শিরোনাম
বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ফজলে হাসান আবেদের বর্ণাঢ্য জীবন

রণক ইকরাম

ফজলে হাসান আবেদের বর্ণাঢ্য জীবন

স্যার ফজলে হাসান আবেদ [ ২৭ এপ্রিল ১৯৩৬-২০ ডিসেম্বর ২০১৯]

বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও ইমেরিটাস চেয়ার স্যার ফজলে হাসান আবেদ। নিজের প্রতিষ্ঠিত এনজিওর মাধ্যমে সারাবিশ্বে তিনি বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তৃণমূল মানুষের সেবা করতে গিয়ে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। মাত্র এক লাখ কর্মী নিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর ১১টি দেশের ১২০ মিলিয়ন মানুষকে বিভিন্ন সেবা দিয়ে চলেছে ব্র্যাক। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রাখায় স্যার ফজলে হাসান আবেদ আন্তর্জাতিক অসংখ্য পুরস্কার ও স্বীকৃতিতে ভূষিত হয়েছেন। উদ্যমী, সফল ও স্বপ্নদ্রষ্টা এই মানুষটি নশ্বর পৃথিবীকে বিদায় বললেও তার কর্মে বেঁচে থাকবেন ঠিকই। নিজের স্বপ্নকে গণমানুষের প্রয়োজনে পরিণত করা স্যার ফজলে হাসান আবেদকে নিয়েই আজকের রকমারি।

 

জমিদার পরিবারের ছেলেটি

স্যার ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল তদানীন্তন সিলেটের হবিগঞ্জ মহকুমার বানিয়াচং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সিদ্দিক হাসান ছিলেন একজন জমিদার। তার মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পরে দেশ বিভাগের আগে আগে তার বাবা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। তখন তাদের পরিবার হবিগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি বানিয়াচংয়ে চলে আসে। পরবর্তীতে আবেদ চাচার চাকরিস্থল কুমিল্লায় চলে যান। সেখানে গিয়ে কুমিল্লা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। সপ্তম থেকে অষ্টম শেণি পর্যন্ত সেখানেই পড়াশোনা করেন। এর মধ্যেই তার চাচা জেলা জজ হিসেবে পাবনায় বদলি হয়ে যান। ফলে সেখান থেকে আবেদও চলে আসেন পাবনায়। এবার তিনি ভর্তি হন পাবনা জিলা স্কুলে। ১৯৫২ সালে এই পাবনা জিলা স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি। এরপর ১৯৫৪ সালে এইচএসসি পাস করেন ঢাকা কলেজ থেকে। সে বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন।

১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হন। কিন্তু এই কোর্র্স অসমাপ্ত রেখে ১৯৫৬ সালেই গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি ছেড়ে লন্ডন চলে যান এবং ভর্তি হন অ্যাকাউন্টিংয়ে। সেখানে কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিংয়ের ওপর চার বছরের প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করেন ১৯৬২ সালে। ১৯৫৮ সালে ফজলে হাসান আবেদের মায়ের মৃত্যু হয়। পরে তিনি লন্ডনে চাকরিতে যোগদান করেন।

কিছুদিন চাকরি করার পর চলে যান কানাডা। সেখানেও একটি চাকরিতে যোগ দেন। পরে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৬৮ সালে দেশে ফিরে এসে শেল অয়েল কোম্পানির হেড অব ফাইন্যান্স পদে যোগ দেন। কিন্তু এরপর মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় তার জীবনের গতিপথ।

 

মুক্তিযুদ্ধে সহায়তায় অ্যাকশন বাংলাদেশ ও হেল্প বাংলাদেশ

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অনেকেই দেশের মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। এদের মধ্যে স্যার ফজলে হাসান আবেদ অন্যতম। ১৯৭১ সালে তিনি শেল অয়েল কোম্পানির উচ্চপদের চাকরি ছেড়ে লন্ডনে চলে যান। ওই বছর মে মাসে লন্ডনে গিয়ে সমমনা বন্ধুদের নিয়ে সম্পৃক্ত হন স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইয়ে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য গড়ে তোলেন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেল্প বাংলাদেশ’ নামের দুটি সংগঠন। এই দুটি সংগঠনের ব্যানারে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে গেছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত তৈরি করা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা বন্ধে ইউরোপীয় দেশগুলোর সরকারকে সক্রিয় করে তোলা। ‘হেল্প বাংলাদেশ’-এর কাজ ছিল অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করা। আন্তর্জাতিক পত্রিকা, রেডিও ও টেলিভিশনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করাসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করা।

