রবিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

নোবেল পুরস্কার ২০২১

নোবেল পুরস্কার ২০২১

পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক নোবেল পুরস্কার প্র্রবর্তিত হয় ১৯০১ সালে। ওই বছর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সফল এবং অনন্য সাধারণ গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং মানবকল্যাণমূলক কর্মকান্ডের জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। মোট ছয়টি বিষয়ে পুরস্কার দেওয়া হয়। বিষয়গুলো হলো- পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, অর্থনীতি, সাহিত্য এবং শান্তি। ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিভাগে ঘোষিত হয়েছে ২০২১ সালের নোবেল বিজয়ীদের নাম। এবার বিশ্ব তোলপাড় হয়েছে দুই সাংবাদিকের শান্তিতে নোবেল জয়ে। এ ছাড়া মাত্র ১০টি উপন্যাস লিখে সাহিত্যে নোবেল জিতে তানজানিয়ার ঔপন্যাসিক গুরনাহ বিস্ময় জাগিয়েছেন। নোবেল জয়ীদের নিয়ে আজকের রকমারি। লিখেছেন - তানভীর আহমেদ

 

প্রেসিডেন্টের প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে লিখে সাংবাদিকের শান্তিতে নোবেল

এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছেন দুই সাংবাদিক। তারা হলেন- ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা ও রাশিয়ার সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ। নোবেল কমিটি এ যুগলকে ‘এমন ভূমিকা রাখা সব সাংবাদিকের প্রতিনিধি’ হিসেবে অভিহিত করে। ৫৮ বছর বয়সী ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা সিএনএনে কাজ করে সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেন। প্রায় দুই দশক কাটিয়েছেন সিএনএনের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান অনুসন্ধানী প্রতিবেদক হিসেবে। এ বছর নোবেল পুরস্কারের জন্য তার নাম পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী জোনাস গহর স্টের। মারিয়া রেসার অবদান প্রসঙ্গে নোবেল কমিটির মন্তব্য, তিনি জন্মস্থান ফিলিপাইনে ক্ষমতার অপব্যবহার, সহিংসতা ও ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশের লড়াই অব্যাহত রেখেছেন। তার সাংবাদিকতার জীবনের দিকে ফিরে তাকালে উল্লেখযোগ্য দিক হিসেবে উঠে আসবে দেশটির প্রেসিডেন্ট দুতার্তের নানা প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা।

মারিয়া রেসা ফিলিপাইনের সংবাদমাধ্যম র‌্যাপলারের সহপ্রতিষ্ঠাতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে র‌্যাপলারের ৪৫ লাখ অনুসারী রয়েছে। বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। শুরু থেকে এই সংবাদমাধ্যমের প্রাণভোমরা হিসেবে কাজ করেছেন রেসা। প্রেসিডেন্ট দুতার্তের জনবিরোধী কর্মকান্ড এবং নীতির কড়া সমালোচনাকারী অন্যতম সংবাদমাধ্যমের ভূমিকায় রয়েছে র‌্যাপলার। বিশেষ করে মাদকের বিরুদ্ধে কথিত যুদ্ধের নামে বিচারবহিভর্‚ত হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নারী বিদ্বেষের বিরুদ্ধে অসংখ্য প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ প্রকাশ করে এ সংবাদমাধ্যমটি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রেসিডেন্টের পক্ষে নানা প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধেও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে প্রতিষ্ঠানটি। এ জন্য একাধিক হুমকি-ধমকি ও মামলা মোকাবিলা করতে হয়েছে। মারিয়া রেসা ও র‌্যাপলারকে অপরাধীও সাব্যস্ত করে দেশটির আদালত। ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সালে ব্যবসায়ী উইলফ্রেডো কেং সম্পর্কিত একটি মিথ্যা সংবাদ র‌্যাপলারে প্রকাশ করার অভিযোগে তাকে সাইবারলাইবেলের জন্য গ্রেফতার করা হয়। পরের বছর ১৫ জুন ম্যানিলার একটি আদালত তাকে সাইবারলাইবেলের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে। রেসাকে বিশ্বের ভুয়া সংবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এমন সাংবাদিকদের একজন হিসেবে টাইমস পারসন অব দ্য ইয়ার ২০১৮-তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

