাল্ক। অন্যদিকে চিলির পাঁচটি পেনাল্টির মধ্যে তিনটিই রুখে দেন ব্রাজিলের গোলকিপার জুলিও সিজার। ফলে ম্যাচটি ৩-২ এ জিতে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে ব্রাজিল।

 

১৯৮৬

তারকাদের পেনাল্টি মিসে বাদ পড়ে ব্রাজিল

১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল মুখোমুখি হয়েছিল ফ্রান্সের। নির্ধারিত সময়ে ব্রাজিলের মিশেল প্লাতিনি যে ম্যাচটাতে টাইব্রেকার মিস করেছিলেন, সেই ম্যাচটা হয়তো টাইব্রেকার পর্যন্ত যেতই না। সেই ম্যাচে জিকো প্রথম একাদশে ছিলেন না। ১-১ গোলে সমতায় থাকা ম্যাচে ব্রাজিলের জয়ে খানিকটা অনুপ্রেরণা প্রয়োজন ছিল। জিকো মাঠে নামার পর ব্রাজিলিয়ানরা সেটা পেল। জিকো একটা পেনাল্টি আদায় করে নিলেন, কিন্তু তার শট আটকে দিলেন ফ্রান্সের গোলরক্ষক। ম্যাচটা চলে গেল টাইব্রেকারে। ব্রাজিল ৪-৩ গোলে ফ্রান্সের কাছে হেরে বিদায় নেয়। পেনাল্টি মিস করেন ব্রাজিলের সেরা তারকা সক্রেটিস।

 

১৯৯০

ম্যারাডোনার পেনাল্টি মিসের পরও জয় পায় আর্জেন্টিনা

ফুটবলের মহামঞ্চে মহাতারকা দিয়েগো ম্যারাডোনা। যাকে বিশ্বের অসংখ্য ফুটবলপ্রেমী ফুটবলের ঈশ্বর বলেন। যার হাত ধরে আর্জেন্টিনা পেয়েছিল ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ। সেই ম্যারাডোনাও পেনাল্টি মিস করেছেন ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে যুগোশ্লোভাকিয়ার সঙ্গে। ফ্লোরেন্সের কমনওয়েলথ স্টেডিয়ামে নির্ধারিত সময়ে দুই দলই গোল করতে ব্যর্থ হওয়ায় ম্যাচ গড়ায় শুটআউটে। ধারণা করা হচ্ছিল- ম্যারাডোনার নেতৃত্বে খুব সহজেই পেনাল্টি শুটআউটে ম্যাচ জিতে যাবে আর্জেন্টিনা। কিন্তু সেই ম্যাচে খুব বাজেভাবে পেনাল্টি মিস করেন ফুটবলের কিংবদন্তি। শেষে আর্জেন্টিনার গোলকিপার সার্জিও টানা দুটি পেনাল্টি সেভ করলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে আর্জেন্টিনা। সেই সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনালে ৩-২ গোলে জয় পায় আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টাইনরা জিতে সেমিতে চলে যাওয়ায় ম্যারাডোনার পেনাল্টি থেকে গোল করতে না পারার ঘটনাটি সেভাবে আলোচিত হয়নি। আলোড়ন তোলেনি। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য হলো, ম্যারাডোনাও পেনাল্টি মিস করেছেন। তার জাদুর পা থেকে কত অনিন্দ্য সুন্দর গোল বেরিয়ে এসেছে, অথচ ওই ম্যাচে পেনাল্টি শুটআউটে গোল করতে পারেননি ম্যারাডোনা। তার নেওয়া দলের তৃতীয় শটটি ডান দিকে ঝাঁপিয়ে রুখে দেন যুগোশ্লোভাকিয়ার গোলকিপার তোমিশ্লাভ আইভোকিচ। আর্জেন্টিনা জিতে যাওয়ায় ম্যারাডোনার পেনাল্টি মিসের কথা অনেকেরই মনে নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, ওই ম্যাচে আর্জেন্টিনা হারলে ফুটবলের মহানায়কের গায়েও কালো দাগ লেগে যেত। কে জানে, তিনিও হয়তো খলনায়ক বনে যেতেন!

 

২০১৮

ক্রোয়েশিয়া ডেনমার্ক

২০১৮ সালের বিশ্বকাপ। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। কে ভেবেছিল, যে ম্যাচে ৫৮ সেকেন্ডেই গোল হয়, সেই ম্যাচ গড়াবে পেনাল্টি শুটআউটে! বিশ্বকাপে শেষ ষোলোর ম্যাচে ক্রোয়েশিয়া ও ডেনমার্ক পরস্পরের মুখোমুখি হয়। ক্রোয়েশিয়া পাঁচটির শুটআউটের দুটি মিস করে। অন্যদিকে ডেনমার্ক ক্রোয়েশিয়ার থেকে একটি বেশি পেনাল্টি মিস করে আসর থেকে ছিটকে যায়। ম্যাচে ক্রোয়েশিয়া ভালো পারফরম্যান্স না করলেও দীর্ঘ ২০ বছরের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বকাপের শেষ আটে উঠেছিল তারা।

 

২০০২

স্পেন আয়ারল্যান্ড যেন পেনাল্টি মিসের মহড়া

২০০২ সালের বিশ্বকাপ। আয়োজক দেশ এশিয়ার কোরিয়া-জাপান। সেই আসরের শেষ ষোলোর ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ইউরোপের দুই  দেশ স্পেন ও আয়ারল্যান্ড। এ ম্যাচটিতে দুই দল যেন পাল্লা দিয়ে পেনাল্টি মিস করেছিল। প্রথমে আয়ারল্যান্ড নির্ধারিত সময়ে একটি পেনাল্টি মিস করলেও ১-১ গোলের সমতায় খেলা গড়ায় পেনাল্টি শুটআউটে। আর এই পেনাল্টি শুটআউটে টানা তিনটি পেনাল্টি মিস করে আয়ারল্যান্ড। অন্যদিকে আয়ারল্যান্ডের থেকে একটি কম পেনাল্টি মিস করে ৩-২ এ ম্যাচটি জিতে নেয় স্পেন।

 

১৯৯৪

বুলগেরিয়া মেক্সিকো

১৯৯৪ বিশ্বকাপে মেক্সিকোর ‘সর্বনাশ’ হয়েছিল বুলগেরিয়ার বিপক্ষে টাইব্রেকারে। যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপের শেষ ষোলোর ম্যাচে মুখোমুখি হয় বুলগেরিয়া ও মেক্সিকো। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ের ম্যাচটি ১-১ গোলে ড্র হলে পেনাল্টি শুটআউটে রীতিমতো গোল মিসের মহড়া করে মেক্সিকো। বুলগেরিয়া প্রথম চারটি পেনাল্টির মাত্র একটি মিস করলেও মেক্সিকো ভক্তদের হতাশ করে প্রথম চারটি পেনাল্টির তিনটিই মিস করে বসে। যার ফলে ৩-১ ব্যবধানে ম্যাচটি জিতে নেয় বুলগেরিয়া।

 

২০০৬

সুইজারল্যান্ডের লজ্জাজনক রেকর্ড

২০০৬ সালের বিশ্বকাপে লজ্জাজনক রেকর্ড গড়ে সুইজারল্যান্ড। সেবার বিশ্বকাপের শেষ ষোলোর ম্যাচে মুখোমুখি হয় ইউরোপের দুই দেশ ইউক্রেন-সুইজারল্যান্ড। নির্ধারিত সময় ও অতিরিক্ত সময়ে ম্যাচটি গোলশূন্য ড্র হলে ম্যাচ গড়ায় পেনাল্টি শুটআউটে। আর তাতে প্রথম তিনটি পেনাল্টির তিনটিই মিস করে বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে পেনাল্টি শুটআউটে কোনো গোল না করার রেকর্ড গড়ে ম্যাচটি হেরে যায় সুইজারল্যান্ড। কাতার বিশ্বকাপেও টানা তিন পেনাল্টি মিস করে ম্যাচ হেরে সুইজারল্যান্ডের পাশে নাম লেখায় স্পেন।

সর্বশেষ খবর