সবার কাছেই মূল্যবান ধাতু হিসেবে গুরুত্ব পায় সোনা। তবে আদিযুগে এই ধাতু সম্পর্কে মানুষের তেমন ধারণা ছিল না। জানা ছিল না সোনা উত্তোলনের কৌশল। পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা খনির সন্ধানও ছিল না তাদের কাছে। কিন্তু বর্তমানে মানুষ রীতিমতো সোনা নিয়ে রাজত্ব করতে শিখেছে। বিশ্বজুড়ে থাকা এই সোনার ভাণ্ডারের নানা ইতিহাস নিয়ে আজকের রকমারি।
বিশ্বজুড়ে সোনার ভাণ্ডার
সোনা সব মানুষের জনপ্রিয় মূল্যবান খনিজ পদার্থ। আর সেই সুবাদে যেখানেই সোনার খনির সন্ধান মিলেছে সেখানেই মানুষ ছুটে গেছে। তবে বিশ্বের সব দেশেই তো আর সোনার ভাণ্ডার নেই। হাতেগোনা কয়েকটি দেশে রয়েছে মূল্যবান এই ধাতুর খনি। উপমহাদেশীয় ভারতেই রয়েছে সোনার বিশাল ভাণ্ডার। বিজনেস ইনসাইডারের জরিপে বর্তমানে এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম দেশ ভারতে রয়েছে প্রায় ৫৫৭.৭ টন সোনার মজুদ। ভারতীয়দের নিজেদের পুরনো বিশ্বাস যে, সোনার জন্য টাকা খরচ করলে তা ক্ষয় হয়। তাই হয়তো বিশাল এই ভাণ্ডারের দিকে তাদের কোনো নজর নেই। বিশ্বের আরেকটি সোনার ভাণ্ডারের দেশ নেদারল্যান্ডস। উত্তোলন ব্যাপক থাকায় বেশ কিছুদিন আগেও তাদের দেশে সোনা বিক্রির হিড়িক ছিল। তবে এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। এর আগে ডাচরা কখনই তাদের এই হলুদ টাকার ওপর হাত দেয়নি। নেদারল্যান্ডসে প্রায় ৬১২.৫ টন সোনা রয়েছে। এশিয়ার আরেক দেশ জাপানও বিশাল সোনার উৎস। উনিশ শতকের মাঝামাঝি জাপানিদের সোনা ছিল মাত্র ৬ টন। তবে বর্তমানে জাপানে ৭৬৫.২ টন সোনার বিশাল মজুদ রয়েছে। সুইজারল্যান্ড ও রাশিয়াও সোনার দৌড়ে পিছিয়ে নেই। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের কাছে দেশটির দেওয়া তথ্যানুসারে বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের রয়েছে ১,০৪০ টন সোনা। অন্যদিকে বৃহত্তর রাশিয়ার রয়েছে প্রায় ১৩৫২.২ টন সোনার ভাণ্ডার। এশিয়ায় চীনের সোনার ভাণ্ডার হলো প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সুফল। বর্তমানে দেশটিতে সোনা রয়েছে প্রায় ১,৭০৮.৫ টন। অন্যদিকে ফ্রান্সের কথা বলতে গেলে দেশটির ডানপন্থি নেতা মেরিন লে পেনের ভূমিকা সম্পর্কে বলতেই হয়। যিনি কিনা ২০১৪ সালে দেশটিকে সোনায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে ব্যাপক উৎসাহ দেন। বর্তমানে দেশটির সোনার মজুদ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৩৫.৫ টনে। ইতালির ভাণ্ডারে রয়েছে ২,৪৫১.০ টন সোনা। অন্যদিকে জার্মানির হাতে রয়েছে প্রায় ৩,৩৮১ টন পরিমাণের সোনা। আমেরিকার সোনার মজুদও কম নয়। ১৯৫২ সালের আগে ছিল প্রায় ২০,৬৬৩ টন। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সে পরিমাণ কমতে থাকে। বর্তমানে এ দেশটির সোনার ভাণ্ডারে মজুদ রয়েছে মোট ৮১৩৩.৫ টন।
সমিল বসাতে গিয়ে সোনা!
১৮৪৮ সালে জন সাটার নামের এক মার্কিন ধনাঢ্য আবাসন ব্যবসায়ী দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি বড় আবাসন প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন। সে কাজে তার প্রচুর কাঠ প্রয়োজন হলো। প্রকল্পের পাশেই সাটার একটি সমিল বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। কাছেই সাক্রামেন্টো পাহাড়ে সেই সমিল বসানোর দায়িত্ব দিলেন বর্তাল জেমস মার্শালকে। এই কাজে মাটি খোঁড়ার সময় মার্শাল আবিষ্কার করলেন মাটির নিচে সোনালি কিছু একটা চকচক করছে। আবিষ্কারের আনন্দে তার চোখ জোড়াও চকচক করে উঠল। তিনি প্রথম সোনার খনি আবিষ্কার করেছেন। জন সাটারের সমিলে পরিখা খননের প্রয়োজনে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটি ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রতি রাতে নদীর পানির দিক পরিবর্তন করে সমিলের নিচ দিয়ে প্রবাহিত করা হতো। দিনের বেলা সেই প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হতো। ১৮৪৮ সালের ২৪ জানুয়ারি দিনের বেলায় পানির প্রবাহ বন্ধ করে মার্শাল পরিখার অবস্থা দেখতে গেলেন। শুকনো পরিখায় মার্শাল এক তাল চকচকে উজ্জ্বল ধাতব কিছু একটা দেখতে পান সোনালি রঙের। দেখেই তার চোখ চকচক করে উঠল। তিনি দুটি পাথর দিয়ে ধাতব তালটাকে পিটিয়ে দেখলেন। সেটি ছড়িয়ে গিয়ে বড় হলো, কিন্তু ভাঙল না। ব্যস, মার্শাল নিশ্চিত হলেন, ওই তালটা সোনারই।
গ্লোডস্ট্রাইক খনি
গ্লোডস্ট্রাইক খনিটি আমেরিকার নর্থওয়েস্টার্ন অঞ্চলের নিভাদা অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত। উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বড় খনি এটি। খনিটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বর্ণখনি কোম্পানি ব্যারিক গোল্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। গোল্ডস্ট্রাইক সোনার খনি থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ৮.৫ মিলিয়ন সোনা উত্তোলন করা হয়। ২০১৬ সালে এর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ লাখ ৭৫ হাজার আউন্স থেকে ১ কোটি ৭৫ হাজার আউন্স পর্যন্ত। এই খনিতে প্রতি আউন্স সোনা উত্তোলনে খরচ হয় ৭৮০ থেকে ৮৫০ ডলার। প্রতি এক টন আকরিক থেকে ০.১ আউন্স স্বর্ণ পাওয়া যায়। এই পর্যন্ত খনি থেকে ৪২ মিলিয়ন আউন্স স্বর্ণ উত্তোলন করা সম্ভব হয়েছে। গোল্ডস্ট্রাইক খনি পরিচালনার জন্য ব্যারিক গোল্ড কোম্পানি ১৭০০ কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে খনিতে এখন পর্যন্ত ৩৫ মিলিয়ন আউন্স স্বর্ণ মজুদ আছে। মজুদ স্বর্ণ স্থান দখল করে আছে ৬ হাজার ফুট দৈর্ঘ্য, পুরুত্ব ৬০০ ফুট এবং চওড়া ৮০০ ফুট। এই খনি থেকে প্রথমেই মাটির উপরি প্রান্ত থেকে সোনা পাওয়া যায়। বর্তমানে গোল্ডস্ট্রাইক খনিকে তিনটি আলাদা ভাগে ভাগ করা। তিন ক্ষেত্র থেকে আলাদা তিন ধরনের উপাদান পাওয়া যায়। তবে এই তিন ক্ষেত্রের আকরিকের মিলিত রূপ থেকেই স্বর্ণ তৈরি হয়। ১৯৭৬ সালে প্যানকানা মিনারেলস লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে তা সংগ্রহ করা হয়। এর দুই বছর পর ওয়েস্টার্ন স্টেট মিনারেলস করপোরেশন যৌথভাবে তাদের সঙ্গে কাজ শুরু করে। তবে ১৯৮৭ সালে ব্যারিক স্বর্ণখনিটি পুরোপুরিভাবে নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে নেয়।
ভূমিকম্পেই সোনা সৃষ্টি
ভূমিকম্প পাল্টে দিতে পারে পৃথিবীর মানচিত্র। বদলে দিতে পারে গতিপথ। ধ্বংস করে দিতে পারে সভ্যতা, সুউচ্চ পাহাড়। তবে সম্প্রতি ভূমিকম্প নিয়ে বোমা ফাটালেন বিজ্ঞানীরা। ভূমিকম্পের ফলে নাকি তৈরি হয় সোনা। অবাক হলেও এর সত্যতা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বলেন, আগ্নেয়গিরি ও ভূমিকম্পের ফলে নাকি সৃষ্ট ভূগর্ভস্থ তরল পদার্থগুলো খণ্ডিত হয়ে ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়। পরবর্তীতে রূপান্তরিত হয় মূল্যবান সম্পদে।
অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডের ভূপদার্থ বিজ্ঞানের গবেষক ডিওন ওয়েদারলি এই গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি জানান, ভূগর্ভস্থ তাপ ও চাপের ফলে তরল পদার্থগুলো পৃথক পৃথক কণায় রূপান্তরিত হয়। সৃষ্টি হয় নতুন নতুন পদার্থ। ভূগর্ভের ১০ কিলোমিটার গভীরে পানির সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সিলিকা মিশে থাকে। যখন ভূকম্পন হয়, তখন প্রচণ্ড তাপ ও চাপের ফলে ভেঙে যায় সেখানকার পানির কণাগুলো। এতে বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান খনিজ পদার্থের সৃষ্টি হয়। তখন অবশ্য অন্যান্য খনিজ পদার্থের মতো সোনার উপাদানগুলোও বালি আর কাদামিশ্রিত অবস্থায় থাকে।
ক্যালিফোর্নিয়ার গোল্ডরাশ
১৮৪৮ সালের জানুয়ারিতে ক্যালিফোর্নিয়ার কলোমা নামক শহরে সাটার সমিলে স্বর্ণ খুঁজে পান জনৈক জেমন ডব্লিউ মার্শাল। এই কথা জানতে পেরে আমেরিকার সব রাজ্যের মানুষতো বটেই চায়না, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকার ভাগ্যান্বেষী মানুষরাও খেয়ে না খেয়ে ছুটতে থাকে ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে। স্বপ্ন তাদের একটাই, সোনা খুঁজে বের করা। রাতারাতি বদলে ফেলবেন নিজেদের ভাগ্য। এই স্বর্ণ-হুজুকের পাল্লায় পড়ে ঘর-বাড়ি বিক্রি করে, প্রিয়জন ছেড়ে, মাইলের পর মাইল পাড়ি দেয় অনেক লোক। দুর্গম পথ ও মৃত্যুভয়কে সঙ্গে নিয়ে মেতে যায় ক্যালিফোর্নিয়ায় যাওয়ার নেশায়। হাজার হাজার মানুষের আগমনে মাত্র আট বছরে ক্যালিফোর্নিয়া পরিণত হয় আমেরিকার অন্যতম বহুজাতিক রাজ্যে। গোটা পৃথিবী থেকে এর মধ্যে শুধু ১৮৪৯ সালেই জনবিরল এ এলাকায় নতুন করে পা রাখে তিন লাখেরও বেশি মানুষ। ওই সালের নামেই ইতিহাস এদের স্মরণে রেখেছে ‘ফর্টি-নাইনার্স’ হিসেবে।
ক্যালিফোর্নিয়া পুরো অঞ্চলে দেখা গেল, সর্বত্র মাটি খুঁড়ে অথবা নদীর জল ছেঁকে স্বর্ণ খুঁজছে মানুষ। আর এসব স্বর্ণসন্ধানীর অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রে সদ্য পা রাখা অভিবাসী। সব আশা গুঁড়িয়ে সোনার দেখা আর মেলে না। খনিতে থাকা-খাওয়ার কষ্ট তো আছেই, সঙ্গে যুক্ত হয় একাকিত্বের যন্ত্রণা। তার ওপর খনির হাড়ভাঙা খাটুনি তো আছেই। মূলত অঞ্চলটির স্বর্ণের প্রাচুর্যের প্রলোভন দেখিয়ে সেখানে যাত্রী টানার জন্যই হুজুগ তৈরি করেছিল জাহাজব্যবসায়ীরা। ওই সময়ে প্রতিদিন যাত্রীবাহী প্রচুর জাহাজ আর কাভার্ড ওয়াগন এসে হাজির হতো ক্যালিফোর্নিয়ায়।
গ্রাসবার্গ খনি
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সোনার খনি গ্রাসবার্গ। এই খনির পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের নাম ফ্রিপোর্ট-ম্যাকমোরান কপান অ্যান্ড গোল্ডের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ফ্রিপোর্ট ইন্দোনেশিয়া। খনিটি পরিচালনার ৯০.৬৪ শতাংশ দখলে রয়েছে এই কোম্পানির। বাকি অংশ সরকারের। এটি একই সঙ্গে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তামার খনিও। গ্রাসবার্গ খনিটি ওসেনিয়া মহাদেশের পাপুয়া নিওগিনিতে অবস্থিত। এখানে কর্মরত আছেন ১৯ হাজার ৫০০ কর্মী। গ্রাসবার্গ খনিতে এখন পর্যন্ত ১.৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন সোনা মজুদ আছে। ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর তারিখে এই খনিতে মোট সংরক্ষিত সোনার পরিমাণ ছিল ৬.৫ মিলিয়ন আউন্স। খনি পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলোর মতে, গেল ২০১৩ সালে খনিটি থেকে ১.২৫ মিলিয়ন আউন্স সোনা উত্তোলন করা হয়। ১৯৯০ সালে এই খনি থেকে আকরিক উত্তোলন শুরু হয়। প্রতিদিন ১ লাখ ৬৫ হাজার টন আকরিক প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ২০২২ সালের মধ্যে এই পরিমাণ বেড়ে ২ লাখ ৪০ হাজার টনে পৌঁছবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে দুর্ঘটনাও এড়াতে পারেনি খনিটি। ২০১৩ সালের মে মাসে ৩৩ জন শ্রমিক আটকা পড়ে। একই মাসে আরও ১৪ জন মারা যায়।
ওয়ানকোচা খনি
পেরুর ভাষায় ওয়ান শব্দের অর্থ কালো, আর কোচা শব্দের অর্থ পুকুর। অথচ এটি একটি স্বর্ণ খনি। পেরুর আনদেস পর্বতমালায় অবস্থিত ওয়ানকোচা খনি ল্যাটিন আমেরিকার বৃহত্তম সোনার খনি। পৃথিবীর মধ্যে এর অবস্থান চতুর্থ। দুঃখের বিষয় হলো এত বড় সোনার খনিই যে প্রদেশে অবস্থিত সেই প্রদেশটি আবার সবচেয়ে গরিব বলে পরিচিত। এটি ১৯৯৩ সালে আবিষ্কৃত হয়। এর তিনটি সক্রিয় খনি আছে। এই খনি থেকে এখন পর্যন্ত মোট ২৬ মিলিয়ন আউন্স সোনা উৎপন্ন হয়েছে। এই খনি পরিচালনা কোম্পানির নাম নিউমন্ট মাইনিং। ২০১২ সালে এই খনি থেকে ১.৩৪৬ মিলিয়ন আউন্স সোনা উত্তোলন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই খনিতে ৩ মিলিয়ন আউন্স সোনা মজুদ আছে। স্বর্ণ খনিটি ২৫১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত। সোনার এই খনিটি পেরুর মাইনিং কোম্পানি বুয়েনাভেঞ্চারা এবং ফ্রান্সের অধীনস্থ কোম্পানি ব্যুরো দ্য রিসার্সেস জিওলজিকস এট মাইনারসের যৌথ মালিকানায় পরিচালিত হয়। কর্তৃপক্ষ অন্যান্য কাজের সঙ্গে খনির অভ্যন্তরীণ নিয়ম কানুন ঠিক রাখার ব্যাপারেও কঠোর ভূমিকা পাল করে থাকে।