 

খাবার স্যালাইন বিপ্লব

আশির দশকে বাংলাদেশে ডায়রিয়া মহামারী আকার ধারণ করে। তখন সারা দেশে স্যালাইনের প্যাকেট পৌঁছানো রীতিমতো অসম্ভব ছিল। কিন্তু এই মহামারী থেকে বাঁচতে স্যালাইনের কোনো বিকল্প নেই। ফলে মানুষকে ঘরে বসেই স্যালাইন তৈরি শেখানোর মিশন নিয়ে মাঠে নামল ফজলে হাসান আবেদের প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক। ‘এক চিমটি লবণ, এক মুঠ গুড় ও আধা সের পানি’ ফর্মুলা নিয়ে ব্র্যাকের মাঠকর্মীরা প্রতিটি বাড়ির অন্তত একজন সদস্যকে স্যালাইন তৈরি করতে শেখান। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন এই ফর্মুলার নিয়মিত প্রচার শুরু করে।

ব্র্যাকের এই কর্মসূচি ডায়রিয়া প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় বড় ভূমিকা রেখেছিল। বাড়িতে খাওয়ার স্যালাইন তৈরির এই ফর্মুলার সাফল্য নিয়ে টাইম ম্যাগাজিন ২০০৬ সালের ১৬ অক্টোবর সংখ্যায় প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপায়। ১৯৭৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং পরে ইউনিসেফ ওরস্যালাইনের ব্যবহার বাড়াতে উদ্যোগী হয়।

এক প্যাকেট স্যালাইন আধা লিটার পানিতে গুলে খেতে হয়। এতে শরীরের পানিশূন্যতা দূর হয়। জরুরি পরিস্থিতিতে স্যালাইনের প্যাকেট পাওয়া না গেলে আধা লিটার বিশুদ্ধ পানিতে এক মুঠ চিনি বা গুড় এবং এক চিমটি লবণ গুলে খেলে একই কাজ হয়। সহজ এই পদ্ধতি এখন বিশ্বব্যাপী ডায়রিয়া বা উদরাময় চিকিৎসার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। এটি বিশ্বব্যাপী এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কোটি শিশুর জীবন রক্ষা করেছে।

এই ওরস্যালাইন বা ওআরএস আবিষ্কার একক কোনো বিজ্ঞানীর কৃতিত্ব নয়। গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা তৈরি হওয়ার আগে অনেকে অনেক দিন ধরে কাজ করেছেন। চূড়ান্ত রূপটা এসেছে ১৯৬৭-৬৮ সালে।

চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট ১৯৭৮ সালের ৫ আগস্টের সম্পাদকীয়তে বলেছিল, ওআরএসের আবিষ্কার চিকিৎসার ক্ষেত্রে শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এই আবিষ্কার তীব্র ডায়রিয়া চিকিৎসায় মুখে তরল খাওয়ানোর রাস্তা খুলে দিয়েছে।

 

লন্ডনে ফ্ল্যাট বিক্রি কওে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সিলেটের শাল্লায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসবাসরত লোকজনকে দেখতে যান স্যার ফজলে হাসান আবেদ। সেখানে গিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন শাল্লায় কাজ করবেন। স্বাধীন বাংলাদেশের দরিদ্র, অসহায়, সব হারানো মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসনকল্পে কাজ শুরু করলেন তিনি। সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিটি’ বা ব্র্যাক। তবে ১৯৭৩ সালে যখন পুরোদস্তুর উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে ব্র্যাক কার্যক্রম শুরু করে, তখন তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি।’ তবে সংক্ষিপ্ত নাম ব্র্যাকই থাকে। কবি বেগম সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, কাজী ফজলুর রহমান, আকবর কবীর, ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, এস আর হোসেন এবং ফজলে হাসান আবেদÑ এই সাতজনকে নিয়ে ১৯৭২ সালে ব্র্যাকের গভর্নিং বোর্ড গঠিত হয়। বোর্ড ফজলে হাসান আবেদকে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করে। কবি বেগম সুফিয়া কামাল হন ব্র্যাকের প্রথম চেয়ারম্যান।

ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে ২০১৭ সালে গণমাধ্যমে  দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্যার ফজলে হাসান আবেদ বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের যুদ্ধ চলাকালেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দেশ স্বাধীন হলে অসহায় ও দুর্গত মানুষের কাছে গিয়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ করব। এক কোটি লোক যুদ্ধের সময় ভারতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা ফিরে আসতে শুরু করল। ছিন্নমূল সেই মানুষগুলোর তখন জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের প্রয়োজন। ত্রাণ কর্মকা- পরিচালনার অভিজ্ঞতা আমার আগেই ছিল। আমি সহজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। লন্ডনে আমার একটি নিজস্ব ফ্ল্যাট ছিল। যুদ্ধ চলার সময় সেটি বিক্রি করে টাকা নিজের কাছে রেখেছিলাম। ওই টাকা দেশে নিয়ে এসে ত্রাণকার্য পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলাম উত্তর-পূর্ব সিলেটের প্রত্যন্ত থানা শাল্লার পুরো এলাকায়। পার্শ্ববর্তী দিরাই ও বানিয়াচং থানার কয়েকটি ইউনিয়নে আমাদের কাজ শুরু হলো। এভাবেই সূচনা হলো ব্র্যাকের।’

 

১১ দেশে ১২০ মিলিয়ন মানুষের কাছে

 

ক্ষুদ্রঋণে অর্থনৈতিক বিপ্লব

১৯৭৪ সালে ব্র্যাক ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প শুরু করে। এটি ব্র্যাকের পুরনো একটি কার্যক্রম, যা বাংলাদেশের সব জেলায় রয়েছে। এটি বেশিরভাগ দরিদ্র, ভূমিহীন, গ্রামীণ নারীদের মুক্তঋণ সরবরাহ করে তাদের আয় করতে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহযোগিতা করে। ব্র্যাকের মাইক্রোক্রেডিট প্রকল্প প্রথম ৪০ বছরে ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে নারী ৯৫% এবং পরিশোধের হার ৯৮%। ১৯৮৮ সালে ব্র্যাক সারা দেশে কমিউনিটি কমিউনিকেশন প্রকল্প শুরু করে।

একসময় ক্ষুদ্র্রঋণ ও নানা উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে ব্র্যাক কাজ করলেও আস্তে আস্তে তাদের নানা সহযোগী প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। ১৯৭৮ সালে জন্ম হয় ব্র্যাকের অন্যতম ব্যবসা সফল সহযোগী প্রতিষ্ঠান আড়ং, যেখানে তৃণমূল নারীদের হাতে তৈরি নানা পণ্য বিক্রি হয়। পর্যায়ক্রমে গড়ে ওঠে কোল্ড স্টোরেজ, পাস্তুরিকৃত দুধ ও দুগ্ধজাতীয় পণ্যের ব্যবসা, উচ্চশিক্ষা, বিনিয়োগ ও ব্যাংক।

শিক্ষা খাতে অসামান্য অবদান

বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত বৃহত্তম এনজিওগুলোর মধ্যে ব্র্যাক অন্যতম। ২০১২ সালের শেষ দিকের তালিকা অনুযায়ী ব্র্যাকের প্রায় ২২ হাজার ৭০০টি আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এই বিদ্যালয়গুলোতে প্রায় ৬৭,০০,০০০ শিশু পড়াশোনা করে। এই বিদ্যালয়গুলো দেশের সব এনজিও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন-চতুর্থাংশ।

জনস্বাস্থ্যে অগ্রগতি

শুরু থেকেই জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে আসছিল ব্র্যাক। ওরস্যালাইন বিপ্লব তাদের অন্যতম অর্জন। ব্র্যাক ১৯৭৭ সালে প্যারামেডিকেলের মাধ্যমে চিকিৎসাগত প্রাথমিক সেবা এবং একটি স্ব-অর্থায়ন স্বাস্থ্যবীমা প্রকল্পের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য সেবা প্রদান শুরু করে। মা ও শিশুস্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি অ্যাসিড নিক্ষেপবিরোধী কর্মকা-সহ নানা ক্ষেত্রে ব্র্যাকের অবদান অসামান্য। শিশুদের টিকাদানের ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করে ব্র্যাক। ব্র্যাকের সহযোগিতায় টিকাদানের হার ২% থেকে ৭৫% এ উন্নীত হয়।

ছোট্ট চারাগাছ থেকে মহীরুহ

বর্তমানে বিশ্বের ১১টি দেশে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চলছে। ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি ১২০ মিলিয়ন মানুষকে সেবা দিচ্ছে। কর্মী সংখ্যা লক্ষাধিক। দেশের বাইরে কাজ করার জন্য তৈরি হয়েছে ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল। ২০০২ সালে আফগানিস্তানে কাজ করার মাধ্যমে দেশের বাইরে কর্মকান্ড শুরু হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও কাজ করছে মিয়ানমার, নেপাল, রুয়ান্ডা, উগান্ডা, তানজানিয়া, লাইবেরিয়া, সাউথ সুদান, সিয়েরা লিওন ও ফিলিপাইনে।

 

যুক্ত ছিলেন বহু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে

বর্ণাঢ্য জীবনে বহু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেছেন এই প্রতিভাবান মানুষ। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির হার্ভার্ড ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের ভিজিটিং স্কলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৮১ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। এরপর অ্যাসোসিয়েশন অব ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিজ ইন বাংলাদেশ (এডাব)-এর চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৮২ সাল থেকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একই সময় প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র ফেলো হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৬ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, জেনেভার এনজিও কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাউথ এশিয়া পার্টনারশিপের  চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন হেলথ রিসার্চ ফর ডেভেলপমেন্টের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৯০ সালে দীর্ঘ ১৯ বছর গণসাক্ষরতা অভিযানের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একই সময় তিনি নানা প্রতিষ্ঠানে নিজেকে যুক্ত করেছেন। এনজিও ফোরাম ফর ড্রিংকিং ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশনের চেয়ারপারসন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯২ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত ইন্ডিপেনডেন্ট সাউথ এশিয়ান কমিশন অন পোভার্টি এলিভিয়েশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একই সময়ে সার্কের সাউথ এশিয়ান কমিশন অন পোভার্টি এলিভিয়েশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯৩ থেকে ১৯৯৪ এবং ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আইন ও সালিস কেন্দ্রের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৯৪ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

যুক্তরাজ্যের সাসেক্স ইউনিভার্সিটির পরিচালনা বোর্ডের সদস্য এবং ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (আইডিএস)-এর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি), ফিলিপাইনের বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক অব অলটারনেটিভ ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন (ইনাফি)-এর গ্লোবাল চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৫ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইউএন কমিশন অন লিগ্যাল এমপাওয়ারমেন্ট অব দি পুওর (সিএলইপি)-এর কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

২০১০ সালে জাতিসংঘের তদানীন্তন মহাসচিব বান-কি মুন স্যার ফজলে হাসান আবেদকে বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশসমূহের ‘স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ’র একজন হিসেবে নিযুক্তি প্রদান করেন।

অশোকা গ্লোবাল একাডেমি ফর সোশ্যাল এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ স্যার ফজলে হাসান আবেদকে ‘গ্লোবাল গ্রেট’ স্বীকৃতিতে ভূষিত করে।

২০১০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ইউএন সেক্রেটারি জেনারেলস গ্রুপ অব অ্যামিনেন্ট পারসনস ফর লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রিজ (এলডিসি)-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

২০১২ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইউএন সেক্রেটারি জেনারেলস লিড গ্রুপ অব দি স্কেলিং এবং অশোকা গ্লোবাল একাডেমি ফর  সোশ্যাল এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

 

যেখানে অনন্য তিনি...

মানুষ হিসেবে ফজলে হাসান আবেদের এমন কিছু বিশেষ দিক ছিল যা অনেকের জন্য অনুপ্রেরণীয়। এমনই কিছু দিক-

 

► স্যার ফজলে হাসান আবেদ নারী-পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করতেন। তিনি মনে করতেন, নারী-পুরুষের সমতা ছাড়া কখনো এগোনো সম্ভব নয়।

► ফজলে হাসান আবেদের চরিত্রের সবচেয়ে বড় গুণটি হলো তার  নির্মোহ স্বভাব। তিনি চাইলে ব্যক্তিগতভাবে অনেক সম্পদের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

► ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার পর এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার প্রক্রিয়ায় ফজলে হাসান আবেদ বরাবরই নতুনদের ওপর আস্থা রেখেছেন। নিজের প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন নতুনদের হাতে।

►  সিনিয়র সিটিজেন হওয়া সত্ত্বেও ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন প্রযুক্তিবান্ধব এবং ভবিষ্যৎ স্বপ্নদ্রষ্টা।

►  মানুষের জীবনে লক্ষ্যে অটল থাকতে পারলে এবং কঠোর পরিশ্রম করলে সফলতা আসে। তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্যার ফজলে হাসান। আর তিনি সব সময়ই ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে এসেছেন। সুখী জীবনকে পাশ কাটিয়ে সাধারণের জন্য স্বপ্ন দেখা মানুষটিকে অনন্য বলতেই হবে!

 

অসংখ্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ফজলে হাসান আবেদ তার জীবনে অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেছেন। যেমন সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকার জন্য র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার মাহবুবুল হক পুরস্কার, গেটস ফাউন্ডেশনের বিশ্বস্বাস্থ্য পুরস্কার এবং শিক্ষা ক্ষেত্রের ‘নোবেল’ বলে খ্যাত ইয়াইদান পুরস্কার, দারিদ্র্য বিমোচন এবং দরিদ্রের ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ‘নাইটহুড’ উপাধি ইত্যাদি।

এক নজরে ফজলে হাসান আবেদের যত পুরস্কার :

► র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, ১৯৮০ (সামাজিক নেতৃত্বের জন্য)

► ইউনেস্কো নোমা পুরস্কার (১৯৮৫)

► অ্যালান শন ফেইনস্টেইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার পুরস্কার (১৯৯০)

► ইউনিসেফ মরিস পেট পুরস্কার (১৯৯২)

► দারিদ্র্য বিমোচন ও দরিদ্র নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য সুইডেনের ওলফ পাম পুরস্কার (২০০১)

► শোয়াব ফাউন্ডেশন ‘সামাজিক উদ্যোক্তা পুরস্কার’ (২০০২)

► গ্লেইটসম্যান ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০০৩)

► জাতীয় আইসিএবি (২০০৪)

► সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকার জন্য জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার মাহবুবুল হক পুরস্কার

► গেটস ফাউন্ডেশনের বিশ্বস্বাস্থ্য পুরস্কার (২০০৪)

► হেনরি আর ক্রাভিস পুরস্কার (২০০৭)

► প্রথম ক্লিনটন গ্লোবাল সিটিজেন পুরস্কার (২০০৭)

► পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন আজীবন সম্মাননা পুরস্কার (২০০৭)

► ডেভিড রকফেলার পুরস্কার (২০০৮)

► দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ ভূমিকার জন্য ব্রিটেন কর্তৃক ২০০৯ সালে ‘নাইটহুড’এ ভূষিত।

► এন্ট্রাপ্রেনিউর ফর দ্য ওয়ার্ল্ড পুরস্কার (২০০৯)

► ওয়াইজ পুরস্কার (২০১১)

► লিও তলস্তয় আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক (২০১৪)

► বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার (২০১৫)

► ইয়াইদান পুরস্কার (২০১৯)

► বাংলাদেশের একমাত্র নাইটহুড উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তি তিনি।

সর্বশেষ খবর