শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

কলকাতার প্রথম ছোঁয়া

শাকুর মজিদ

কলকাতার প্রথম ছোঁয়া

কলকাতাকে আমি প্রথম দেখি ১৯৯০ তে। আমার তখন পঁচিশ, কলকাতার তিনশ'। ইংরেজ আমলে ভারতবর্ষের রাজধানী থাকা এ শহরটি সে বছর তার তিনশ' বছর পূর্তি করেছিল বলে বেশ বড় আন্তর্জাতিক স্থাপত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছিল এই শহরের প্রশাসন। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস আর তার ওয়েস্ট বেঙ্গল চ্যাপ্টার এর আয়োজক। ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদের ছাত্র-শিক্ষক মিলে যে টিম হয়েছিল তার সদস্য হিসেবে আমারও তখন অন্তর্ভুক্তি ছিল। সে আরও প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। আমি তখন থার্ডইয়ারে পড়ি।

১৯৯০ থেকে ২০১৪, এ সময়ের মধ্যে গড়ে অন্তত বছরে একবার যাওয়া হয়েছে কলকাতায়। দেশের বাইরে একক কোনো শহর হিসেবে এই কলকাতায়ই আমার সবচেয়ে বেশি যাওয়া। কলকাতা তাই আমার বিদেশি শহরও মনে হয় না, আবার নিজের শহরও না। তারপরও এক ধরনের ভালোলাগা থেকেই আমি সুযোগ পেলেই কলকাতা ঘুরে আসি।

কলাকাতা আমাকে প্রথমে কে চিনিয়েছিল তা খুব ভালো করে বলতে পারব না। দেশ পত্রিকার কল্যাণে কলকাতা প্রথম জানি আমি। আরেকটু গুছিয়ে বললে, সুনীল আর শংকরের উপন্যাস আমাকে কলকাতা চেনায়।

আশির দশকে আমি 'আউট বই'য়ের পাঠক হই। প্রথম যে কয়টা বই পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম সেগুলো ছিল শংকরের লেখা। 'কত অজানারে', 'যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ', 'চৌরঙ্গী'- এগুলোর কথা মনে ছিল। শংকরের কাছ থেকেই আমার 'চৌরঙ্গী' নামটি জানা। কলকাতায় প্রথমবার এসে দেখি, সেই চৌরঙ্গী। সেই গ্রান্ড হোটেল। এই গ্রান্ড হোটেলে কাজ করতেন 'শংকর'। জনসংযোগ বিভাগে। এই হোটেলের কত অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছেন সেই বইগুলোতে। কলকাতা এসে আমি এই লেখকদের দেখার জন্য অস্থির হয়ে যাই।

দ্বিতীয় দিনের সেমিনার চলছে তাজ হোটেলের বলরুমে। সেখান থেকে কায়দা করে একটা ফোন করার ব্যবস্থা হয়ে যায় আমার। 'কায়দা' বলছি এ কারণে যে, ওই ইভেন্ট কভার করতে আসা এক ফটোজার্নালিস্ট আমাকে খাতির করেন। তিনি 'আনন্দবাজার' গ্রুপের ফটোজার্নালিস্ট। টেলিগ্রাফের হয়ে ছবি তুলতে এসেছেন এখানে। সেমিনারে আসা আর্কিটেক্টরা কেউ তাকে তেমন পাত্তা দেয় না। আমি দেই। পাশে গিয়ে বসে গায়ে পড়ে কথা বলি। আমার সঙ্গে ১০ মিনিটের মাথায় তার ভাব হয়ে যায়। ভাবের কারণ আমার ক্যামেরা। তিনি যে মডেলের ক্যামেরা ব্যবহার করছেন, আমারটাও তাই। তার প্রথমে ধারণা হয়েছিল- সম্ভবত বাংলাদেশ দলের অফিসিয়াল ফটোগ্রাফার হিসেবে আমি এসেছি এখানে। আসলে সেটা যখন নয় এবং আমি যখন স্থাপত্যের ছাত্র, আবার সম্মেলনের ডেলিগেট, আমাকে কিঞ্চিৎ খাতির করেন তিনি এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় কী করে কাউকে ফোনে পেতে হয় বর্ণনা করে, ব্যবস্থা করে দেন।

দি ডেইলি টেলিগ্রাফের ফটোজার্নালিস্ট আমার পাশে দাঁড়ানো। হোটেল রিসিপশনের পাশে থাকা ইন্টারকম ফোন থেকে আমি অপারেটরকে বলি, আমাকে যেন আনন্দবাজারে ফোন করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়।

ফটোজার্নালিস্ট আমাকে জিজ্ঞাসা করেন সুনীলদার সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে তো?

আমি জবাব দেই, না। আমার ফোন কানে লাগানো। আমি অপেক্ষা করি অপারেটরের কথা শুনতে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার কী হন? আত্দীয়? আত্দীয় তো বটেই। আত্দীয় না হোক পরিচিত তো বলতেই হবে। বিশ্বাস না করলে আমার ভিসা ফরম দেখে নিতে পারে যে কেউ। আল্লাহ না করুক, এই কলকাতায় এসে যদি আমার কিছু হয়ে যায়, কেউ যদি আমার কোনো খোঁজ না পায়, যদি একজন মাত্র মানুষের কাছে আমার খোঁজ নেওয়ার অধিকার থাকে ভারত সরকারের, তিনি হলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

ঘটনাটা ঘটে ভারত দূতাবাস অফিসে। পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছি, ছবি নিয়েছি, পাসপোর্টে ডলারের এনডোসমেন্ট করিয়েছি ৫০ টাকা খরচ করে। ধানমন্ডির দুই নম্বর সড়কের এই অফিসে অনেক দালাল আছে। একশ টাকা দিলে সব করে দেয়। পরদিন ভিসা। একশ টাকা খরচ না করতে চাইলে নিজে লাইনে দাঁড়াও, ফরম কেন, ফিলাপ করে জমা দাও। রসিদ নাও, আবার কাল এসে লাইন ধরে রসিদ দেখিয়ে পাসপোর্ট-ভিসা ফেরত নাও।

একশ টাকার অনেক দাম আমার কাছে। আমি নিজে ফরম ফিলাপ করতে গিয়ে দেখি, কলকাতার কোনো পরিচিত লোকের নাম-ঠিকানা দিতে হবে।

আমি তিন সেকেন্ড চিন্তা করলাম। যে কনফারেন্সে যাচ্ছি, তার ঠিকানা সবাই দিয়েছে। কিন্তু আমি তো সেসব নিয়ে আসিনি। এখন কী করা?

আমি চিনি শংকর আর সুনীলকে। শংকরের ঠিকানা জানি না। সুনীলেরটা জানি। আনন্দবাজারের ঠিকানা আমার মুখস্থ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম লিখে দেশ পত্রিকার ঠিকানা বসিয়ে দেই আমি। আমার ভিসা হয়ে যায়।

এবার মনে ভাবলাম, যার নাম বিক্রি করে ভিসা নিয়েছি, তার সঙ্গে একটু কথাই না হয় বলি, দেখা করি। দেখা না করুক, যেতে তো আর সমস্যা নেই!

আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন আনন্দবাজার গ্রুপের ফটোজার্নালিস্ট। আমি ইন্টারকম কানে লাগিয়ে অপেক্ষা করছি টেলিফোন অপারেটরের। মিনিট দুয়েক আমাকে অপেক্ষায় রেখে এক সময় অপারেটর জানায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আজ অফিসে আসেননি। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি, তাহলে শীর্ষেন্দুকে দেখেন।

ওপাশে ফোন ধরেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। এপাশে আমি, পঁচিশের শাকুর মজিদ।

হ্যালো, নমস্কার।

'নমস্কার দাদা, আমি কী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলছি?'

'জি। বলুন।'

'দাদা, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, আর্কিটেকচারের স্টুডেন্ট। আপনার লেখা পড়েছি। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।'

'কখন আসতে চান?'

'আপনি বললে এখনই রওয়ানা দিতে পারি।'

'এখন ঠিক কোথায় আছেন আপনি?'

'তাজ বেঙ্গল'।

এরপর তাজ বেঙ্গল থেকে কী করে কোন বাস-ট্রাম ধরে আনন্দবাজারে আসতে হবে, বাস থেকে নেমে কতটুকু হাঁটতে হবে, গেটে কী কথা বলতে হবে, তিনি আমাকে বুঝিয়ে দেন।

আমি বলি, 'দাদা, আমি ট্যাক্সি নিয়ে আসছি।'

৬-৭ টাকা ট্যাক্সি ভাড়ায় আমি চলে আসি আনন্দবাজারের দালানের নিচে। বেশ পুলকও অনুভব করি। শীর্ষেন্দু কাউকে বলে রেখেছিলেন মনে হলো, গেটে নাম-পরিচয় দেওয়ার পর কে একজন তেতলায় একটা ছোট্ট ঘরে আমাকে নিয়ে গেল। এখানে বসে আছেন স্বয়ং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।

শীর্ষেন্দুর তেমন কোনো উপন্যাস আমার তখনো পড়া হয়নি। 'দেশ'এ ধারাবাহিক বেরিয়েছিল 'দূরবীন', সেটার দুটো পর্ব পড়েছিলাম। কথা বললাম তা-ই নিয়ে। টের পেলাম, কোনো লেখকের লেখা কেউ পড়েছেন এবং এ বিষয়ে কথা বলতে এসেছে, এমন বিষয় লেখকরা, সে যদি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও হন, বেশ পছন্দ করেন। আমাকে চা খাওয়ানো হলো, সিঙ্গারা খাওয়ানো হলো। আমি আনন্দ পাবলিশার্সের বই কোথা থেকে কিনব, কলেজ স্ট্রিটের কোন দোকানে গিয়ে কোন কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে আমাকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ ছাড়ে বই দেওয়া হবে, সে সবের আলাপ হলো।

বেরিয়ে যাওয়ার সময় মনে হলো, এ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সঙ্গে দেখা করলে খারাপ হয় না। আমার মনের কথা বললাম শীর্ষেন্দুকে। তিনি পাঠিয়ে দেন সাগরময় ঘোষের রুমে।

ছোট্ট একটা কামরা। আলো নেই বললেই চলে। পাখা ঘুরছে ঘটঘট করে। চারদিকে বইয়ের স্তূপ।

একটা কাঠের হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে আছেন প্রায় আশির কাছাকাছি বয়সের এক প্রবীণ। গায়ের রং কালচে, নাদুসনুদুস গড়ন, চোখে চশমা।

সাগরময় ঘোষ সম্পর্কে আমি বেশি কিছু জানি না। শুধু এটুকু যে, তিনি রবীন্দ্রনাথের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছেন।

আমি কথা শুরু করি রবীন্দ্রনাথ দিয়ে। বলি, তাকে কি আপনার মনে আছে? সাগরময় ঘোষ হাসলেন একটু। বললেন, 'দেশ' পত্রিকায় যোগ দিয়ে প্রথম যে এসাইনমেন্টটি করেছিলাম তা ছিল কবিগুরুর কাছ থেকে একটা কবিতা আর গল্প নেওয়া। সেটা কবিগুরুর মৃত্যুর কয়েক মাস আগে মাত্র। কথা প্রসঙ্গে বলেন, স্বদেশি আন্দোলন করার জন্য একবার জেলে গিয়েছিলাম। সেই জেলখানায় পরিচয় হয় আনন্দবাজারের সম্পাদকের সঙ্গে। তিনিও জেলে। আমার চাকরি হয়ে যায় জেলখানায়। আমাকে তিনটা অপশন দিয়েছিলেন তিনি। আমি নিলাম 'দেশ' পত্রিকায় চাকরির কাজ। সেই থেকে আছি। দেশ পত্রিকায় আমার চাকরির বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে। তবে সম্পাদকের দায়িত্বে আছি এই সেদিন ১৯৭৬ থেকে, ১৪ বছর হলো।

কথা বলতে বলতেই জানি, তিনি আসলে আমাদের বাংলাদেশেরই মানুষ। তার জন্ম আমাদের কুমিল্লায়। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে তার তেমন যোগাযোগ নেই। এবার আমি গলার স্বর নরম করে তার সম্পর্কে জানা কিছু অভিযোগের কথা বললাম।

আমি জানতে চাইলাম, মুসলমান লেখকদের নাম কেন আপনারা বিকৃত করে ছাপেন? যে লেখক আপনাদের কাছে লেখা পাঠান, তিনি তো তার নামটি নিজেই লিখে দেন। আপনারা ছাপার সময় তার নাম বদলান কেন?

থতমত খেয়ে যান সাগরময় ঘোষ। বলেন, এটা একেবারেই অনিচ্ছাকৃত। কখনো ইচ্ছা করে করেন না। কখনো কখনো এমন অভিযোগ তিনি পান বলেও জানান। বলেন, আরবি-ফার্সি নাম বাংলায় অনেকে অনেকভাবে লেখে, কোনটা যে সঠিক নাম আমরাও অনেক সময় বুঝতে পারি না।

জানি, হিন্দি নামকে তর্জমা করে কলকাতার কাগজে বাংলা করে। মিনাকষী কে মিনাক্ষী, আমিতাভ কে অমিতাভ, দিকষিত কে দিক্ষীত তারা করেন, তাই বলে শামসুরের সঙ্গের 'রাহমান'কে 'রহমান' কেন করবেন? ওটা শামসুরের নিজস্ব।

সাগরময় ঘোষ অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। আমার কাছে তার অজ্ঞতার কথা বলাতে আমি বিষয়টি চেপে যাই। কিন্তু তাকে ছাড়ি না। বলি, রবীন্দ্রনাথ যতটা যেভাবে আছেন নজরুল কিন্তু সেই অর্থে কোনোভাবেই 'দেশ'এ নেই। এর কারণ কী, নজরুল নামটি মুসলমান আর তিনি বাংলাদেশে চলে গিয়েছিলেন? তিনিও তো আপনাদের বর্ধমানের লেখক।

হাসলেন সাগরময় ঘোষ। বোঝাতে চাইলেন যে, তিনি রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলকে তাদের প্রত্যেকের অবস্থান অনুযায়ী পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেন। নজরুলকে নিয়ে তার বিন্দুমাত্র অসম্মান নেই। নজরুল যে অনেক বড় কবি ছিলেন, গীতিকার ছিলেন সেটাও বলেন।

আমি লক্ষ্য করি, এই প্রজ্ঞাবান সম্পাদক আমার অতি আক্রমণাত্দক কোনো কথায়ই বিন্দুমাত্র অসন্তোষ হচ্ছেন না। বরং হাসিমুখে সব কথার জবাব দিচ্ছেন।

অনেকক্ষণ বসা হলো তার ঘরে। এবার উঠে আসার পালা।

তার কামরা থেকে বেরিয়ে চলে আসব, এমন সময় আরেকটা খুপরির দরজায় লেখা দেখি, দিব্যেন্দু পালিত। তার বই পড়েছি আমি। খুব বেশি নাগরিক জীবন নিয়ে লেখেন।

তেমন কোনো ভদ্রতা না করেই অনেকটা রিস্ক নিয়ে ঢুকে পড়ি দিব্যেন্দু পালিতের কামরায়। আধা মিনিটের মধ্যে বলে ফেলি কেন এসে পড়েছি তার ঘরে। দেখলাম, তিনিও অনেক সহজ। আমাকে বসতে বলেন। তার গদ্য কাঠামো নিয়ে কথা বলি। কেমন করে একটা উপন্যাসের চিন্তা মাথায় আসে, একটা চরিত্র চিত্রণের জন্য কি কি উপায় অবলম্বন করেন, সেসব নিয়েও কথা বলি এবং এক সময় বিদায় হই।

আমি সেবার ঢাকায় ফেরত এসে 'আনন্দবাজারে পঁয়তালি্লশ মিনিট' শিরোনামে একটা লেখা লিখি এবং পাক্ষিক 'অনন্যা'য় জমা দেই। লেখাটি পরের বছর ভ্রমণ সংখ্যাতে ছাপা হয়। এটাই ছিল কোনো পত্রিকায় ভ্রমণবিষয়ক আমার প্রথম লেখা। সেটা ১৯৯১ সাল।

 

 

সর্বশেষ খবর