 

মাত্র ১০টি উপন্যাস লিখে সাহিত্যে নোবেল জয়

তানজানিয়ায় জন্ম নেন আবদুলরাজাক গুরনাহ। তবে সেখানে আর থাকা হয়নি। শরণার্থী হিসেবে ১৯৬০ সালে যুক্তরাজ্যে চলে যান। এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নিয়েছেন তিনি। ‘প্যারাডাইস’ নামে উপন্যাসের জন্য তিনি এ সম্মাননা পেলেন। ১৯৪৮ সালে গুরনাহ তানজানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ভারত মহাসাগরের জানজিবার দ্বীপে তিনি বেড়ে ওঠেন। কিন্তু ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে ইংল্যান্ডে আসেন শরণার্থী হয়ে। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয় জানজিবার। প্রেসিডেন্ট আবেইদ কারুমের শাসনে সেখানে আরব বংশো™ভূত নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়েছে। পরে স্কুল শেষ করে আট বছর বয়সে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। ১৯৮৪ সালের আগে তিনি জানজিবারে ফিরতে পারেননি। কেবল বাবার মৃত্যুর আগে তার একবার দেখার সুযোগ হয়েছিল। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব কেন্টের ইংরেজি ও ঔপনিবেশিক-উত্তর সাহিত্যের অধ্যাপনা থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন। তিনি ওয়াসাফিরি নামের একটি জার্নালে সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ঔপন্যাসিক হিসেবেই তিনি সবার নজর কেড়েছেন। গুরনাহ মূলত ইংরেজিতে লেখেন। লিখেছেন মাত্র ১০টি উপন্যাস। তার বিখ্যাত কয়েকটি উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে প্যারাডাইস (১৯৯৪), বাই দ্য সি (২০০১), এবং ডেজারশন (২০০৫)। এ ছাড়াও তিনটি ছোটগল্পের বই এবং প্রবন্ধ রয়েছে তার। ৭৩ বছর বয়সী গুরনাহর বিখ্যাত উপন্যাস ‘প্যারাডাইস’। এ উপন্যাসটি ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসে বিশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তানজানিয়ায় এক কিশোরীর বেড়ে ওঠার গল্প বর্ণনা করা হয়েছে নিপুণভাবে। সুইডিশ একাডেমি বলেছে, আবদুলরাজাক গুরনাহের আপসহীন ও দরদি লেখায় উপনিবেশিকতার দুর্দশা আর শরণার্থীদের জীবনের নানা কষ্ট-বঞ্চনার গল্প ফুটে উঠেছে। আবদুলরাজাকের সর্বশেষ উপন্যাস ডেজারশন (২০০৫)। এটির জন্য ২০০৬ সালে কমনওয়েলথ সাহিত্য পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন এবং পরে দ্য লাস্ট গিফটের (২০১১) জন্যও পুরস্কৃত হন তিনি।

 

শাসকদের অনিয়মের প্রতিবেদন ছেপে হুমকি নির্যাতন সহ্য করে নোবেল

শান্তিতে নোবেল পাওয়া আরেকজন সাংবাদিকের নাম দিমিত্রি মুরাতভ। ৫৯ বছর বয়সী মুরাতভ রাশিয়ার অনুসন্ধানী সংবাদপত্র নোভায়া গেজেটের প্রধান সম্পাদক। মাত্র দুটি কম্পিউটার, দুটি কক্ষ, একটি প্রিন্টার দিয়ে শুরু হয়েছিল ‘নোভায়া গেজেট’ পত্রিকা। ছিল না কর্মীদের বেতন। এক পর্যায়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ। তার পুরস্কারের অর্থের একটি অংশ দেন এই পত্রিকায় কর্মরতদের বেতন ও কম্পিউটার কেনার জন্য। সেই টাকায় কেনা একটি কম্পিউটার এখনো পত্রিকাটির অফিসে প্রদর্শনী হিসেবে রাখা আছে। রাশিয়ার অনুসন্ধানী সংবাদপত্র নোভায়া গেজেট ১৯৯৩ সালে প্রকাশ হয়। শুরুতে নোভায়া গেজেটে তাকে বানানো হয় ডেপুটি প্রেস এডিটর। প্রথম চেচেন যুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতিনিধি হয়ে ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকতা করেন দিমিত্রি মুরাতভ। ১৯৯৫ সালে তাকে এ পত্রিকাটির সম্পাদকীয় পরিষদের প্রধান করা হয়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন। তারপর আর এ পদে প্রতিদ্ধন্ধিতা করেননি। ২০১৯ সালে তিনি আবার নির্বাচন করেন। তাতে তিনি আবারও নোভায়া গেজেটের সম্পাদকীয় পরিষদের প্রধান নির্বাচিত হন। রাশিয়ার ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের এবং বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কড়া সমালোচক গুটিকয় সংবাদপত্রের একটি এই নোভায়া গেজেট। পত্রিকাটি সপ্তাহে ছাপা হয় তিনবার, তাতে নিয়মিতভাবে দুর্নীতির অভিযোগ এবং শাসকদের নানা অনিয়মের বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থাকে। তুলে ধরা হয় নির্যাতনের শিকার সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের চিত্র। দিমিত্রি মুরাতভের সময়ে নোভায়া গেজেট পত্রিকার ছয়জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। চেচনিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রতিবেদনসহ আরও বেশ কিছু সংবাদের কারণে পত্রিকাটিকে হেনস্তা এবং হুমকি মোকাবিলা করতে হয়েছে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে রাশিয়ার এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী একটি রিপোর্ট লেখেন সাংবাদিক ডেনিস কোরোতকভ। তা প্রকাশিতও হয় নোভায়া গেজেটে। এর পরই ডেনিস কোরোতকভ এবং নোভায়া গেজেটের প্রধান সম্পাদককে হুমকি দিয়ে তাদের অফিসের গেটে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ছাগলের মাথা ও অন্ত্যেষ্টেক্রিয়ার সময় দেওয়া ফুলের তোড়া। মুরাতভ ১৯৬১ সালে কুইবিশেভে জন্মগ্রহণ করেন। কলেজে পড়ার সময়ই তিনি স্থানীয় সংবাদপত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং খন্ডকালীন সাংবাদিকতার কাজ শুরু করেন।

 

চিকিৎসাবিজ্ঞানে দুই বিজ্ঞানীর বাজিমাত

‘তাদের আবিষ্কার জানতে সাহায্য করেছে যে, কীভাবে গরম, ঠান্ডা এবং যান্ত্রিক শক্তি স্নায়ুর উত্তর দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে থাকে। যা পারিপার্শ্বিক দুনিয়ার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ এবং সেই দুনিয়ার সঙ্গে খাপখাইয়ে নিতে সাহায্য করে থাকে।’

চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড জুলিয়াস ও লেবাননের আরডেম পাতাপোশিয়ান। তাপমাত্রা ও স্পর্শের জন্য রিসেপ্টর আবিষ্কারের গবেষণায় চিকিৎসায় তারা যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান। নোবেল অ্যাসেম্বলি জানায়, তাদের আবিষ্কার জানতে সাহায্য করেছে যে, কীভাবে গরম, ঠান্ডা এবং যান্ত্রিক শক্তি স্নায়ুর উত্তর দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে থাকে। যা পারিপার্শ্বিক দুনিয়ার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ এবং সেই দুনিয়ার সঙ্গে খাপখাইয়ে নিতে সাহায্য করে থাকে। নোবেল কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল থমাস পার্লমান বলেন, এটা সত্যিই প্রকৃতির অন্যতম গোপন বিষয়কে উন্মোচিত করেছে। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অসামান্য আবিষ্কার। নোবেল কমিটির তরফে জানানো হয়েছে, লাল মরিচের সক্রিয় উপাদান ক্যাপসেসিন ব্যবহার করে স্নায়ুর উদ্দীপককে চিহ্নিত করেছেন সান ফ্রান্সিসকোর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জুলিয়াস। যা ত্বককে তাপমাত্রায় সাড়া দিতে সাহায্য করে থাকে। অন্যদিকে, কোষে ভিন্ন ধরনের চাপ সংবেদনশীল উদ্দীপকের সন্ধান পেয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়ার লা জোল্লার স্ক্রিপস রিসার্চের মলিকিউলার বায়োলজিস্ট (আণবিক জীববিজ্ঞানী) এবং নিউরো-সায়েন্টিস্ট (স্নায়ুবিজ্ঞানী) আরডেম। যা যান্ত্রিক উদ্দীপকে সাড়া দেয়। জুরি জানান, আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এসব অনুভূতিকে স্বাভাবিক বলে আমরা ধরে নিই, তবে কী করে স্নায়ুর অনুভব শুরু হয় যা আমাদের তাপ ও চাপ উপলব্ধি করার ক্ষমতা জোগায়, তা তো আমরা জানি না, সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এ বছরের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরাও। সান ফ্রান্সিসকোর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জুলিয়াস এবং ক্যালিফোর্নিয়ার স্ক্রিপস রিসার্চের অধ্যাপক, পাতাপোশিয়ান মিলিতভাবে ১০ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনোর বা ১ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার বা ১ মিলিয়ন ইউরো পাচ্ছেন। গত বছর হেপাটাইটিস সি ভাইরাস আবিষ্কারের জন্য তিনজন ভাইরোলজিস্টকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।

 

অণু তৈরির নতুন কৌশল আবিষ্কার

রসায়নে নোবেল পেয়েছেন জার্মানির বেনজামিন লিস্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড ম্যাকমিলান। ‘অ্যাসাইমেট্রিক অর্গানোক্যাটালাইসিস’ নামে অণু তৈরির নতুন এক কৌশল আবিষ্কার করে এ সম্মাননা জিতে নিয়েছেন তারা। অপ্রতিসম অর্গানোক্যাটালাইসিস বা জৈব-অনুঘটন আবিষ্কারের জন্য এ পুরস্কার পান তারা। নতুন ধরনের অনুঘটক ব্যবহার করে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে অণু গঠনের কৌশল উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে ওষুধশিল্পের জন্য নতুন দুয়ার উন্মোচন হলো। তাদের গবেষণা রাসায়নিক প্রক্রিয়া বা উৎপাদন-পদ্ধতিকে আরও পরিবেশবান্ধব বা সবুজ করেছে। বেনজামিন লিস্ট ও ডেভিড ম্যাকমিলানের আবিষ্কারের আগে সব প্রভাবককে দুই ভাগে ভাগ করা যেত। এগুলো হলো ধাতু ও এনজাইম। এই দুই বিজ্ঞানীর আবিষ্কারে তৃতীয় ধরনের অনুঘটন প্রক্রিয়া জানা গেল। অ্যাসাইমেট্রিক অর্গানোক্যাটালাইসিস বা অপ্রতিসম জৈব অনুঘটন প্রক্রিয়ায় অতিক্ষুদ্র জৈব অণু প্রভাবক হিসেবে ব্যবহার হয়। বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকীগুলো জানিয়েছে, তাদের কাজের ফলে শুধু ওষুধ নয়, সোলার সেল বা সৌরকোষে আলো ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় অণু দ্রুত ও কার্যকরভাবে বানানো সম্ভব হচ্ছে। এ কারণেই বেনজামিন লিস্ট ও ডেভিড ম্যাকমিলানের কাজ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নোবেল কমিটি ফর কেমিস্ট্রির প্রধান জোয়ান একভিস্ট বলেন, অনুঘটনের জন্য এ ধারণা সিম্পলি অসাধারণ। অনেকে জেনে খুব অবাক হবে এ কারণে যে, বিষয়টি কেন আগে আমাদের মাথায়ই এলো না।

 

পদার্থবিজ্ঞানে তিন বিজ্ঞানীর চমক

‘পৃথিবীর জলবায়ু এবং এর ওপর মানুষের কর্মকান্ডের প্রভাব বুঝতে মানাবে ও হ্যাসেলমেনের আবিষ্কার প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।’

২০২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ইতালির তিন বিজ্ঞানী। তারা হলেন- আবহাওয়াবিদ সাইকুরো মানাবে, পদার্থবিদ ক্লাউস হ্যাসেলমেন এবং সমুদ্রবিজ্ঞানী জর্জিও প্যারিসি। নোবেল কমিটির ওয়েবসাইটে বলা হয়, বৈশ্বিক উষ্ণতার পূর্বাভাস দেওয়া এবং কমপ্লেক্স ফিজিক্যাল সিস্টেম সম্পর্কে বোঝাপড়ার বিষয়ে যুগান্তকারী অবদানের জন্য তাদের এ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। পৃথিবীর জলবায়ু পরিস্থিতির ফিজিক্যাল বা ভৌত মডেল তৈরি, পরিবর্তনশীলতা পরিমাপ এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার বিষয়টি নির্ভরযোগ্যভাবে অনুমানের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন সাইকুরো মানাবে এবং ক্লাউস হ্যাসেলমেন। তারা দুজনে এ বছরের নোবেল পুরস্কারের অর্ধেক পেয়েছেন। নোবেল পুরস্কারের বাকি অর্ধেক জর্জিও প্যারিসি পেয়েছেন পারমাণবিক ও গ্রহীয় পরিসরে ভৌত ব্যবস্থা বা ফিজিক্যাল সিস্টেমের বিশৃঙ্খলা ও ফ্লাকচুয়েশন পরস্পরের ওপর কী প্রভাব ফেলে তা আবিষ্কারের জন্য। সুইডিশ নোবেল কর্তৃপক্ষ বলেছে, পৃথিবীর জলবায়ু এবং এর ওপর মানুষের কর্মকান্ডের প্রভাব বুঝতে মানাবে ও হ্যাসেলমেনের আবিষ্কার প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৬০-এর দশকে মানাবে তার আবিষ্কারের মাধ্যমে দেখিয়েছেন কীভাবে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাইঅক্সাইড বেড়ে গিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঘটছে। তার আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করেই বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের মডেলগুলো তৈরি করা হচ্ছে। এর প্রায় এক দশক পর হ্যাসেলমেন দেখান, আবহাওয়া ও জলবায়ু আপাত সম্পর্কহীন মনে হলেও কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন আবহাওয়ার ওপর প্রভাব ফেলছে। মানুষ কীভাবে জলবায়ুকে প্রভাবিত করছে সেটিও সুনির্দিষ্টভাবে দেখিয়েছেন তিনি। পুরস্কার ঘোষণা হওয়ার পর প্যারিসি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আমাদের কঠিন সিদ্ধান্তগুলো দ্রুতগতিতে নিতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে আমাদের এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিজয়ীদের মধ্যে সাইকুরো মানাবের জন্ম ১৯৩১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর, জাপানে। ক্লাউস হ্যাসেলমেনের জন্ম ১৯৩১ সালের ২৫ অক্টোবর, জার্মানির হামবুর্গে এবং ১৯৪৮ সালের ৪ আগস্ট ইতালির রোমে জন্মগ্রহণ করেন জর্জিও প্যারিসি।

 

ডিনামাইট উদ্ভাবকের নামে প্রবর্তিত

১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার প্রদান শুরু হয়। বর্তমান পৃথিবীতে এটিই সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত। ১৯০১ সাল থেকেই বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সফল এবং অনন্য সাধারণ গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং মানবকল্যাণমূলক তুলনারহিত কর্মকান্ডের জন্য এ পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। মোট ছয়টি বিষয়ে পুরস্কার প্রদান করা হয়। বিষয়গুলো হলো- পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, অর্থনীতি, সাহিত্য এবং শান্তি। সুইডেনের বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের ১৮৯৫ সালে করে যাওয়া একটি উইলের মর্মানুসারে নোবেল পুরস্কার প্রচলন করা হয়। নোবেল মৃত্যুর আগে উইলের মাধ্যমে এ পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা করে যান। শুধু শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় অসলো, নরওয়ে থেকে। বাকি ক্ষেত্রে স্টকহোম, সুইডেনে এ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। অর্থনীতি ছাড়া অন্য বিষয়গুলোতে ১৯০১ সাল থেকে পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতিতে পুরস্কার প্রদান শুরু হয়েছে ১৯৬৯ সালে। আলফ্রেড নোবেল তার উইলে অর্থনীতির কথা উল্লেখ করেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৪০ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত পুরস্কার প্রদান বন্ধ ছিল। প্রতিবছর পুরস্কারপ্রাপ্তদের প্রত্যেকে একটি স্বর্ণপদক, একটি সনদ ও নোবেল ফাউন্ডেশন কর্তৃক কিছু পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন। ২০১২ খ্রিস্টাব্দে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ৮০ লাখ সুইডিশ ক্রোনা। নোবেল পুরস্কার মৃত কাউকে দেওয়া হয় না। লরিয়েটকে অবশ্যই পুরস্কার প্রদানের সময় জীবিত থাকতে হবে। আলফ্রেড নোবেল, নোবেল পুরস্কারের প্রবক্তা। আলফ্রেড নোবেল, ২১ অক্টোবর ১৮৩৩ সালে সুইডেনের স্টকহোমে একটি প্রকৌশল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে রসায়নবিদ, প্রকৌশলী ও একজন উদ্ভাবক ছিলেন। ১৮৯৪ সালে তিনি একটি লোহা ও ইস্পাত কারখানা ক্রয় করেন, যা পরে একটি অন্যতম অস্ত্র তৈরির কারখানায় পরিণত করেন। তিনি ব্যালাস্টিক উদ্ভাবন করেন, যা বিশ্বব্যাপী ধোঁয়াবিহীন সামরিক বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ৩৫৫টি উদ্ভাবনের মাধ্যমে তিনি জীবদ্দশায় প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হন, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ডিনামাইট। ১৮৮৮ সালে তিনি মৃতদের তালিকা দেখে বিস্মিত হন, যা একটি ফরাসি পত্রিকায় এ মার্চেন্ট অব ডেথ হু ডেড প্রকাশিত হয়।  নোবেলের ভাই লুডভিগ মারা যান। এ নিবন্ধটি তাকে ভাবিয়ে তোলে এবং খুব সহজেই বুঝতে পারেন যে, ইতিহাসে তিনি কীভাবে স্মরণীয় হতে চান, যা তাকে তার উইলটি পরিবর্তন করতে অনুপ্রাণিত করে। ১০ ডিসেম্বর ১৮৯৬ সালে আলফ্রেড নোবেল তার নিজ গ্রাম স্যান রিমো, ইতালিতে মৃত্যুবরণ করেন। সেই সময় তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। নোবেল তার জীবদ্দশায় অনেক উইল লিখে গিয়েছিলেন। সর্বশেষটা লেখা হয়েছিল তার মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে ২৭ নভেম্বর, ১৮৯৫ সালে প্যারিসে অবস্থিত সুইডিশ-নরওয়ে ক্লাবে। বিস্ময় ছড়িয়ে যায়, নোবেল তার সর্বশেষ উইলে উল্লেখ করেন যে তার সব সম্পদ পুরস্কার আকারে দেওয়া হবে, যারা পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, শান্তি ও সাহিত্যে বৃহত্তর মানবতার স্বার্থে কাজ করবেন। নোবেল তার মোট সম্পদের (৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা) ৯৪ শতাংশ এ পাঁচটি পুরস্কারের জন্য উইল করেন। ২৬ এপ্রিল, ১৮৯৭-এর আগ পর্যন্ত সন্দেহপ্রবণতার জন্য নরওয়ে থেকে এই উইল অনুমোদন করা হয়নি। নোবেলের উইলের সমন্বয়কারী রগনার সোলম্যান ও রুডলফ লিলজেকুইস্ট নোবেল ফাউন্ডেশন তৈরি করেন, যার কাজ তার সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। নোবেল পাঁচটি ক্ষেত্রে পুরস্কার দেওয়ার জন্য তার মোট সম্পত্তির শতকরা ৯৪ ভাগ দান করে যান। এর মোট পরিমাণ ৩১ মিলিয়ন এসইকে (৩.৪ মিলিয়ন ইউরো, ৪.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর