রবিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর প্রাকৃতিক বিস্ময়...

হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর প্রাকৃতিক বিস্ময়...

আশঙ্কা ছিল এবং তা সত্যিও হলো। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর ভূপ্রকৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। আগ্নেয়গিরি, ভূমিকম্প, বাতাস, পানি, সূর্যালোক প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা এর পরিবর্তন ঘটছে। হাজার হাজার বছর ধরে পরিবর্তনের ফলে সৃষ্টি হওয়া পাহাড়-উপত্যকা, নদী-নালা, বন-জঙ্গল, মরুভূমি কিংবা জলাশয়। যার  কিছু হারিয়ে গেছে।  অনেক প্রাকৃতিক বিস্ময় রূপ নিচ্ছে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে।

 

হিলারি স্টেপ, নেপাল

সুন্দর। কিন্তু ভয়ঙ্কর। পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি। বরফের সাম্রাজ্য জয় করার নেশায় বিপদের এ পথেই পা রাখেন পর্বতারোহীরা। কেউ বিপদকে জয় করেন। কেউ চলে যান ভয়ঙ্কর সুন্দরের অন্তরালে। আর কোনোদিন তাদের খোঁজ মেলে না। এভারেস্ট জয়ের হাতছানিতে অভিযাত্রীদের সবচেয়ে পরিচিত স্থানটি হলো ‘হিলারি স্টেপ’। পর্বত জয়ের শেষ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানটির নামকরণ হয়েছিল এভারেস্ট জয়ের প্রথম নায়ক এডমন্ড হিলারির নামে।

কিন্তু ২০১৫ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর থেকেই পর্বতারোহী মহল আশঙ্কা করছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ এ শৃঙ্গে ওঠার রাস্তাটি আর আগের মতো থাকবে না, বদল আসতে পারে অনেক। ঠিক যেমন বেস ক্যাম্প থেকে ক্যাম্প ওয়ানে যাওয়ার পথে যে খুম্বু আইসফল পড়ে সেখানে অনেক বেড়ে গেছে ক্রিভাস অর্থাৎ ফাটলের সংখ্যা। এভারেস্ট শৃঙ্গ থেকে খানিকটা নিচে, শৃঙ্গের দক্ষিণ-পূর্ব গা ঘেঁষে অবস্থিত ১২ মিটারের একটি বড় পাথুরে অংশ পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে ছিল। ওই অংশটি পেরোনো বেশ কঠিন ছিল পর্বতারোহীদের পক্ষে। ১৯৫৩ সালে স্যার এডমন্ড হিলারি প্রথম ওই অংশটি সফলভাবে পেরোন এবং এভারেস্ট শৃঙ্গে পা রাখেন। তারপর থেকেই ওই অংশটির নাম হয়েছে ‘হিলারি স্টেপ’। তামাম পর্বতারোহী মহলের স্বপ্নের পদক্ষেপ, যা পার করতে পারলেই ছোঁয়া যায় এভারেস্ট!

এ বছর ১৬ মে প্রথম সামিট শুরু হয় এভারেস্টে। সেই অভিযাত্রী দলের দলনেতা টিম মোসডেল নিশ্চিত করেছেন হিলারি স্টেপ আর নেই। তিনি আরও জানিয়েছেন, ভেঙে যাওয়া ওই পথ এবার আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে অভিযাত্রীদের জন্য। প্রতি বছরই এতে কয়েক ঘণ্টা নষ্ট হওয়ায় আটকে যায় অনেক সামিট। ঠান্ডায় ফ্রস্ট বাইটের শিকার হতে হয় অনেককে, ফুরিয়ে যায় অক্সিজেন। অভিযাত্রীদের সূত্র মতে, ভূমিকম্পে হিলারি স্টেপের যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছিল। ২০১৬ সালে ওই অংশে এতই বরফ জমে ছিল, ভালো করে বোঝা যায়নি হিলারি স্টেপের অস্তিত্ব। তাতে বোঝা গেল হিলারি স্টেপ আর নেই।

 

ট্রি অব টেনেরি নাইজেরিয়া

শত শত প্রজন্ম ধরে আফ্রিকার সাহারা মরুর বুকে বেড়ে ওঠে একটি গাছ। নিঃসঙ্গ, একদম একা। কেননা গাছটির আশপাশের ২৫০ মাইল পর্যন্ত ধূধূ মরুভূমি ছাড়া কিছুই নেই। গাছটির নাম ছিল এল আব্রে দু বা ট্রি অব টেনেরি। ১৯৩০ সালে ইউরোপীয় সামরিক বাহিনী এর নাম দেয় ‘এল আব্রে দু টেনেরি’। স্থানীয় কিংবা পথিকদের জন্য গাছটি ক্লান্তি দূর করার মাধ্যমই নয়, একটি রোডম্যাপ হিসেবেও কাজ করত। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাবলা বা একাশিয়া গোত্রের এ গাছটিই ছিল সম্ভবত ওই প্রজাতির শেষ বংশধর। বিস্ময়কর হলেও সত্য, গাছটির শিকড় মাটির গভীরে প্রায় ৩৬ মিটার বা ১২০ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ওখানেই রয়েছে পানিস্তর এবং সেই পানি শোষণ করে বেঁচে ছিল গাছটি। ১৯৭৩ সালে এক লিবীয় ড্রাইভার ট্রাক চালিয়ে সোজা গিয়ে ধাক্কা মারে গাছটাকে। সেই দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটে নিঃসঙ্গ বৃক্ষের। গাছটির নিঃসঙ্গতারও অবসান ঘটে। পরে সেখানে একটা ধাতব স্থাপনা তৈরি করে স্থানটিকে স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে।

 

গিজার্স উপত্যকা রাশিয়া

রাশিয়ায় মিলবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গিজার্স (হট ওয়াটার খাদ)। এক সময় রাশিয়ার কামচটকা উপদ্বীপের পাহাড়ে দেখা যেত প্রাকৃতিক এ আশ্চর্য। আর হ্যাঁ, পৃথিবীর প্রথম বৃহত্তম প্রাকৃতিক গিজার্সটি হলো- ওয়াইমিংয়ের ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক। তবে এগুলোর মধ্যে রাশিয়ার গিজার্স উপত্যকা বরাবরই অপরূপ এবং বৈচিত্র্যময়। বহু বর্ণ, রূপ আর শেওলায় ঘেরা প্রাকৃতিক আশ্চর্যের জন্য গিজার্স উপত্যকা প্রাচীনকাল থেকেই রহস্যঘেরা। নির্জন এ উপত্যকাটি আধ্যাত্মিক চর্চার কেন্দ্র হিসেবে মনে করেন অনেক পর্যটক। স্থানীয় অনেক বাসিন্দা উপত্যকার গিজার্স বা খাদগুলোকে নিজস্ব পার্থিব পথ প্রদর্শক বলে মনে করেন।

প্রায় ৬ কিলোমিটার (৩.৭ মাইল) এলাকা বিস্তৃত উপত্যকায় ৯০টির বেশি গিজার্স বা খাদ রয়েছে। দুঃখজনকভাবে, ২০০৭ সালে গিজার্স উপত্যকায় এক বিশাল ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। যার ফলে প্রাকৃতিক এ আশ্চর্যটি ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভূমিধসের কারণে তুষার, মাটি, পানি এবং পাথরে সৃষ্ট কাদামাটি ঘণ্টায় ২০-২৫ মাইল বেগে নেমে জেগে থাকা গিজার্স বা খাদগুলোকে গ্রাস করে। ফলে ভ্যালি অব গিজার্সের আকর্ষণীয় স্থান- ফুটন্ত ঝরনা, ছোট ছোট খাদ ও জলপ্রপাতগুলোকে গ্রাস করে।

পরবর্তী কয়েক মাসে খাদগুলোর পানি ফুরিয়ে যায়। বদলে যায় চিরচেনা গিজার্স উপত্যকা। তবে নতুন কয়েকটি গিজার্স যেমন- ম্লাডেনেকের আবির্ভাব ঘটে। তন্মধ্যে কয়েকটি প্রাচীন গিজার্সও আছে। বিশেষত পারভেনেটস গিজার্স এবং গিজারনায়া হ্রদের আবির্ভাব হয়। সৌভাগ্যবশত, আকস্মিক ভূমিধস ভ্যালি অব গিজার্সে আশীর্বাদ হয়ে আসে। বিপর্যয়ের ছয় বছর পর অঞ্চলটি নিজেকে নতুন রূপে ফিরে পেতে থাকে। ২০১৩ সালে গিজারনায়া হ্রদের জলের স্তর কমতে থাকে। যা আগে অনাবিষ্কৃৃত গিজারগুলো বিস্ফোরিত হতে সাহায্য করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এলাকাটি ২০০৭ সালের আগের রূপে ফিরে আসতে পারে।

 

ওল্ড ম্যান অব দ্য মাউন্টেইন

প্রাকৃতিক বিস্ময়ের আরেকটি উদাহরণ নিউ হ্যাম্পশায়ারের ‘ওল্ড ম্যান অব দ্য মাউন্টেইন’। যা দেখতে অনেকটা বুড়ো মানুষের চেহারার আকৃতির মতো। দৃষ্টিনন্দন পাহাড়টির এ অংশটি পর্যটকদের কাছে গ্রানাইট রক ফেস নামে সর্বাধিক পরিচিত। অনেকে আবার একে ‘গ্রেট স্টোন ফেস’ নামেও চেনেন। ২০০৩ সালে ওল্ড ম্যান অব দ্য মাউন্টেইনের কিংবদন্তি গ্রানাইট রক ফেস ধসে পড়ে। জানা গেছে, প্রায় ১২ হাজার বছর আগে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়েছিল ওল্ড ম্যান অব দ্য মাউন্টেইন। মুখের অবয়বটি প্রায় ৬ হাজার ৫৩০ মেট্রিক টন ওজনের কৌণিক পাথুরে সৃষ্টি হয়েছিল, যা  প্রায় ৪৫ ফুট লম্বা এবং ৩০ ফুট চওড়া। ১৮০৫ সালের দিকে ফ্রাঙ্কোনিয়া জরিপকারী দল প্রথম ‘ওল্ড ম্যান অব দ্য মাউন্টেইন’ আবিষ্কার করেন। জরিপকারী দলের ফ্রান্সিস হুইটকম্ব এবং লুক ব্রুকস প্রথম ওল্ড ম্যানকে পর্যবেক্ষণ করেন। সরকারি তথ্যানুসারে, সে সময় সমীক্ষাকারীদের বেশ কয়েকটি দল ওল্ড ম্যান আবিষ্কারের কৃতিত্ব দাবি করেছিল। ১৯০০ সালের গোড়ার দিকে প্রাকৃতিক বিস্ময়টিকে রক্ষার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। যাই হোক, ওল্ড ম্যান ধসে পড়ার খবরে এখনো ভূ-তাত্ত্বিকগণ অবাক হন। স্থানীয়রা হারিয়ে যাওয়া ওল্ড ম্যান স্মৃতিস্তম্ভটি পুনর্গঠন করতে চেয়েছিল। কিন্তু টিকে যাওয়া পাথর শ্রমিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে পরিকল্পনা বাতিল করা হয়।

 

গডস ফিঙ্গার স্পেন

গ্রান ক্যানারি দ্বীপের প্রতীক ‘এল দে ডো দে ডিওস’, যা ‘গডস ফিঙ্গার’ কিংবা ‘ঈশ্বরের আঙুল’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। স্পেনের ক্যানারি দ্বীপের এ বিস্ময়কর পাথরখ-টি অবস্থিত। দেখলে মনে হবে যেন পানির নিচ থেকে ভেসে উঠেছে এক দৈত্যাকার হাত এবং সেই হাতের একটি আঙুল উঁচিয়ে ইঙ্গিত করা হচ্ছে আকাশের দিকে। ক্যানারি দ্বীপের উত্তরে প্রাকৃতিকভাবেই ৯৮ ফুট উঁচু পাথরখন্ডটি গঠন হয়েছিল। গবেষকদের ধারণা, প্রায় ১৪ মিলিয়ন বছর আগে অগ্নেয়গিরি থেকে বেরিয়ে আসা লাভার মাধ্যমে পাথরটি এমন আকৃতি পায়। দৃষ্টিনন্দন পাথরখন্ডটির আকৃতি বছরের পর বছর অসংখ্য শিল্পী এবং অনুরাগীকে অনুপ্রাণিত করে আসছে। অনেকের বিশ্বাস, বিখ্যাত লেখক ডমিঙ্গো দোরেস্তে প্রথম ‘এল দে ডো দে ডিওস’ নামটি লিখেছিলেন। ২০০৫ সালের গ্রীষ্মমন্ডলীয় এক মৌসুমী ঝড়ে ধসে পড়ে এর চূড়ার অংশটি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বিশাল ঢেউয়ের কারণে ৩ লাখ বছরের পুরনো পাথরখন্ডটি ভেঙে পড়ে। বিস্ময়কর ‘গডস ফিঙ্গার’ ধসে পড়ার পর এক গবেষক দল ঐতিহাসিক স্থানটি পরিদর্শন করেন। তারা স্থানটিতে ‘গডস ফিঙ্গার’ পুনঃনির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করেন। যদিও স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তি ঐতিহাসিক ‘গডস ফিঙ্গার’ পুনঃনির্মাণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। বর্তমানে ভেঙে পড়া অবশিষ্ট অংশটি ‘রক পার্তিদো’ নামে স্থানীয়দের কাছে সর্বাধিক পরিচিত। বিখ্যাত ‘গডস ফিঙ্গার’ ভেঙে নার স্বতন্ত্র হারালেও এটি বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক আশ্চর্যগুলোর মধ্যে একটি।

 

চাকালতায়া হিমবাহ বলিভিয়া

যতদূর দেখা যায় শুধু বরফ আর বরফ। সারা বছরই সেখানে লেগে থাকে অভিযাত্রী এবং স্কি স্কিয়ারদের ভিড়। এক কথায় হিমবাহটি অভিযাত্রী এবং স্কি স্কিয়ারদের স্বর্গরাজ্য। এটি বলিভিয়ার আন্দিজ পর্বতমালার চাকালতায়া হিমবাহ। যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫ হাজার ৩০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। বলিভিয়ার লা পাজের উত্তর-পূর্বে প্রায় ২০ কিলোমিটার  এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ হিমবাহ। যা ভয়ানক হলেও অসম্ভব সুন্দর।

তবে বর্তমানে এখানে নেই তুষারের দেখা। নেই পর্যটকও। পরিবেশবিদদের আশঙ্কাই সত্যি হলো। বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তন গ্রাস করেছে জনপ্রিয় এ হিমবাহটিকে। এক সময়ের ব্যস্ত চাকালতায়া আজ পরিত্যক্ত অবস্থায়ই পড়ে আছে। শীতকাল ছাড়া এখানে বরফের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। অঞ্চলটি এখন পরিণত হয়েছে ধূসরে। অঞ্চলজুড়ে এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পাথরের টুকরো এবং শিলাখ-। জলবায়ু পরিবর্তন এমনই ভয়ানক থাবা বসিয়েছে বলিভিয়ার আন্দিজ অঞ্চলের চাকালতায়ায়।

২০০৫ সালের কথা। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন, ফুরিয়ে আসছে চাকালতায়া হিমবাহের আয়ু। পরিবেশবিদরা জানিয়েছিলেন, ২০১৫ সালের মধ্যে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে হিমবাহটি। ১৮ হাজার বছরের পুরনো এ হিমবাহ মাত্র এক দশক স্থায়ী হবে। তবে সেই ভবিষ্যদ্বাণীও মিথ্যা হয়ে যায়। ২০০৯ সালেই গলে যায় সম্পূর্ণ হিমবাহটি। যদিও ইতিউতি বরফের দেখা মিলত চাকালতায়ায়। ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে সেই পরিবেশও।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৪০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত প্রায় চার দশক ধরে আন্দিজ পর্বতমালার চাকালতায়া হিমবাহের ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ বরফই গলে যায়। গবেষকরা জানিয়েছেন, ১৯৯০ সাল থেকে গ্রীষ্মকালে আন্দিজ পর্বত অঞ্চলে প্রতি ১০ বছরে অন্তত বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ০.৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস (০.৬ ফারেনহাইট) বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে কমে এসেছে তুষারপাতের পরিমাণও। অঞ্চলটির ভূপ্রকৃতির যে চেহারা, তাতে স্কিইং তো বটেই, পর্বতাভিযানও দুরূহ ব্যাপার। শুধু তাই নয়, বর্তমানে বলিভিয়া বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনের তালিকায় ১৮১টি দেশের মধ্যে ৮০তম স্থানে রয়েছে।

 

অ্যাজুর উইন্ডো, মাল্টা

উত্তাল সমুদ্রের বুকে বিশাল প্রাকৃতিক জানালা! হ্যাঁ, ইউরোপের ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র মাল্টায় সবচেয়ে বিখ্যাত এ প্রাকৃতিক বিস্ময়- ‘অ্যাজুর উইন্ডো’। যা সমুদ্রের টেবিল হিসেবেও ব্যাপক জনপ্রিয়। তবে পর্যটকের কাছে এটি একটি বিশাল প্রাকৃতিক জানালা হিসেবেই বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। স্কুবা ডাইভারদের কাছেও স্থানটি ভীষণ জনপ্রিয়। ব্লগবাস্টার ‘ক্ল্যাশ অব দ্য টাইটানস’ এবং ‘গেম অব থ্রোনস’ মুভি ও টিভি সিরিয়ালে অসংখ্যবার দেখানো হয় বিস্ময়কর খাদটি।

ভূমধ্যসাগরের উপকূল মূলত ঝড়প্রবণ এলাকা। চুনাপাথরে সৃষ্ট বিশাল খাদটি- তার অস্তিত্ব থাকাকালীন অগণিত শক্তিশালী ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে টিকেছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের এক মৌসুমী ঝড়ে প্রাকৃতিক আশ্চর্যটি সমুদ্রগর্ভে চিরতরে হারিয়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সমুদ্রের তীব্র স্রোতের কারণে তা ধসে পড়ে। জানা গেছে, মাল্টার গোজো দ্বীপে এতকাল স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে ছিল পাথরের খাদটি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রাকৃতিকভাবে দুটি চুনাপাথর ধসে গুহা আকারে এটি তৈরি হয়েছিল। তবে এটি ঠিক কতকাল আগে সৃষ্টি হয়েছিল এর সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও ধারণা করা হয়, খাদটি মাত্র ১৪০ বছর পুরনো। দর্শনীয় স্থানটির অবস্থান মাল্টার গোজো দ্বীপপুঞ্জের দ্বেজা নামক পর্যটক গ্রামে।

তবে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে মাল্টিজবাসীর ভাঙা হৃদয় জোড়া লাগতে যাচ্ছে। বিখ্যাত স্থপতি স্বেটোজার আন্দ্রেভ এবং ডিজাইনার এলেনা ব্রিটানিস্কায়ারের সহযোগিতায় একটি বিশাল আর্টওয়ার্কের মাধ্যমে দীর্ঘ সময়ের জন্য ‘অ্যাজুর উইন্ডো’ পুনরুদ্ধারের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। পরিকল্পনামাফিক দুই রাশিয়ান শিল্পী ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অ্যাজুর উইন্ডোর নকশা জমা দিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য প্রকল্পটি ইতোমধ্যেই স্থানীয়দের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। মাল্টিজবাসী নতুন এ প্রকল্পকের নাম দিয়েছে ‘মাল্টার হৃদয়’।

 

স্লিম রিভার, কানাডা

সময়টি ছিল ২০১৭ সালের গ্রীষ্মকাল। আধুনিক বিশ্ব এক অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হলো- যা ছিল অত্যন্ত বিস্ময়কর এবং আশ্চর্যজনক। কানাডা এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্র জানিয়েছে, মাত্র চার দিনের ব্যবধানে কানাডার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যায় বিশাল একটি নদী। স্থানীয়দের কাছে নদীটি ‘স্লিম রিভার’ নামে সর্বাধিক পরিচিত। গবেষকদের মতে, কানাডার ইউকন অঞ্চলে অবস্থিত স্লিম রিভার বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হারিয়ে গেছে।

কানাডার পরিবেশবিদদের মতে, প্রায় ৩০০-৩৫০ বছর ধরে কানাডার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতো এ স্লিম রিভার। কিন্তু ২০১৬ সালে কি এমন ঘটনা ঘটেছিল যে, চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যায় নদীটি। মাত্র চার দিনের ব্যবধানে নদীর পানি এতটাই হারিয়ে গেছে যে, আজ বয়েচলা নদীটি এক ধূধূ মরুভূমি। গণমাধ্যম সূত্র জানিয়েছে, কানাডার জনপ্রিয় স্লিম রিভারটি আজ একেবারে পানিশূন্য, তৃষ্ণার্ত একটি চ্যানেল। বিজ্ঞানীরা দ্য নেচার জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশাল স্লিম রিভারটি হারিয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা আবারও ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছেন, ভবিষ্যতে পৃথিবীর বুকে আরও অনেক নদী ও জলাশয়কে একই পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে। নদীটির মৃত্যুর প্রভাব পরিবেশের ওপর ব্যাপকভাবে দেখা দেয়। স্লিম রিভারের দাপিয়ে বেড়ানো মাছগুলোর সব মারা যেতে থাকে। আশপাশের প্রতিবেশী হৃদগুলোর গঠনে অনেক পরিবর্তন আসে। এমনকি সেখানকার আবহাওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বেশি দেখা দেয়। প্রদেশটিতে বসবাসরত মানুষ ধূলিঝড়ের কবলে পড়ে। অঞ্চলটির অন্য হিমবাহী নদীগুলোয় অর্থাৎ যেসব নদী জনবহুল এলাকায় পানি এবং জলবিদ্যুৎ সরবরাহ করত সেগুলোকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। ভূতাত্ত্বিকবিদরা এ ঘটনাকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের আগে অদেখা পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

 

অ্যারাল সাগর, এশিয়া

৬৮ হাজার বর্গকিলোমিটার অ্যারাল সাগরের মাঝে একদা ১ হাজার ১০০টি দ্বীপ ছিল। হ্রদের বুকে ভেসে বেড়াত অজস্র জাহাজ, প্রমোদতরী ও নৌকা। তবে এসবই এখন ইতিহাস। অঞ্চলটির বর্তমান অবস্থা দেখে বোঝার উপায় নেই যে, বর্তমানের ধূধূ মরুভূমিই ছিল এক সময়ের অ্যারাল সাগর।

মধ্য এশিয়ার অ্যারাল সাগর, আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর মধ্যে চতুর্থ। কাস্পিয়ান সাগর, লেকস সুপেরিয়র ও ভিক্টোরিয়ার পরই তার স্থান। কিন্তু এখন তার ১০ ভাগও অবশিষ্ট আছে কিনা সন্দেহ। গত কয়েক দশকের মধ্যে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম নাটকীয় ঘটনা। জানা গেছে, ১৯৭০-এর দশকে সাগরটি শুকিয়ে মাছগুলো মরে যেতে থাকে। পরের ৪০ বছরে শুকিয়ে যায় অ্যারাল সাগর। মরুভূমি গ্রাস করে নেয় প্রায় ৬৮ হাজার বর্গ কিলোমিটারের সাগরটি। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের সীমাহীন লোভের কারণে হারিয়ে গেছে সমুদ্রের মতো অ্যারাল সাগর।

কাজাকিস্তানের জালানাস এলাকাটি ছিল অ্যারাল সাগরের উত্তরবর্তী কূলে। এখন সেখানে কোথাও পানির দেখা নেই। যেদিকে দুচোখ যায়; শুধু বালি আর বালি। সমুদ্রের উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য এখনো আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক মাছধরার ট্রলার, নৌকা। অ্যারাল সাগরের বাঁচা-মরা প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হয়নি। এটা মনুষ্যসৃষ্ট কর্মকান্ডের প্রত্যক্ষ পরিণতি। ১৯৭০ থেকে ৮০র দশকে এর উপকূলে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা তুলার জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে গিয়ে থমকে গেছে অ্যারাল সাগরের দুই সখা-নদী সির ডারয়া এ আমু ডারয়ার জলপ্রবাহ। ধীরে ধীরে পানিশূন্য হতে থাকে জেলেদের জীবিকার উৎস অ্যারাল সাগর। আজ তা কেবলই ধূধূ মরুভূমি।

 

 

সিকোইয়া টানেল ট্রি

ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যালভেরাস বিগ ট্রিস স্টেট পার্কের গৌরবময় ‘টানেল ট্রি’ ছিল স্থানীয় পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। এক সময় এ ‘টানেল ট্রি’ দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা ভিড় জমাত। কিন্তু ২০১৭ সালে গাছটি গোড়াসহ উপড়ে পড়ায় স্থানীয় পর্যটন খাত ব্যাপক ধাক্কা খায়। গাছটি উপড়ে পড়ার আগে সম্ভবত এটিই ছিল ক্যালিফোর্নিয়ার দৈত্যাকার সিকোইয়া গাছের সর্বশেষ প্রজাতি। বিশাল দৈত্যাকৃতির গাছটির গোড়ায় ছিল একটি ‘ড্রাইভ-থ্রু খিলানযুক্ত দরজা’। প্রাকৃতিক বিস্ময়ের এ ‘টানেল ট্রি’ দেখার জন্যই ক্যালিফোর্নিয়ার ওই পার্কে নামতো পর্যটকদের ঢল। স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, ১৮০০ শতকে পার্কটিতে পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধির জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার কর্তারা অঞ্চলটির বিশালাকার (পাইওনিয়ার কেবিন ট্রি) গাছটিতে ‘সুড়ঙ্গ’ (টানেল) তৈরি করেছিলেন। যদিও পাইওনিয়ার কেবিন গাছটির প্রকৃত বয়স অজানাই থেকে যায়। তবে জনশ্রুতি রয়েছে- সেকোইয়া প্রজাতির পাইওনিয়ার কেবিন ট্রির বয়স ১ হাজার বছরেরও বেশি। পার্শ্ববর্তী ইয়োসেমাইট ন্যাশনাল পার্কে এমনই একটি প্রাচীন গাছ আবিষ্কার করে ক্যালিফোর্নিয়া কর্তৃপক্ষ। ধারণা করা হয়, আবিষ্কৃৃত গাছটি প্রায় ৩ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। পর্যটনের আকর্ষণ বৃদ্ধির জন্য শুধু কয়েকটি সিকোইয়া প্রজাতির গাছের গোড়ায় ‘সুড়ঙ্গে’র মাধ্যমে রাস্তা করা হয়েছিল, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল ইয়োসেমাইট ন্যাশনাল পার্কের ‘ওয়াওনা ট্রি’। ১৯৬৯ সালে এক ঝড়ে গাছটি সম্পূর্ণ উপড়ে পড়ে। অনুমান করা হয়, গাছটি প্রায় ২ হাজার ১০০ বছর বয়সী ছিল। যাই হোক, পার্কে এখনো তিনটি রেডউড গাছ রয়েছে, যা অনেক লম্বা, তবে সিকোইয়া গাছের চেয়ে পাতলা। যার গোড়ার দিকে ‘সুড়ঙ্গ’ তৈরি করা। গাছ তিনটিই প্রাইভেট কোম্পানির মালিকানাধীন। বন পরিষেবা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখনো ‘টানেল ট্রি’র নিচ দিয়ে গাড়ি অতিক্রম করে।

সর্বশেষ খবর