শনিবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিআরটিএর আধুনিকায়ন প্রকল্প মিটিং আর কাগজে সীমাবদ্ধ

আলী রিয়াজ

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নতুন আইন কার্যকর হলেও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) পড়ে আছে সেই পুরনো আমলে। মন্ত্রণালয়ের মিটিং আর কাগজেই সীমাবদ্ধ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির আধুনিকায়ন প্রকল্প। প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামো, জনবল, আধুনিকায়নের জন্য নেওয়া কোনো প্রকল্পই বাস্তবায়ন হয়নি। সারা দেশে বিআরটিএর নিজস্ব কার্যালয় স্থাপন, নিজস্ব ড্রাইভিং ইনস্টিটিউট প্রকল্প বছরের পর বছর ধরে আছে কাগজে কলমে। শুধু প্রতি মাসে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাস্তবে কোনো কাজ হচ্ছে না। কয়েকটি স্থানে জমি অধিগ্রহণ করার পরেও ভবন নির্মাণের জন্য গণপূর্ত অধিদফতর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালি হচ্ছে। বর্তমানে রাজধানীতে জরাজীর্ণ ভাড়া ভবনে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। জেলা শহরে ডিসি অফিসে একটি কক্ষে চলছে এসব কাজ।

এ ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস, রুট পারমিট, ট্যাক্স টোকেন, মালিকানা পরিবর্তন কার্যক্রমের অর্থ অনলাইনে নিলেও বাস্তবে দুর্নীতি বন্ধ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। এসব কার্যক্রমে প্রতিটি কার্যালয়ে গ্রাহকদের এখনো শিকার হতে হচ্ছে নানা হয়রানির। প্রতি বছর এই খাতে সরকার তিন হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় করলেও বিআরটিএর কোনো উন্নতি হচ্ছে না। গ্রাহকরা পাচ্ছে না কাক্সিক্ষত সেবা। বিআরটিএর কর্মকর্তারাও প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয় দৌড়ঝাঁপ করছেন। তবে আমলাতান্ত্রিকতার ফাঁদে আটকে আছে এসব প্রকল্পগুলো। আরেকটি প্রকল্প ছিল ড্রাইভিং কম্পিটেন্সি টেস্ট বোর্ড (ডিসিটিবি)। এই প্রকল্প পরিকল্পনায় আটকে আছে।

বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে বিআরটিএ আধুনিকায়নের জন্য কয়েকটি প্রকল্প পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে বিভাগীয় শহরে সব ধরনের সুবিধাসহ নিজস্ব কার্যালয় স্থাপন, নিজস্ব ড্রাইভিং ইনস্টিটিউট চালু করা। এ ছাড়া জেলা শহরের অফিস ডিসি অফিসের বাইরে নিজস্ব ভবন স্থাপন করা। লোকবল ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আলাদা ক্যাডার সার্ভিসের মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করা। বিভিন্ন ধরনের ফি অনলাইনের মাধ্যমে গ্রহণ। এর মধ্যে ফি আদায় অনলাইনে প্রদান কার্যক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকিগুলো এখনো কাগজে কলমে। তবে কার্যালয়ের স্থাপনের পরিকল্পনা ২০১৫ সালে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে নতুন জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। এর মধ্যে ঢাকার উত্তরা দিয়াবাড়ীতে ২৪ কাঠা ও পূর্বাচলে ২৩ কাঠা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ভবন নির্মাণের জন্য প্ল্যান চূড়ান্ত করা হয়েছে। এরপরে কোনো উদ্যোগ নেই। এসব প্রকল্প চলতি বছরে সাতটি বৈঠক হয়েছে, বৈঠকে বাস্তবায়নের জন্য কমিটি সুপারিশ করেছে প্রতিবার। দিয়াবাড়ী, জোয়ারসাহারা, ইকুরিয়া ছোট্ট একটি ভবনে চলত সব ধরনের কার্যক্রম। দিয়াবাড়ী গিয়ে দেখা গেছে, শত শত গাড়ি আর মানুষ। বিভিন্ন সেবা নিতে আসা মানুষের দাঁড়ানোর ঠাঁই নেই। সেখানে চলছে ড্রাইভিং পরীক্ষা, ফিটনেস যাচাই। কর্মকর্তাদের জন্য বসার জায়গা পর্যন্ত নেই এখানে।

বিআরটিএর প্রতিটি কার্যালয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ফিটনেস সনদ প্রদানের জন্য জনবল, অবকাঠামো ও আধুনিক লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। মাঠপর্যায়ে লাইসেন্সপ্রত্যাশীদের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় মানসম্পন্ন পরীক্ষা নেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া আধুনিক ভেহিকেল ইন্সপেকশন সেন্টার না থাকায় ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে ফিটনেস সনদ দিচ্ছে বিআরটিএ। কোনো কার্যালয়ে রেকর্ড রুম নেই। ফলে ফিটনেস যাচাইয়ের পরে কত বছর গাড়িটি চালানো এসব তথ্য দ্বিতীয় বার আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই চিত্র সারা দেশের বিআরটিএ কার্যালয়ে।

বিআরটিএ প্রতি বছর প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় করে। গত অর্থবছরে ৩ হাজার ৭৬ কোটি টাকা আগের বছর ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করছে। গ্রাহকদের কাছ থেকে এ অর্থ আদায় করা হলেও তাদের শিকার হতে হয় হয়রানি দুর্নীতির। তবে ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ঠেকানো গেলেও পরীক্ষা পদ্ধতিতে রয়েছে দুর্নীতির আখড়া। ঢাকায় জোয়ারসাহারা বিআরটিসির বাস ডিপো, উত্তরায় ও কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়ায় বিআরটিএ কার্যালয়ে প্রতিদিন পেশাদার ও অপেশাদার চালকের লাইসেন্সের পরীক্ষা হয়। জোয়ারসাহারায় গিয়ে দেখা গেছে দালাল, সিন্ডিকেটের চরম দৌরাত্ম্য। এখানে দালাল ছাড়া কোনো কাজ হয় না। নিজেদের গাড়ি থাকলেও ড্রাইভিং টেস্ট দিতে আলাদা টাকা দিতে হয়। গড়ে উঠেছে বিশাল সিন্ডিকেট। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম কার্যালয়েও প্রতিদিন পরীক্ষা হয়। আর অন্য জেলা শহরে মাসে দুই বা তার বেশিবার পরীক্ষা হয়। বিআরটিএর হিসাবে, বর্তমানে ঢাকাসহ প্রতিটি সার্কেলে দৈনিক প্রায় তিনশ থেকে ৫০০ চালক পরীক্ষায় অংশ নেন। জেলাগুলোতে অংশ নেন ১৫০ থেকে ২০০ জন। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের চালকদের কারও কারও নিজের বাহন থাকে। বাকি প্রায় ৫০০ পরীক্ষার্থীই ভাড়া করা গাড়িতে পরীক্ষা দেন। প্রতিটি গাড়ি ভাড়া বাবদ গড়ে ১৫০ টাকা ধরলে দিনে প্রায় ৭৫ হাজার টাকা দিতে হয় পরীক্ষার্থীদের। এর বাইরে গাড়ি ফিটনেস যাচাইয়ের আধুনিক সরঞ্জাম না থাকায় অনুমান নির্ভর সনদ প্রদান করা হয়। ফলে পুরনো গাড়িতে রং করে নিয়ে এসেও পাওয়া যায় সনদ। এতে দুর্নীতির পরিমাণ কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। এসব বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে গড়ে উঠেছে এলাকাভিত্তিক দালাল ও সিন্ডিকেট চক্র।

জানতে চাইলে বিআরটিএর কর্মকর্তা ইঞ্জিনিয়ার মো. শহিদুল আজম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিআরটিএর আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যুগোপযোগী এই আইনটি খুবই ভালো। তবে এটি বাস্তবায়ন করতে হলে অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। মানুষের কাছ থেকে রাজস্ব নিলে তাদের সেবা দিতে হবে। বিআরটিএতে নানা ধরনের সংকট রয়েছে। এসব সংকট দূর করা ও এই আইন কার্যকর করতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর