বুধবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

হ্যাকিং কেলেঙ্কারি

তানভীর আহমেদ ও সাইফ ইমন

হ্যাকিং কেলেঙ্কারি

হ্যাকার বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিজেকে গোপন করে রাখা একজন ব্যক্তি বা দল। যারা দুনিয়ার সবকিছু থেকে নিজেদের লুকিয়ে রেখে কম্পিউটারের স্ক্রিনের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন। যাদের জীবন কোনো নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা থাকে না। প্রযুক্তি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কাছে যেসব বিষয় খুব দুর্বোধ্য, তাদের কাছে সেগুলো ডাল-ভাত। তথ্যপ্রযুক্তির এই অন্তর্জালের দুনিয়ায় নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রক্ষিত থাকে অতি গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় তথ্য। তথ্যচোরের দল এ জগতে চুরির সুযোগ খুঁজে বেড়ায়। সিস্টেমে নিরাপত্তা ত্রুটি খুঁজে পেলেই তারা প্রাযুক্তিক হামলা চালায়। হাতিয়ে নেয় তথ্য।  তারপর সেটি ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করে, নানা সুবিধা ভোগ করে...

 

এফবিআইর ওয়েবসাইট হ্যাক হয়েছিল ১৬ বছরের কিশোরের হাতে

হ্যাকিং আতঙ্ক নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন দেশে হ্যাকিংয়ে সিদ্ধহস্তদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন প্রযুক্তিবিদরা। কারণ এ হ্যাকারদের বড় অংশই কিশোর ও তরুণ। কিশোর বয়সেই রোমাঞ্চের খোঁজে তারা নামেন হ্যাকিংয়ে। একটি কম্পিউটার, ভালো মানের ইন্টারনেট আর গুটিকয়েক সফটওয়্যার নিয়েই তারা হ্যাক করে বসেন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গোপন তথ্য। সুরক্ষিত তথ্যচুরি স্পষ্টত আইন পরিপন্থী। বিগত বছরগুলোতে এ নিয়ে উদ্বেগ করার মতো অনেক হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। তেমনই এক ঘটনা ঘটিয়ে বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছিল ১৬ বছরের এক কিশোর। সিআইএ পরিচালক জন ব্রেনানসহ শীর্ষস্থানীয় মার্কিন কর্মকর্তাদের ই-মেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং করে বসে এই কিশোর। পরবর্তীতে তাকে গ্রেফতারের দাবি করে এফবিআই এবং ব্রিটিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাদের দাবি, মার্কিন কর্মকর্তাদের ‘নাস্তানাবুদ’ করা ওই হ্যাকার আদতে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর। ‘ক্র্যাকা’ নামে পরিচিত ওই কিশোর হ্যাকারকে ইংল্যান্ড থেকে গ্রেফতার করা হয়। ২০ হাজার এফবিআই আর ৯ হাজার হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কর্মীর ডেটা অনলাইনে ফাঁস করায় ওই কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়। এবিসি নিউজ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স’ জেমস ক্ল্যাপার,  ‘হোমল্যান্ড সিকিউরিটি’ সচিব জে জনসন এবং প্রেসিডেন্ট ওবামার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক পরামর্শকের বাসার ফোন হ্যাকিংয়ের অভিযোগ আছে ক্র্যাকার বিরুদ্ধে।

 

ন্যাটোর সৈন্যদের মোবাইল ফোন হ্যাক রাশিয়ার হ্যাকারদের

গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল রাশিয়ার হ্যাকারদের বিরুদ্ধে। তারা নাকি ন্যাটোর সেনাবাহিনী এবং তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার উদ্দেশে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে অবস্থিত ন্যাটোর সৈন্যদের মোবাইল ফোন হ্যাক করেছেন। ন্যাটোর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং কিছু সৈন্যের বরাত দিয়ে এমনটিই জানিয়েছিল ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়া ন্যাটোর কয়েক হাজার সৈন্যের স্মার্ট ফোন হ্যাক করে। রাশিয়ার সীমান্তবর্তী পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড, এস্তোনিয়াসহ আরও কিছু দেশে অবস্থিত ন্যাটোর সৈন্যদের স্মার্ট ফোন লক্ষ্য করে এই হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটানো হয়।  প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাশিয়া ন্যাটোর অন্তত ৪ হাজার সৈন্যের স্মার্ট ফোন হ্যাক করে। ন্যাটোর সৈন্যই শুধু নয়, হ্যাক করা সৈন্যদের মধ্যে বেশ কিছু মার্কিন সেনাও ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, হ্যাকিংয়ের কাজে রাশিয়া অত্যাধুনিক নজরদারির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। চালকবিহীন ড্রোন এবং ভূমিতে অবস্থিত পোর্টেবল টেলিফোন অ্যান্টেনার মাধ্যমে তৈরি অ্যাকসেস পয়েন্ট ব্যবহার করে তারা স্মার্ট ফোনগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে তারা ন্যাটোর সৈন্যদের প্রকৃত সংখ্যা, সেনা ঘাঁটিগুলো সম্পর্কিত তথ্য, তাদের দৈনন্দিন কার্যাবলি, পরিকল্পনা প্রভৃতি জানার চেষ্টা করে। রাশিয়া অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।  এদিকে মার্কিন নির্বাচনেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে প্রচার করেছে রাশিয়ান হ্যাকাররা এমন অভিযোগও ওঠে এ বছরের শুরুতে।

 

হ্যাকিংয়ের কবল থেকে বাদ যায় না পাওয়ার গ্রিড

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। এ সম্পর্কে সতর্কবার্তাও দেওয়া হয়। ব্ল্যাক হেট ও ডেফ কনের গবেষকরা এ তথ্য জানিয়েছেন। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব নাজুক। গবেষক রবার্ট এম লি বলেছেন, পাওয়ার গ্রিড যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের জানতে হবে, এ ধরনের হামলা হতে পারে। এ জন্য সতর্ক থাকতে হবে। সতর্কবার্তাটি পাওয়ার গ্রিডগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাকে স্ক্যান করতে সাহায্য করবে। এর মাধ্যমে পাওয়ার গ্রিডের কন্ট্রোলাররা হ্যাকারদের অনধিকার প্রবেশের ব্যাপারটি সঙ্গে সঙ্গেই জানতে পারবেন এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। এ বিষয়ে গবেষণা করেন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষক দল। তারা পরবর্তীতে হামলার একটি ভিজ্যুয়াল মডেল তৈরি করে দেখান। তারা এর মাধ্যমে দেখিয়েছেন কত সহজে হ্যাকাররা পাওয়ার গ্রিডে আক্রমণ চালাতে পারেন। তিনজনের এই দল একটি সফটওয়্যারে পাওয়ার গ্রিডের ছবি আঁকে। এরপর হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে কীভাবে পুরো নেটওয়ার্কটি অকার্যকর করে দেওয়া সম্ভব তা ব্যাখ্যা করেন। হ্যাকাররা ইউক্রেনের পাওয়ার গ্রিড দুবার বন্ধ করে দেন। ইউক্রেনে সংঘটিত ম্যালওয়্যার হামলাটি ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল।

ব্যাপক আলোচিত এ ঘটনাটির পর সারা বিশ্ব নড়েচড়ে বসে। কীভাবে পাওয়ার গ্রিড হ্যাকিং বন্ধ করা যায় এ বিষয়ে তোড়জোড় শুরু হয়।  সে ঘটনায় ইউক্রেনের তিনটি পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

 

হাজার হাজার জি-মেইল ব্যবহারকারীর -মেইল পাসওয়ার্ড প্রকাশ

তথ্য চুরি, গোপন তথ্য ফাঁস, ই-মেইলের পাসওয়ার্ড হ্যাক করা, সার্ভার কিংবা ওয়েবসাইটকে পুরোপুরি গায়েব করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে গত কয়েক বছর ধরেই। ই-পর্নোগ্রাফি, যৌন হয়রানির ব্যাপকতাও বেড়েছে। তেমনই কয়েকটি ঘটনা- ই-মেইল হ্যাকিং : ই-মেইল হ্যাকিং অনেকের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জি-মেইলের মতো ফ্রি ই-মেইল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছে হ্যাকারদের দিয়ে। ২০১১ সালে হাজার হাজার জি-মেইল ব্যবহারকারীর ই-মেইল ও পাসওয়ার্ড প্রকাশ করে দিয়েছে হ্যাকারদের একটি দল। এরপর ২০১৩ সালেও এরকম ঘটনা ঘটে ইয়াহু ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে। লাখ লাখ অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছিল সেবার। এরপরও নানা সময় বিশ্বে ই-মেইল হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটে আসছে। চুরি হয়েছে অগণিত মানুষের তথ্য। 

উইকিলিকস : উইকিলিকস ওয়েবসাইট। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি করা তথ্যের বিশ্বকাঁপানো ওয়েবসাইট। এটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসে মার্কিন সরকারের গোপন দলিল ফাঁস করে দেওয়ার জন্য। তথ্য গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

পেপাল : পেপাল অর্থ বিনিময়ের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। অনেকের আস্থাভাজন এই প্রতিষ্ঠানটিও হ্যাকারদের আক্রমণের মুখে পড়ে। আমেরিকাকে সহায়তার অভিযোগে হ্যাকাররা কিছু সময়ের জন্য এর সেবা বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম হয়।

সনি প্লে স্টেশন : ২০১১ সালের সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় ছিল বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানি সনি প্লে স্টেশন সার্ভার হ্যাক হওয়া। এতে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানির প্রতি মানুষের আস্থা কমতে থাকে।  যদিও পরবর্তীতে তারা হ্যাকিং রোধে নানা ব্যবস্থা নেয়।

 

ডিজিটাল মুদ্রার ইতিহাসে বড় হ্যাকিংয়ের ঘটনা

ক্রিপ্টোকারেন্সি এখন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নানারকম ক্রিপ্টোকারেন্সি এখন পাওয়া যাচ্ছে। যদিও এই লেনদেন এখন বিশ্বের সব দেশে অনুমোদিত নয়। তবে ক্রিপ্টোকারেন্সি হ্যাক করার ঘটনা বিশ্বে এখন অহরহ ঘটছে। এত বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরি করার ঘটনাটি আলোচিত হয়েছিল। এটিকে বলা হচ্ছে ডিজিটাল মুদ্রার ইতিহাসে একটি বড় হ্যাকিংয়ের চাঞ্চল্যকর ঘটনা। রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ৬০০ মিলিয়ন ডলারের ক্রিপ্টোকারেন্সি হ্যাক করে হ্যাকাররা (বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ৫ হাজার ৯০ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার টাকার সমান)। খবর ফোর্বসের। পলি নেটওয়ার্কও জানিয়েছে, হ্যাকাররা মোট ১৯৩ মিলিয়ন পাউন্ডের এথারিয়াম হ্যাক করেছে। শুধু তাই নয়, ৬০০ মিলিয়ন ডলারের ক্রিপ্টোকারেন্সি হ্যাকের পাশাপাশি তারা ১৮২ মিলিয়ন পাউন্ডের বাইন্যান্স কয়েন এবং ৬১ দশমিক ৫ মিলিয়ন পাউন্ডের ইউএসডিসি কয়েন সরিয়েছে।  এ ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে।

 

ইসরায়েলি সংস্থার হ্যাকিংয়ের শিকার ভারত

২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে খবরের শিরোনামে আসে পেগাসাস। ভারতের বহু মন্ত্রী, বিরোধী নেতা, সাংবাদিকের ফোন হ্যাক করে ইসরায়েলি সংস্থার স্পাইওয়্যার পেগাসাস। দ্য ওয়্যার-এর রিপোর্ট তেমনই দাবি করে কিছু দিন আগেই। রিপোর্টে বলা হয়, দ্য হিন্দুস্তান টাইমস, ইন্ডিয়া টুডে, নেটওয়ার্ক ১৮, দ্য হিন্দু এবং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসসহ বেশ কিছু বড় সংবাদমাধ্যমের শীর্ষ স্তরের সাংবাদিকদের ফোন হ্যাক করা হয়েছে। ফোন হ্যাকিংয়ের তালিকায় মন্ত্রী এবং সাংবাদিক ছাড়াও রয়েছেন বহু ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, বিজ্ঞানী এবং সমাজকর্মী। দ্য ওয়্যার-এর তথ্য বলছে, বেশির ভাগ হ্যাক করা হয়েছে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে। দ্য ওয়্যার-এর রিপোর্টে আরও দাবি করা হয়েছে, হ্যাকিংয়ের তালিকায় রয়েছে ৪০ জনেরও বেশি সাংবাদিক। তিনজন বিরোধী নেতা। মোদি মন্ত্রিসভার দুই মন্ত্রী। দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর বর্তমান ও প্রাক্তন প্রধান এবং বহু ব্যবসায়ী। যদিও ভারত সরকার হ্যাকিংয়ের বিষয়টি অস্বীকার করে। পাল্টা দাবি করেছে, ফোনে আড়ি পাতা নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তার কোনো ভিত্তি নেই। সরকারের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, ভারত একটি মজবুত গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে সব নাগরিকের  গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি সুনিশ্চিত করা হয়। 

 

হ্যাকিংয়ে ব্যাংক লুট

রাশিয়ান হ্যাকাররা ৬৫০ মিলিয়ন ইউরো লুট করে

৬৫০ মিলিয়ন ইউরো সরিয়ে ফেলে হ্যাকাররা। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ব্যাংক লুটের ঘটনা এটি। ব্রিটিশ ব্যাংক থেকে এত বড় অঙ্কের টাকা লুটে নেয় একদল রাশিয়ান হ্যাকার। কমপক্ষে ১০০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। হ্যাকাররা ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে সিস্টেম ব্যবহার করে। সেখানে ম্যালওয়্যার ছড়িয়ে দেয়। এতে ব্যাংকের লেনদেন তথ্য ও অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারীদের তথ্য হাতে পেয়ে যায় হ্যাকাররা। ধীরে ধীরে পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা টাকা সরাতে শুরু করে। সবার অলক্ষ্যে এ বিপুল পরিমাণ টাকা তারা বৈধ লেনদেনের আদলেই লুটে নেয়। আতঙ্কের কথা ৬৫০ মিলিয়ন ইউরো বলা হলেও আসলে সেটি ঠিক কি না বলা কঠিন। কারণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এখনো সত্যিকারের অঙ্কটি প্রকাশ করেনি। ব্যাংকের লেনদেনবিষয়ক সিস্টেম যাচাই-বাছাই করে জানা যায়, একটি ই-মেইলের মাধ্যমে ম্যালওয়্যারটি তাদের সিস্টেমে ঢুকে পড়ে। তারপর সেটি অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা পাঠাতে শুরু করে। হ্যাকাররা সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ এমনভাবে নিয়েছিল, যাতে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর পর্যায়েও সেটি ধরা পড়েনি। তারা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লেনদেনগুলো অন্তত চার মাস ধরে চলেছিল। এ তো গেল ব্যাংক। এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনারও বহু উদাহরণ রয়েছে। তেমনই এক ঘটনা ঘটে ‘গ্লোবাল পেম্যান্টস ইনকরপোরেশন’-এ।

গ্লোবাল পেম্যান্টস ইনকরপোরেশনের এটিএম জালিয়াতি

আটলান্টার এ প্রতিষ্ঠানটি ১.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হারায় হ্যাকারদের কবলে পড়ে। ২০১২ সালের ফেব্র“য়ারিতে এ ঘটনাটি ঘটে। ভিসা, মাস্টার কার্ড তাদের সতর্ক করে দেয় এই বলে যে, তাদের প্রতিষ্ঠানের ক্রেডিট কার্ডের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ২০১১ সালে এ নিয়ে বেশ কয়েকটি কনফারেন্সও হয়। তাদের প্রতিষ্ঠানটি নির্ভরযোগ্য বলে প্রতীয়মান হলে সে সময় আর মাথা ঘামানো হয়নি। অবশ্য মূল ঘটনাটি ঘটে কয়েক মাস পর। তাদের কিছু কিছু ব্রাঞ্চ অভিযোগ করে, তাদের লেনদেনগুলো স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। ভিসা, মাস্টার কার্ড জালিয়াতি চক্রের খপ্পরে পড়েছে তারা। অবৈধ ও অস্বাভাবিক লেনদেনবিষয়ক নিরাপত্তা জোরদার করে তারা। তবে এর পূর্বপ্রস্তুতি যথেষ্ট ছিল না। হ্যাকাররা তাদের সিস্টেমে প্রবেশ করে তছনছ করে দেয় সবকিছু। শুরুতে ১.৫ মিলিয়ন ডলার হাতছাড়া হওয়ার কথা জানা গেলেও শেষে জানা গেল অঙ্কটি ৯৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এ অঙ্কটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অবশ্য পরিশেষে বলে ৩৬ মিলিয়ন ডলার সেখানে ফাইন ও তদন্তের জন্য আরও ৬০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল তারা।

ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ে স্টার ভ্লাদিমির লেভিন

ভ্লাদিমির লেভিন হলেন ১৯৪০-এর জেমস বন্ড। রাশিয়ান বংশোদ্ভূত ভ্লাদিমির ছিলেন একজন মেধাবী গণিতজ্ঞ। সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেট ইনস্টিটিউট থেকে বায়োক্যামেস্ট্রি নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৪৪ সালে ভ্লাদিমির ১০ মিলিয়ন ডলার ট্রান্সফার করেন নিজের অ্যাকাউন্টে ডায়েল আপ ওয়ার ট্রান্সফার সার্ভিসের মাধ্যমে। ফিনল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ইসরায়েলের মতো বিভিন্ন দেশের সিটি ব্যাংকের কয়েক  হাজার অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন তিনি।

 

হ্যাকিং হ্যাকার

হ্যাকিং শব্দটি প্রযুক্তিবিদদের কাছে বেশ পরিচিত। তরুণরা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার খোঁজে হ্যাকিং শুরু করে। শুরুতে শখের বশে, পরে কেউ কেউ পেশাদার হয়ে ওঠে। হ্যাকিং এবং হ্যাকার শব্দ দুটি তাই কিশোরদের আকৃষ্ট করে। হ্যাকিং মূলত একটি পদ্ধতি, যা মেনে কেউ বৈধ অনুমতি ছাড়া কোনো কম্পিউটার বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ঢুকে থাকে। যারা এ হ্যাকিং করে তাদের বলা হয় হ্যাকার। হ্যাকিং অনেক ধরনের হতে পারে। আমাদের মোবাইল ফোন, ল্যান্ড ফোন, গাড়ি ট্র্যাকিং, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ও ডিজিটাল যন্ত্র বৈধ অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে সেটিকেও হ্যাকিং বলা যায়। হ্যাকাররা সাধারণত এসব ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রের ত্র“টি বের করে তা দিয়েই হ্যাক করেন। হ্যাকিংয়ের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। তার ওপরই নির্ভর করে হ্যাকিং ঠিক কতখানি সাইবারক্রাইম।

 

হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার

হ্যাকিং শব্দটি মাথায় এলে অনেকেই ভেবে বসেন এটি পুরোপুরি অননুমোদিত কাজ। অথচ হ্যাকারদের একটি দল রয়েছে, যারা হ্যাকিং করেন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কম্পিউটিং ব্যবস্থা আরও নিরাপদ ও নিখুঁত করতে। তারা হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে সিস্টেমের নিরাপত্তা ত্র“টি খুঁজে বের করে সেটি ঠিক করে দেন। এটি হতে পারে একটি কম্পিউটার, একটি কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, একটি সার্ভার বা কোনো ওয়েবসাইট। এ হ্যাকারদের বলা হয় হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার।

 

 

গ্রে হ্যাট হ্যাকার

ভালো ও মন্দের মাঝামাঝি জায়গাটি গ্রে হ্যাট হ্যাকারদের। বিশ্বে গ্রে হেট হ্যাকারদের সংখ্যাই বেশি। এরা বেশির ভাগ সময়ই হোয়াইট হ্যাট হ্যাকারদের মতো কাজ করে থাকেন। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এরা ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে নিজে বা ভাড়ায় আক্রমণ করে বসেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নেটওয়ার্কে। এরা অনেকটা ভবঘুরের মতো অন্তর্জালের দুনিয়া ঘুরে বেড়ান। নিজ মনমতো কাজ করেন। এরা কখনো সিকিউরিটি সিস্টেমের মালিককে ত্র“টি জানিয়ে সাহায্য করেন, কখনো করেন ক্ষতি।

 

 

ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার

হ্যাকিং শব্দটির মূল আতঙ্ক তারাই। বছরের পর বছর ধরে হ্যাকিং শব্দটিতে আতঙ্ক মিশিয়েছেন এরা। ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকাররা সবচেয়ে দুর্ধর্ষ হ্যাকার হয়ে থাকেন। তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি ছোট-বড় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। তারা কোনো সিকিউরিটি সিস্টেমের ত্রুটি খুঁজে পেলে দ্রুত সেটি নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন। কখনো পুরো সিস্টেম নষ্ট করে দেন বিভিন্ন ভাইরাস ছড়িয়ে। এরা এমন ব্যবস্থা করে রাখতে সক্ষম যেন ভবিষ্যতে আবার সেই সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর