ভালোবাসার গল্প সময়কে জয় করে নেয়। সময় জয় করতে না পারলে কাহাই আর মেরেটাইটসের ভালোবাসার গল্প এখনো মানুষের মনকে বিমোহিত করত না। বছর, যুগ বা শতক নয়। এই ভালোবাসার গল্প টিকে আছে হাজার বছর ধরে। এক বা দুই হাজার নয় চার হাজার ৪০০ বছর তো দিব্যি কেটে গেল! মিসর। সভ্যতার গোড়াপত্তনের কথা যেখান থেকেই বারবার উঠে আসে। সেই মিসরে তখনো পিরামিড মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়নি। সেই সময়ের কথা। মিসরের রাজপ্রাসাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন কাহাই। ধারণা করা হয় সে ছিল মিসর রাজদরবারের শীর্ষ গায়ক। ইতিহাস তো এটাও মনে করে, কাহাই ও তার ছেলেরাও রাজ গায়ক ছিলেন। আর মেরেটাইটস ছিল পুরোহিত। রূপের বাহার না থাকলেও মেরেটাইটস ছিল সে সময়ের সম্মানিত নারী। মিসর যুগে নারীর মর্যাদা যে পুরুষের চেয়ে কম ছিল না তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ মেরেটাইটস। হয়তো পুরোহিত হওয়ার কারণেই মেরেটাইটস প্রভাবশালী নারী আর সে হিসাবেই কাহাইয়ের সঙ্গে তার প্রেম হয়ে ওঠে সে সময়ের অনবদ্য এক সম্পর্ক। এই গল্পের খোঁজ যে পাওয়া গেছে তা অর্ধশতকও হয়নি। মেরেটাইটস আর কাহাইয়ের সমাধিক্ষেত্র আবিষ্কারের পর শিলালিপি আর গুহাচিত্রে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয় এই যুগলের প্রেমের গল্পটি। সাকারার সমাধিক্ষেত্রে এই দুজন ও তাদের বংশধররা শায়িত আছেন চিরনিদ্রায়। ভালোবাসার সুভাস মিলবে গুহাচিত্রে। সেখানে দেখা যায়, মেরেটাইটস ও কাহাই একে অন্যের চোখের দিকে প্রেমময় মায়া নিয়ে তাকিয়ে আছে। এই গুহাচিত্রের অন্যতম চমক হলো, মেরেটাইটসের ডান হাত কাহাইয়ের ডান কাঁধে ছিল। পিরামিড যুগে এ ধরনের ভালোবাসার প্রকাশ বেশ বিরল এটা স্বীকার করে নিতে হয়। তাই বলা যায়, কাহাইয়ের এই সমাধি সে যুগে নারীদের বিশেষ অবস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। গুহাচিত্রে পুরুষদের সঙ্গে নারীদের সহাবস্থান, স্বামী ও ভাইদের সমাধির আকৃতির সঙ্গে তাদের সমাধির আকৃতির মিল সে যুগের সমাজে নারীদের সমানাধিকার ছিল এমন ইঙ্গিত দেয়। আরও দেখা যায়, কাহাই একটি পরচুলা পরে আছে। তার কাঁধে রয়েছে একটি গলাবন্ধনী, হাতে রয়েছে ব্রেসলেট ও গায়ে ছিল চিতাবাঘের চামড়া। এ ছাড়া তার হাতে রাজদণ্ড কর্তৃত্ব ও দায়বদ্ধতার প্রতীক। এটি খুব সম্ভবত কাহাইয়ের সংগীত পরিচালক হিসেবে উচ্চপদস্থ ব্যক্তি হওয়ার নিদর্শন। অন্যদিকে মেরেটাইটসের পরচুলা ছিল অনেক লম্বা, পরনে ছিল লম্বা গাউন, ব্রেসলেট ও বড় গলাবন্ধনী।
শিলালিপিতে...
কাহাইয়ের সমাধিটি ১৯৬৬ সালে আবিষ্কৃত হয়। তবে এই আবিষ্কারের গল্প মানুষের কাছে পৌঁছায় আরও পরে। এ বিষয়ে ১৯৭১ সালে একটি বই প্রকাশ পায়। তখন মানুষের কৌতূহল বেড়ে যায়। সে বইয়ে পুরো ভালোবাসার চিত্র ফুটে ওঠে। এরপর ২০১০ সালে গবেষকরা আবারও সেই সমাধিক্ষেত্রে যাত্রা করেন। প্রত্নতাত্ত্বিক ও অন্যান্য শিল্পনিদর্শন দেখে ধারণা করা হয়, এটি রাজা নিউসেরের শাসনামলে নির্মিত। গবেষকরা চমকপ্রদ গল্পটার বেশিরভাগ অংশ জানতে পারেন সমাধির শিলালিপি থেকে। সেই শিলালিপি থেকে জানা গেল, কাহাইকে প্রেমের সঙ্গে বেদনার সঙ্গী হতে হয়েছিল। তার একজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে ছিল। তার নাম ছিল নেফের। সেই ছেলেকে সমাধিস্থ করতে হয়েছিল কাহাইকে। বেদনাদায়ক হলো, তখন নেফেরের স্ত্রী ছিল সন্তানসম্ভবা। এ ছাড়া গুহাচিত্রগুলোও ছিল কৌতূহলোদ্দীপ্ত। কাহাইয়ের রাজকীয় মর্যাদাই শুধু নয়, পুরোহিত হিসেবে মেরেটাইটসের সামাজিক মর্যাদাও দারুণভাবে ফুটে ওঠে। সে সময় সমাধিগুলোতে প্রাচীন মিসরীয় রীতি অনুযায়ী জীবন ধারণের জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয় মূল্যবান সামগ্রী সমাধিকক্ষে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল।